বনভূমি রক্ষায় ১৬ দফা সুপারিশ টিআইবির

বনভূমি রক্ষায় ১৬ দফা সুপারিশ টিআইবির

নিজস্ব প্রতিবেদক : সরকারি বনভূমি অবৈধ দখল, সংরক্ষিত বনের পাশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ বৃহৎ প্রকল্প গ্রহণ, বনভূমির জমি বিভিন্ন উন্নয়ন কাজে বরাদ্দ ও ব্যবহারসহ বনের স্থায়ী ক্ষতিরোধে বন অধিদপ্তর নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছে বলে জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। দুর্নীতি বিরোধী ও সুশাসের জন্য কাজ করে যাওয়া প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, বন আইনের আমূল সংস্কার করে যুগোপযোগী করতে হবে। আর বন অধিদপ্তরও বনকেন্দ্রিক অনিয়ম-দুর্নীতি এবং বিভাগীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত শাস্তি প্রদানের নজির স্থাপনসহ ১৫ দফা সুপারিশ করেছে টিআইবি। গতকাল বুধবার প্রকাশিত ‘বন অধিদপ্তর : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এক গবেষনাপত্রে এসব কথা জানায় প্রতিষ্ঠানটি। বন অধিদপ্তরের আইনি এবং প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জসমূহ চিহ্নিত করাই গবেষণার উদ্দেশ্য বলে প্রতিষ্ঠানটি দাবি করেছে। এছাড়াও বন অধিদপ্তরের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকান্ডের অনিয়ম ও দুর্নীতির ধরন, মাত্রা ও কারণ চিহ্নিত করা। গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ এর তথ্য মতে, ২০০১ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশে মোট ৪ লাখ ৩২ হাজার ২৫০ একর এলাকার বৃক্ষ আচ্ছাদন হ্রাস পেয়েছে যা মোট বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকার প্রায় ৯ শতাংশ। বনের জমিতে বিভিন্ন ধরনের উন্নয়নমূলক কাজ বাস্তবায়ন ও স্থাপনা নির্মাণের ফলে বন সংকোচন অব্যাহত রয়েছে। বন উদ্বেগজনকভাবে হ্রাস পাওয়ার পেছনে বনকেন্দ্রিক অনিয়ম ও দুর্নীতির ভূমিকাই প্রধান কারণ। দেশের বন ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা ও উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের মূল দায়িত্ব বন অধিদপ্তরের ওপর ন্যস্ত। গবেষণায় উল্লেখ করা হয়,
বন আইনের প্রয়োজনীয় বিধিমালা, সম্পূরক আইন ও কর্মপরিকল্পনার অনুপস্থিতিসহ ৯৩ বছরের পুরনো আইনটি আমূল সংস্কারের মাধ্যমে যুগোপযুগী করার উদ্যোগ অনুপস্থিত।
বন নির্ভর আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রথাগত ভূমি অধিকার হরণ, বন আইন লঙ্ঘন করে ও একতরফাভাবে সংরক্ষিত বন, বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য, জাতীয় উদ্যান ঘোষণাসহ জবরদখল উচ্ছেদের নামে অধিদপ্তরের বৈষম্যমূলকভাবে ক্ষমতা চর্চা।
অধিদপ্তর কর্তৃক সনাতন পদ্ধতিতে বন সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা, রাজস্ব ও আয়-বর্ধক কর্মকাণ্ডের সম্প্রসারণসহ সামাজিক বনায়নের আড়ালে ‘আগ্রাসী’ প্রজাতির গাছের বনায়ন দ্বারা প্রাকৃতিক বন উজাড় ত্বরান্বিত।
বন অধিদপ্তরের কার্যক্রম বাস্তবায়নে অগ্রাধিকারমূলক বরাদ্দ, অবকাঠামো ও লজিস্টিকসের ঘাটতি, আধুনিক প্রযুক্তির সম্প্রসারিত না হওয়া এবং এসব ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কার্যকর উদ্যোগের অনুপস্থিতি।
অধিদপ্তরের কর্মকাণ্ডসহ রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্য অর্জন, বন সংরক্ষণ ও বনায়ন কর্মকাণ্ডকে কেন্দ্র করে দুর্নীতির বিস্তার এবং তা প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপের ঘাটতি। এবং
সকল স্তরের কর্মকাণ্ড কার্যকর তদারকি ও পরিবীক্ষণের ঘাটতিসহ পারফরমেন্স অডিট অনুপস্থিত; দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকরণ ইত্যাদি।
এই গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল ও তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে বন অধিদপ্তরের কার্যক্রমে সুশাসনের চ্যালেঞ্জসমূহ চিহ্নিত করে তা থেকে উত্তরণে টিআইবি ১৫ দফা সুপারিশমালা দিয়েছে। এগুলো হলো:
১. রাষ্ট্রীয় অতীব জরুরি প্রয়োজনে বনভূমি ব্যবহার ও ডি-রিজার্ভের পূর্বে বন অধিদপ্তরের অনুমতি গ্রহণ, ত্রুটিমুক্ত ইআইএ সম্পন্নকরণ ও সমপরিমাণ ভূমিতে প্রতিবেশবান্ধব বনায়নে ‘কমপেনসেটরি এফরেস্টেশনের বিধি’ প্রণয়ন করা।
২. বন আইনের আমূল সংস্কার করে যুগোপযোগী করতে হবে। আদিবাসীদের প্রথাগত ভূমি অধিকার নিশ্চিতকরণসহ জনঅংশগ্রহণমূলক বন সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে বন অধিদপ্তরের দায়িত্ব বিধিবদ্ধভাবে নির্ধারণ করা।
৩. বনখাত হতে রাজস্ব সংগ্রহ অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে; প্রাকৃতিক বনের বাণিজ্যিকায়ন সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা।
৪. ইতোমধ্যে অবক্ষয়িত প্রাকৃতিক বনের জমিতে সৃজিত সামাজিক বনের গাছ না কেটে মেয়াদ উত্তীর্ণ বনসমূহের উপকারভোগীদের মুনাফা প্রদানসহ ওই বন প্রাকৃতিক বনে রূপান্তরের লক্ষ্যে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
৫. অবক্ষয়িত প্রাকৃতিক বন ও বৃক্ষশূন্য জমিতে, যেমন- নতুন চর ও সড়ক-মহাসড়কের পার্শ্ববর্তী এলাকায় পরিবেশ ও প্রতিবেশ-বান্ধব বন সৃজন করা।
৬. বন ব্যবস্থাপনায় সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সম্প্রসারণ ও কার্যকর ব্যবহার করতে হবে; অত্যাধুনিক প্রযুক্তি-নির্ভর বন সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনাকে প্রাধান্য দিয়ে অধিদপ্তরের সার্বিক প্রশাসনিক ও জনবল কাঠামো পুরোপুরি ঢেলে সাজানো।
৭. বনকর্মীদের মাঠ পর্যায়ে সার্কেল ও বিভাগভিত্তিক বাধ্যতামূলক ও পালাক্রমিক বদলির বিধান প্রবর্তন এবং এর যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিতকরণে কার্যকর জবাবদিহির ব্যবস্থা রাখা।
৮. যথাযথ চাহিদা নিরূপণ সাপেক্ষে সকল পর্যায়ের বন কার্যালয়সমূহের জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক বরাদ্দ, পর্যাপ্ত অবকাঠামো, কারিগরি ও লজিস্টিকস সুবিধা নিশ্চিত করা।
৯. মাঠ পর্যায়ের সকল স্তরের কার্যালয়সমূহে অর্থ বণ্টন ও লেনদেন অনলাইন/মোবাইল ব্যাংকিং-ভিত্তিক করতে হবে; বিট ও অধস্তন কর্মীদের বেতন-ভাতা সংশ্লিষ্ট কর্মীর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সরাসরি প্রেরণের ব্যবস্থা করা।
১০. সিএস রেকর্ডকে ভিত্তি ধরে সরকারি বনের সীমানা চিহ্নিত করতে হবে; এখন পর্যন্ত কী পরিমাণ বনভূমি জবরদখল হয়েছে তার ওপর বস্তুনিষ্ঠ তথ্যভাণ্ডার তৈরি ও তা উদ্ধারে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
১১. বন সংরক্ষণ কার্যক্রম তদারকি ও পরিবীক্ষণে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সম্প্রসারণ ও এর কার্যকর ব্যবহার করতে হবে; ডিএফও ও বন সংরক্ষককে অধিনস্ত কার্যালয়সমূহের কর্মকাণ্ড নিয়মিতভাবে অবহিতকরণের ব্যবস্থা করা।
১২. বন অধিদপ্তরের বনায়ন ও বন সংরক্ষণ কার্যক্রম নিরীক্ষায় পারফরমেন্স অডিট ব্যবস্থা প্রবর্তন ও এর কার্যকর চর্চা নিশ্চিত করা।
১৩. ওয়েবসাইটকে আরো তথ্যবহুল (যেমন-পূর্ণাঙ্গ বাজেট, প্রকল্পের পূর্ণাঙ্গ তথ্য, বিভিন্ন সংস্থাকে বরাদ্দকৃত ও জবরদখল হওয়া ভূমির পরিমাণের ওপর পূর্ণাঙ্গ তথ্য ও নিরীক্ষা প্রতিবেদন ইত্যাদি) ও নিয়মিত হালনাগাদ করা।
১৪. প্রকল্প বাস্তবায়ন, বন ও বনজ সম্পদ সংরক্ষণের সাথে জড়িত সকল কর্মীর নিজস্ব ও পরিবারের অন্য সদস্যদের বাৎসরিক আয় ও সম্পদের বিবরণী বছর শেষে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেয়াসহ তা প্রকাশ করা। এবং
১৫. বন অধিদপ্তর ও বনকেন্দ্রিক অনিয়ম-দুর্নীতি এবং বিভাগীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুততার সাথে শাস্তি প্রদানের নজির স্থাপন করা।

Leave a reply

Minimum length: 20 characters ::

More News...

ডিসি, এসপির কঠোর হুঁশিয়ারী প্রয়োজনে বদলী হবো কিন্তু নির্বাচন হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও  নিরপেক্ষ 

মে দিবসের ইতিহাস