নিজস্ব প্রতিবেদক : ১৯৭১ সালের ৬ মার্চ সারাদেশে হরতাল পালিত হয়। গত কয়েকদিনে সেনাবাহিনীর নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সর্বস্তরের মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, লেখক, শিল্পী, সাংবাদিকসহ সকলেই স্ব-স্ব অবস্থান থেকে প্রতিবাদ মিছিলে শামিল হতে থাকে। এ কয়দিনে ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্য বঙ্গবন্ধু ও বাংলার জনগণকে দায়ী করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এদিন বেতারে ভাষণ দেন। ৫ মার্চ ইয়াহিয়া এবং জনাব ভুট্টো ৫ ঘণ্টা গোপনে বৈঠক করে যে খসড়া তৈরি করেছিলেন বক্তৃতায় সেটিই প্রতিফলিত হয়। এদিন ঢাকাসহ সারাদেশে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ভেঙ্গে ৩৪১ জন কারাবন্দী পলায়নকালে পুলিশের গুলিতে ৭ জন নিহত ও ৩০ জন আহত হয়। এদিন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক শাসক লে. জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খানকে সরিয়ে তদস্থলে ‘বেলুচিস্তানের কসাই’ খ্যাত লে. জেনারেল টিক্কা খানকে উভয় পদে নিযুক্ত করার ঘোষণা দেয়া হয়। এয়ার মার্শাল আসগর খান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দ্বিতীয় দফা বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেন, “পরিস্থিতি রক্ষা করার জন্য আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। বাকি বিষয় আগামীকাল শেখ মুজিবের বক্তৃতায় জানতে পারবেন।” কার্যত, সারা দেশের মানুষ এদিন থেকে অধীর আগ্রহে প্রহর গুনতে থাকে ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণে পরবর্তী দিকনির্দেশনা জানার। এদিন আমি এক বিবৃতিতে ৭ মার্চের ভাষণ রেসকোর্স থেকে সরাসরি প্রচারের জন্য ঢাকা বেতার কেন্দ্রের প্রতি আহ্বান জানাই।
একাত্তরে ৭ মার্চেই সমান্তরাল সরকার গঠিত হয়
পাকিস্তানী মিডিয়া
বাংলাদেশ কাল বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চ ভাষণ স্মরণ করার অপেক্ষা করছে। পাকিস্তানী গণমাধ্যম ও তাদের সাবেক সামরিক কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন যে ওই ভাষণই পাকিস্তানী শাসনের অবসান ঘটায়।
পাকিস্তানের অন্যতম জনপ্রিয় পত্রিকা ডন তার অনলাইন ভার্সনে সম্প্রতি এক মন্তব্য প্রতিবেদনে বলেছে, ‘(১৯৭১ সালের ৭ মার্চ) এক সমান্তরাল সরকার কার্যকর হয়। ১৯৪২ সালে সিন্ধুতে সামরিক শাসন জারির পর (বিভাগ-পূর্ব) উপমহাদেশে এটা ছিল দ্বিতীয় সমান্তরাল সরকার।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ‘জুলফিকার আলী ভুট্টো যখন করাচীতে সংবাদ সম্মেলন করছিলেন, তখন ঢাকায় মুজিব এক জনসমাবেশে ভাষণ দিচ্ছিলেন। সব সরকারী, আধাসরকারী ও বেসরকারী ভবনে জাতীয় পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উড়ানো হয়।’
‘এ লিফ ফ্রম হিস্ট্রি : এ প্যারালাল গবর্নমেন্ট টেকিং ওভার’ শিরোনামে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘মুজিবের বাড়িতে একই পতাকা উত্তোলন করা হয়।’
এতে বলা হয়, ১৯ মার্চ ‘ইয়াহিয়া ও মুজিবের বৈঠক কোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়। পরের দিন আলোচনা অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত হয়। এরপর আরও গুরুত্বপূর্ণ সময় অতিবাহিত হতে থাকে।’ এর আগে কয়েকজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা ওই ভাষণকে ‘ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তান’ অবসানের রূপরেখা বলে অভিহিত করার পর গত সপ্তাহে ডন এই পর্যালোচনামূলক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে। লে. জেনারেল কামাল মতিন উদ্দিন তার ‘ট্র্যাজেডি অব এরর : ইস্ট পাকিস্তান ক্রাইসিস ১৯৬৮-১৯৭১’ বইতে লেখেন, ‘১৯৭১ সালের ৭ মার্চ মূলত বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়।
পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান বাহিনীর কমান্ডার লে. জেনারেল এএকে নিয়াজী তার ‘বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান’ বইতে লেখেন, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ‘মুজিব মূলত শাসক হিসেবে পরিগণিত হন।’ তিনি লেখেন, ‘তাঁর বাড়ি প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ে পরিণত হয়, কেন্দ্রীয় সরকারের কমান্ড অস্বীকার করা শুরু হয়।’
তবে ভাষণ ও ওইদিনের দৃশ্য সম্পর্কে অপেক্ষাকৃত আরেকজন জুনিয়র কর্মকর্তার লেখায় তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক জান্তার উদ্বেগের কথা উলেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, রমনা রেসকোর্স ময়দানে কয়েক লাখ লোকের বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণে কি থাকতে পারে এবং এর কি প্রতিক্রিয়া হতে পারে সে ব্যাপারে সামরিক জান্তা দারুণভাবে উদ্বিগ্ন ছিল।
তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিক অবশ্যই বিষয়টি পাকিস্তানী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখেছেন। তবে তিনি বঙ্গবন্ধুর প্রশংসা থেকে বিরত থাকতে পারেননি। তিনি তাঁর ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইতে এর বিশদ বর্ণনা করেছেন। সালিক লেখেন, ‘গুরুত্বপূর্ণ ৭ মার্চ যতই ঘনিয়ে আসছিল ঢাকা ততই গুজব ও আতঙ্কে উত্তাল হয়ে উঠছিল।’ তিনি লেখেন, পাকিস্তানের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের সদর দফতর ঢাকা রেডিও স্টেশনে এই ‘ননসেন্স’ সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়। তিনি নিজে এই নির্দেশ রেডিও স্টেশনকে জানান। তিনি বলেন, এই নির্দেশে বঙ্গবন্ধু তীব্রভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, আমরা যদি সাড়ে ৭ কোটি মানুষের কণ্ঠ সম্প্রচার করতে না পারি তাহলে আমরা কাজ করতে অস্বীকৃতি জানাব’ একথা বলার সঙ্গে সঙ্গে রেডিওর সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়।
বিকেলে রেসকোর্স ময়দানে মুজিব মঞ্চে উঠে তাঁর দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ঘোষণা শোনার অপেক্ষায় সমবেত বিশাল জনতাকে স্বাগত জানান। মুজিব তাঁর স্বভাবসুলভ বজ্রকণ্ঠে বক্তৃতা শুরু করেন। তবে তাঁর বক্তৃতার বিষয়বস্তুকে পরিবেশ উপযোগী করে তুলতে তিনি ধীরে ধীরে তাঁর কণ্ঠস্বর নিচের দিকে নিয়ে আসেন।
তিনি একতরফাভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা (ইউডিআই) দেননি। তবে ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের জন্য তিনি ৪টি পূর্বশর্ত আরোপ করেন।
এগুলো হলো সামরিক আইন প্রত্যাহার, জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর, সেনাবাহিনীর ব্যারাকে ফিরে যাওয়া এবং বাঙালী হত্যাকাণ্ডের একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন। ‘জলোচ্ছ্বাসের স্রোত নেমে যাওয়ার মতো করে জনগণ রেসকোর্স ময়দান থেকে চলে যেতে থাকে। মনে হচ্ছিল সন্তোষজনক বাণী শোনার পর মসজিদ বা চার্চের মতো কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান থেকে তারা ফিরে যাচ্ছে।’ পাকিস্তানী ওই মেজর তার বইতে লেখেন ‘তাদের মধ্যে ক্রোধ ছিল না। তারা ক্রোধানি¦ত হলে হয়ত ক্যান্টনমেন্টের ওপর চড়াও হতো। আর আমাদের অনেকেই এজন্য আতঙ্কিত ছিল।’