দৈনিক সমাচার : প্রতিষ্ঠার ৪৩ বছর দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার নতুন স্বপ্ন

দৈনিক সমাচার : প্রতিষ্ঠার ৪৩ বছর দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার নতুন স্বপ্ন

অনেক দিন থেকেই নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে দৈনিক সমাচার। কখনও প্রকাশনার ধারাবাহিকতা বিঘ্ন ঘটেছে, এমনটি শুনিনি। ইত্তেফাক বা প্রথম আলোর মতো ওয়েল সারকুলেটেড না হলেও সাংবাদিক মহলে পত্রিকাটি সুপরিচিত। এই পত্রিকায় অতীতে কাজ করেছেন, এমন অনেককেই চিনি। সেদিন হঠাৎই একটা ফোন পেলাম। ও প্রান্ত থেকে ভেসে এলো মো. আবু তালেবের কণ্ঠ। আবু তালেব আমার সহকর্মী ছিলেন দুই দশকেরও বেশি কাল। ওঁ ছিলো দৈনিক ইত্তেফাকের সিনিয়র রিপোর্টার। কাজে যেমন দক্ষ ও সিনসিয়ার, তেমনই মার্জিত। আবু তালেবের কোনো শত্রু থাকতে পারে, এমনটা ভাবা আমার জন্যে কঠিন ছিলো। আবু তালেব সালাম দিয়ে সেদিন ফোনে বললেন, ভাই আমাকে একটা লেখা দিতে হবে।
বললাম, তুমি লেখা দিয়ে কী করবে?
ওঁ ততোধিক বিনয়ের সাথে বললেন, ভাই দৈনিক সমাচারের ৪৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর বিশেষ সংখ্যার জন্যে একটা লেখা চাই। জানতে চাইলাম, তুমি ইত্তেফাক ছেড়ে সমাচারে জয়েন করেছো।
– সমাচার এখন আমারই দায়িত্বে প্রকাশিত হয়।
কথাটা পরিস্কার হলো না। জানতে চাইলাম, তুমি কি এখন এই পত্রিকার সম্পাদক?
আবু তালেব বললেন, ভাই এখন পত্রিকার প্রকাশকও আমি।
বুঝলাম, ইত্তেফাকের আবু তালেব এখন দৈনিক সমাচারের মালিক। ইত্তেফাক ছেড়ে যে বেনিফিট পেয়েছে, তার সাথে আরও টাকা যোগ করে হয়তো সমাচারে ইনভেস্ট করেছেন। মনের ভেতর শংকা ও আশা-দুইয়ের দোলাচল। শংকিতবোধ করছি এই ভেবে যে, একটি মানসম্মত পত্রিকা চালানো সহজ কাজ নয়। যেমন বিপুল অংকের পুঁজি প্রয়োজন, তেমনই দরকার প্রফেশনাল দক্ষতা।
বিনা পুঁজি এবং প্রফেশনাল না হয়েও আজকাল অবশ্য প্রত্রিকা করা যায়। করাপশনের ভাগাড় থেকে সহজেই পঁচা টাকা তুলে আনা যায়। এ ধরনের পত্রিকার কোনো গুণমানের প্রয়োজন নেই। এদের কোনো পাঠকেরও প্রয়োজন নেই। লেখক -সাংবাদিকও এদের কাছে অনাহুত। একজন বা দুজন কাটিং পেস্টিং মাস্টার দিয়ে এরা পত্রিকা বের করে। এরা অনেক সময় আইডেনটিটি কার্ডও বিক্রি করে। এই করে এরা দেশজুরে চাষবাস করে চলেছে সাংবাদিক নামের সাংঘাতিক বিষবৃক্ষের। এদের কাছে দৈনিক পত্রিকার ডিক্লারেশান ও মিডিয়ালিস্টেড হওয়ার মানে হচ্ছে করাপশন ডিপো থেকে অনায়াসে লাভযোগের লাইসেন্স। এই পত্রিকাগুলোর ডাকনাম হচ্ছে আন্ডারগ্রাউন্ড নিউজ পেপার। এই পরিস্থিতিতে ছোট উদ্যোগের যারা প্রফেশনাল পত্রিকা করতে চান, তাদের পক্ষে টিকে থাকা দুরূহ। হয় তারা নিঃশেষ হয়ে যান, না হয় অচিরেই গড্ডরিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেন। সাংবাদিকতা পেশার নাম ভাঙ্গিয়ে তারা ঠিকই লাভবান হতে পারেন।
জানি, বিশ্বাস করি, সিনিয়র সাংবাদিক আবু তালেব সেই দলের নয়। পেশার বিউটি ও ডিগনিটির প্রশ্নে তিনি যথেষ্ট সচেতন। নীতি ও নৈতিকতা তিনি বিসর্জন দিতে চান না। তদুপরি সমাচার পত্রিকাটির পরিচিতি ও নেম ভ্যালুও রয়েছে। আবু তালেব স্বপ্ন দেখেন ছোট উদ্যোগের একটি মানসম্মত পত্রিকা করার। মনে আশা পোষণ করেন, ধীরে ধীরে সমাচার একদিন নামকরা প্রভাবশালী পত্রিকা হয়ে উঠবে। সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ কাগজ হয়ে উঠবে। কিন্তু আশা ও বাস্তবতা – দুইয়ের মধ্যে ব্যবধান দুস্তর। বলা বাঞ্ছনীয় যে, সংবাদপত্রে অনুপ্রবেশকারী একশ্রেণির সাংবাদিক নামের কালো বিড়াল শিয়ালের ষড়যন্ত্রে আবু তালেবের মতো আরও অনেক সাংবাদিক পেশাচ্যুত হয়ে অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে ছোট উদ্যোগের দৈনিক প্রকাশ করেন ভালো কিছু করবেন এই আশা নিয়ে। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে নেমে দেখেন, তাদের পাশে কেউ নেই। ভোগবাদী সমাজে পাঠক দশটাকা দিয়ে একবস্তা রঙিন কাগজ চান। তারা প্রায়শ মানসম্মত সংবাদপত্র চান না। শুধু নিউজ ভিউজে তাদের তৃষ্ণা মেটে না। তারা সাবসিডাইজড পত্রিকা চান। সাবসিডি দিয়ে সেই সব ধনাঢ্য পরিবারের পক্ষেই কেবল দশ টাকায় কিংবা তার চেয়েও কম দামে পাঠকের হাতে এক বস্তা রঙিন ছাপার কাগজ তুলে দেয়া সম্ভব, যারা পত্রিকাকে তাদের কৃত অনাচারের ঢাল হিসাবে ব্যবহার করবেন। পেশাদার সাংবাদিকের পক্ষে এমনটা কী করে সম্ভব? বিজ্ঞাপনদাতারা তেলা মাথায় তেল দিতে পছন্দ করেন। এমনকি সাংবাদিক কমিউনিটিও পেশাদার সাংবাদিকের ভালো সংকল্পের পাশে দাঁড়ায় না। এই যখন চারপাশের অবস্থা, তখন হাবুডুবু খেয়ে পেশাদার সাংবাদিক উদ্যোগীও গড্ডরিকা স্রোতে গা ভাসিয়ে দেন।
এইরূপ বৈরি পরিবেশের মধ্যেও নিরাশ হতে নারাজ আশাবাদীরা। তারা বলেন, সমস্যার প্রকৃতি বুঝে পেশাদারী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অসুবিধার মধ্যে যেটুকু সুবিধা পাওয়া যায়, তার সদ্ব্যবহার করে লেগে থাকলে পরিস্থিতি অনুকূলে আসতে বাধ্য। বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ, পেশাদার সাংবাদিক-কলামিস্টের কলাম, তাৎপর্যপূর্ণ সম্পাদকীয় – এসব পত্রিকার ন্যায্য ব্যবসার পথে বাধা নয়। বরং এইসব উপাদান যে কোনো পত্রিকাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে। যে কোনো পত্রিকায় সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠান সক্রিয় থাকলে, সে পত্রিকাকে কোনো মহলের পক্ষে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। বিজ্ঞাপনদাতারও গণ্য করবেন। একটি সমঝদার পাঠকগোষ্ঠীও তৈরি হয়ে যাবে।
একালে সংবাদপত্র সমাজের দর্পনই কেবল নয়, ব্যবসায়ও। নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর দিন আর নেই। আর এও এক কঠিন সত্য যে, সংবাদপত্রের পথ কখনই কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না, বরাবরই কণ্টকাকীর্ণ। সংবাদপত্রের সূচনায় বাধা ছিল কেবলই ব্রিটিশ ও জমিদার। কিন্তু এখন কাঁটা বিছানো পদে পদে। শুরুর দিকে নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে গিয়ে চরম মূল্য দিতে হয়েছে উদ্যোক্তাদের। কোম্পানি আমলে আইরিশ নাগরিক জেমস অগাস্টাস হিক্কি প্রকাশ করেন দুইপাতার পত্রিকা বেঙ্গল গেজেট বা ক্যালকাটা এডভারটাইজার। কোম্পানির সমালোচনার অপরাধে হিক্কিকে কোলকাতা থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিলো। জেলের ঘানিও টানতে হয়েছিল। শেষ জীবনে তাকে নিপতিত হতে হয়েছিল কঠিন দারিদ্র্যের মধ্যে। হিক্কি কোনো পেশাদার সাংবাদিক ছিলেন না। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে তিনি পত্রিকা করেছিলেন। বেঙ্গল গেজেটের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি ছিলো না। তিনি নিজেই সম্পাদক, নিজেই রিপোর্টার ও লেখক। ইউরোপীয় হয়েও নিগ্রহের শিকার হয়েছিলেন। পরবর্তীতে এদেশীয় বা ইউরোপীয় -যারাই সংবাদপত্র করেছেন, তাদের প্রায় সবাইকে নিগ্রহের শিকার হতে হয়েছে। গ্রামবার্তা প্রকাশিকা নিয়ে কাঙাল হরিনাথকে কতটা লড়াই করতে হয়েছিল সে ইতিহাস অনেকেরই জানা। এ সবই সংবাদপত্রের ইতিহাসের অংশ। ইতিহাসের এই খন্ডাংশ এখানে তুলে ধরা হলো কেবল এই কথাটিই জানাতে যে সংবাদপত্রের পথ কখনোই সহজ ছিলো না।
একালে সংবাদপত্র আরও বহুমুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। প্রতিযোগিতা ও প্রতিকূলতা দুই-ই এখন তীব্র। নৈরাশ্যবাদীরা বলেন, এই চ্যালেঞ্জ অনতিক্রম্য। ইন্টারনেট আজ ট্রাডিশনাল সংবাদ মাধ্যমকে গ্রাস করতে চাইছে। প্রিন্ট মিডিয়ার তো নাভিশ্বাস উঠার উপক্রম। শুধু প্রিন্ট মিডায়াই বা বলবো কেন, ইলেকট্রনিক মিডিয়া টেলিভিশন ও প্রথাগত বার্তাসংস্থাগুলোও ভালো নেই। খবর কিংবা বিনোদন — কোনো কিছুর জন্যে মানুষ এখন আর কোনো প্রথাসিদ্ধ গণমাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল নয়। অগণিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও সামাজিক মাধ্যমের সুবাদে খবর ও গুজব একইসাথে ছড়িয়ে পড়ছে মুহূর্তের মধ্যে। ব্যাপক ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশান এবং ট্রেডিং হাউজগুলোর বিকাশ ঘটায় কর্পোরেট কালচার প্রবল হয়ে উঠেছে। ফলে বিজ্ঞাপনের ভলিউম বেড়ে গেলেও এই মার্কেট সুষম ও ভারসাম্যপূর্ণ নয়। সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় কমার্শিয়াল বাজারে মনোপলি বা একচেটিয়া ব্যবসায় জমে উঠেছে। সিন্ডিকেশান ও মনোপলি নিঃসন্দেহে দুর্নীতির জাতক। এই বাস্তবতায় বিজ্ঞাপনের ন্যায্য বণ্টন হয় না। পেশাদারিত্বের কোনো দাম নেই। অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলো বেশির ভাগেরই কোনো আয় নেই। পেশাদারী দায়িত্বশীলতা, বস্তুনিষ্ঠতা ও শুদ্ধতার বালাই নেই । নিউজ পোর্টাল খুলে অনেক ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ব্যবসায়ের পরিবর্তে করাপশনের নতুন নতুন পথ বের করে নেয়া হচ্ছে। এমতাবস্থায় প্রফেশনাল জার্নালিজম কতটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। সৎ উদ্যোগের দৈনিকগুলোর টালমাটাল অবস্থা। প্রিন্টেড মাসিক, পাক্ষিক ও সাপ্তাহিকের অস্তিত্ব বিলীন হতে বসেছে। এই প্রতিকূলতা একদিনে সৃষ্টি হয়নি। তলানিতে ক্রমাগত বর্জ্য জমে স্বচ্ছতার সংকট দেখা দিয়েছে। স্বাভাবিক প্রবাহ দারুণভাবে বিঘ্নিত।
এহেন পরিস্থিতিতেও দৈনিক সমাচার ৪৩ বছরের দীর্ঘ পথ পারি দিয়ে এসেছে, এটা কম কথা নয়। এর যেমন পজিটিভ দিক রয়েছে, নেগেটিভ বিবেচনারও সুযোগ রয়েছে। চার দশকে যে কোনো প্রতিষ্ঠানের শক্ত ভিত তৈরি হয়ে যাওয়া উচিত। দৈনিক সমাচার কতটা শক্তিশালী ভিত রচনা করতে পেরেছ তা বাইরে থেকে বোঝা মুশকিল। তবে কাগজটি মজবুত ভিত তৈরি করায় সচেষ্ট বলেই প্রতীয়মান হয়। আজ যখন আবু তালেবের মত একজন দক্ষ পেশাদার সাংবাদিক পত্রিকাটির দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন, তখন আশাবাদী হয়ে উঠবার কারণ তো নিশ্চয়ই রয়েছে। অনস্বীকার্য যে সমাচারের পেছনে ফেলে আসা ৪৩ বছরের সবসময় সমান মসৃণ ছিলো না। কণ্টক বিছানো পথও হয়তো পারি দিতে হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে সমাচারের ইতিহাসে সামান্য আলোকপাত করা বাঞ্ছনীয়। হিসেব মতে সমাচারের প্রথম প্রকাশ ১৯৭৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর। বহমান সময়ের মধ্যে পত্রিকাটি হাত বদল হয়েছে তিনবার। শুরুতে সমাচারের কর্ণধার ছিলেন সেকান্দর হায়াত মজুমদার। পরে পত্রিকাটির দায়িত্ব নেন সংবাদপত্রের প্রথিতযশা ব্যক্তিত্ব আবুল কাশেম মজুমদার। বর্তমানে নতুন উদ্যমে সাংবাদিক আবু তালেব সমাচারকে একটি শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাবার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। পেশাদারী নৈতিকতা ও দায়িত্বশীলতার কথা ভুলে না গিয়ে তিনি যদি লেগে থাকেন সুফল পাওয়া যাবে ইনশাল্লাহ। সমাচারের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি ও সাফল্য কামনা করি।
ফাইজুস সালেহীন : বহুদর্শী সাংবাদিক-কলামিস্ট ও কথাসাহিত্যিক

Leave a reply

Minimum length: 20 characters ::

More News...

বাকেরগঞ্জে ভোট জালিয়াতির পরিকল্পনাকারী আবদুল হক পুলিশ হেফাজতে

হামাসের দাবি মানবে না ইসরায়েল: নেতানিয়াহু