সিডরের পর ১৩ বছরেও স্বাভাবিক হয়নি জীবনযাত্রা

সিডরের পর ১৩ বছরেও স্বাভাবিক হয়নি জীবনযাত্রা

নিজস্ব প্রতিবেদক : গতকাল ছিলো সেই দুঃসহ স্মৃতি বিজড়িত ভয়াল ১৫ নভেম্বর। উপকূলীয় এলাকায় ২০০৭ সালের এই দিনেই আঘাত হানে সুপার সাইক্লোন সিডর। ১৩ বছর আগের এই দিনে উপকূলের প্রকৃতি ও মানবতাকে লন্ডন্ড করে দিয়েছিল সুপার সাইক্লোন সিডর। দিনটি উপকূলবাসীর জন্য বেদনার। গতকাল উপকূলীয় জেলাগুলোর কয়েক হাজার বাড়িতে সৃষ্টি হয় শোকাবহ পরিবেশ, ঝড়ে এইদিনে আপনজনদের হারিয়ে ফেলেছেন তারা। আরও হাজার হাজার মানুষ শরীরের বিভিন্ন স্থানে বয়ে বেড়াচ্ছেন এই দিনে পাওয়া আঘাতের ক্ষত। তবে প্রকৃতিতে সিডর যে ছাপ রেখে গেছে তা এখনও মুছে ফেলতে পারেনি মানুষ, কাটিয়ে উঠতে পারেনি সেই ঝড়ের ক্ষয়-ক্ষতি। বলা যায়, সিডরের পর ১৩ বছরেও স্বাভাবিক হয়নি বরগুনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, খুলনা, বরিশাল, ভোলা, পিরোজপুরসহ উপকূলবাসীর জীবনযাত্রা। ঘড়ির কাঁটায় তখন সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিট। মহাবিপদ সংকেতের কথা শুনে আতঙ্কিত উপকূলের মানুষ। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির সঙ্গে বইছিল দমকা হাওয়া। সচেতন মানুষ পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর হতে যাচ্ছে বুঝতে পেরে যেতে শুরু করলেন আশ্রয়কেন্দ্রে। তবে সরকারি মাইকিংয়ে কান না দিয়ে বেশির ভাগ মানুষই রয়ে গেলেন বাড়িতে। তাদের ধারণা ছিল, কত ঝড়ই এলো-গেলো, এবারেও তাদের কিছু হবে না। তবে তাদের বিশ্বাস ভেঙেচুরে যেতে থাকে আরেকটু পরই। সিডর আঘাত হানতে শুরু করে উপকূলীয় এলাকায়। মানুষ টের পেলো ঝড়ের গতি যেন ঘর উড়িয়ে নিয়ে যাবে এখনই। এর সঙ্গে বাড়তে থাকে পানির প্রবাহ। তবে রাত সাড়ে ১০টার দিকে বঙ্গোপসাগরের সব জল যমদূতের মতো উঠে এসে মানুষকে নাকানিচুবানি দিয়ে কেড়ে নিতে শুরু করে এক একটি তাজা প্রাণ। সেই ঝড়ের সঙ্গে আসা মাত্র ১০ মিনিটের জলোচ্ছ্বাসে উপকূলের কয়েক হাজার মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। পুরো এলাকা হয়ে যায় লণ্ডভণ্ড। সকালে উপকূলবাসীর মনে হয় যেন কেয়ামত হয়ে গেছে। চারদিকে ধ্বংসলীলা। লাশের পর লাশ। পানির কারণে কবর দেওয়ার জায়গাও নেই। এক একটি কবরে ২-৩ জনের লাশ মাটি চাপা দেওয়া হলো। সিডরের এত বছর পরেও নিহতের সঠিক সংখ্যা পাওয়া যায়নি। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, সিডরের আঘাতে বরগুনা জেলায় ১ হাজার ৩৪৫ জন মানুষ মারা গেছেন। নিখোঁজ রয়েছেন আরও ১৫৬ জন। ৩০ হাজার ৪৯৯টি গবাদি পশু ও ৬ লাখ ৫৮ হাজার ২৫৯টি হাঁস-মুরগি মারা যায়। জেলার ২ লাখ ১৩ হাজার ৪৬১টি পরিবারের সবাই কমবেশি ক্ষতির শিকার হন। সম্পূর্ণভাবে গৃহহীন হয়ে পড়ে ৭৭ হাজার ৭৫৪টি পরিবার। তবে বেসরকারি হিসেবে নিহতের সংখ্যা ১ হাজার ৬শ’ জনের ওপরে। আর সরকারি হিসাবে সিডরে বাগেরহাট জেলায় নিহত হয়েছিল ৯০৮ জন, আহত ১১ হাজার ৪২৮ জন। সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয় ৬৩ হাজার ৬শ’ বাড়িঘর। আংশিকভাবে বিধ্বস্ত বাড়িঘরের সংখ্যা ১ লাখ ৬ হাজার। সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয় পাকা ৫ কিলোমিটার সড়ক, কাঁচা সড়ক ধ্বংস হয় প্রায় ৫০ কিলোমিটার এলাকার। আর পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয় সাড়ে ১৬ কিলোমিটার বাঁধ। মারা যায় ১৭ হাজার ৪২৩টি গবাদি পশু। বিনষ্ট হয়েছে ১২ হাজার হেক্টর ক্ষেতের ফসল ও ৮ হাজার ৮৮৯ হেক্টর চিংড়ি ঘের। এমন প্রাণহানি ও ধ্বংসের চিহ্ন ছিল খুলনা, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী, ভোলাসহ উপকূলীয় সব জেলা-উপজেলায়। ভীষণভাবে বিধ্বস্ত হয় বাংলাদেশের একমাত্র ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের গাছপালা ও পশু-পাখি-প্রাণী-পতঙ্গ। সিডরে এত মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, ওই সময় আবহাওয়া বিভাগের সতর্কবাণী যথাযথ ছিল না। আবহাওয়া অফিস ৪ নম্বর সতর্ক সংকেত থেকে হঠাৎ ১০ নম্বর বিপদ সংকেতের ঘোষণা দেয়। মোংলা সমুদ্র বন্দরকে কেন্দ্র করে যে সতর্ক সংকেত প্রচার করা হয়েছিল, তা বোঝার উপায় বরগুনার মানুষের ছিল না। রেডক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবকরা ছিল প্রায় নিষ্ক্রিয়। দুই এক জায়গায় তারা মাইকিং করলেও বেশির ভাগ জায়গায়ই কোনও সতর্ক সংকেত প্রচার করা হয়নি। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তথ্য অফিস মাইকিং করলেও তা ছিল শহর এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। যারাও ঘূর্ণিঝড়ের সংকেত শুনেছেন, তারাও পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্রের অভাবে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে পারেননি। উপকূলীয় এলাকায় ঝড়-জলোচ্ছ্বাস হবেই, মানুষের এগুলো ঠেকানোর উপায় নাই। তবে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষয়-ক্ষতির এমন ঘটনা যেন আর না ঘটে। মানুষ সতর্ক সংকেত শুনে যেন নিরাপদে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে পারে, সে ব্যাপারে সরকারকে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন উন্নয়ন সংগঠন জাগো নারীর প্রধান নির্বাহী হোসনেয়ারা হাসি। তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের সতর্ক সংকেত স্থানীয় ভাষায় বোধগম্য করে প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য ঘূর্ণিঝড় কর্মসূচির স্বেচ্ছাসেবকসহ বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে। বরগুনা পাবলিক পলিসি ফোরামের আহ্বায়ক মো. হাসানুর রহমান ঝন্টু বলেন, উপকূলীয় এলাকায় আরও কমিউনিটি রেডিও স্টেশন স্থাপন করতে হবে। যাতে প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষ দ্রুত সতর্কবার্তা পেতে পারে। তিনি আরও বলেন, বরগুনাসহ সিডর বিধ্বস্ত উপকূলীয় জনপদে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে উন্নয়নে ব্যাপক কাজের নামে বরাদ্দ দেওয়া হলেও তার অধিকাংশ চলে গেছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও এনজিওদের পকেটে। তাই সিডর বিধ্বস্ত এই জনপদের মানুষের মধ্যে ত্রাণ কিংবা ঋণ বিতরণ করা হলেও সক্ষমতা বৃদ্ধিতে তেমন কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বরগুনা সদর উপজেলার সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা নলটোনা। এই এলাকায় সিডরের এক বছর আগে থেকেই বেড়িবাঁধ ছিল না। ফলে সিডরের সময় এই জায়গায় জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল ২০ ফুটের মতো। ঘূর্ণিঝড়ের পরদিনই সেখানে অর্ধ শতাধিক মানুষের লাশ পাওয়া যায়। তখনও এলাকাটি পানির নিচে হাবুডুবু খাচ্ছিল। লাশ দাফনের জন্য কোনও স্থান খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। লাশগুলো নিয়ে আসা হয় বরগুনা-নিশানবাড়িয়া সড়কের পাশে পশ্চিম গর্জনবুনিয়া গ্রামে। দাফনের কাপড় ছাড়াই ২৯ জনকে ১৯টি কবরে মাটি চাপা দেওয়া হয়। জায়গার অভাবে ৪টি কবরে ৩ জন করে ১২ জন, ৩টি কবরে ২ জন করে ৬ জন ও ১২টি কবরে ১ জন করে ১২ জনের লাশ দাফন করা হয়। কবরগুলোকে একটু উঁচু করে রাখা হয়েছে। বরগুনা প্রেসক্লাবের সহযোগিতায় স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা সংগ্রাম প্রাথমিকভাবে ইট দিয়ে কবরস্থানটি ঘিরে দিয়েছিল। বর্তমান জেলা ও উপজেলা প্রশাসন বরগুনা প্রেসক্লাবের সহযোগিতায় সেখানে সিডর স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করেছে। সারিবদ্ধ কবর দেখে মানুষ এসে এখনও সেখানে থমকে দাঁড়ায়। সিডরের স্মৃতি হয়ে আছে এসব কবর। কবরগুলোতে শুয়ে আছেন নলটোনা গ্রামের তাসলিমার বাবা আবদুর রশিদ (৫৫), মা আম্বিয়া খাতুন (৫০), ছেলে আল আমিন (৭), ফোরকানের বাবা দিন আলী (৬৫), হাসি বেগমের মেয়ে শাহিনুর (৪), শাহজাহানের মা তারাভানু (৬০), মেয়ে খাদিজা আক্তার (৩), আনিসের স্ত্রী খাদিজা বেগম (৩০), ছেলে আবু বকর (৩), রফেজ উদ্দিনের স্ত্রী বিউটি বেগম (৩৫), মাসুমের মা হেলেনা আক্তার (৩০), বাদলের মা লালবরু (৬৭), বাবুলের মেয়ে জাকিয়া আক্তার (৮), আবদুস সত্তারের স্ত্রী সাফিয়া খাতুন (৩০), ছেলে রেজাউল (১২), রেজবুল (৭), মেয়ে সাবিনা (৯), সগির হোসেনের মেয়ে সোনিয়া আক্তার (৩), আবদুর রবের ছেলে হোসেন আলী (১২), মেয়ে ময়না (৭), হোসনেয়ারা (৫), শাশুড়ি মনোয়ারা বেগম (৫০), সরোয়ারের স্ত্রী জাকিয়া আক্তার (৩০), মেয়ে রোজিনা (৪), ছত্তারের স্ত্রী বেগম (৫০), পুত্রবধূ নাজমা আক্তার (৩০), নাতি পারভেজ (৪), নাসির উদ্দিনের স্ত্রী হোসনেয়ারা (২৬) ও গর্জনবুনিয়া গ্রামের গনি বিশ্বাসের ছেলে জাহিদ হোসেন (৫)। বরগুনার জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ বলেন, সিডর বাংলাদেশের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। যা কেড়ে নিয়েছে উপকূলবাসীর সহায় সম্বল, কেড়ে নিয়েছে আপনজনদের। এ ক্ষতি অপূরণীয়। তবু সহায়তা প্রদানকারী সংস্থাগুলো ত্রাণ সহায়তার পাশাপাশি সক্ষমতা বৃদ্ধিতে কাজ করলে উপকূলবাসী কিছুটা হলেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে। সেই সঙ্গে পরবর্তী ভয়াবহতার হাত থেকেও রক্ষা পাবে। এদিকে বাগেরহাটে সিডর বিধ্বস্ত হওয়ার পর এ জনপদের মানুষ স্বজন হারানোর শোক বুকে চেপে রেখে একটি টেকসই বাঁধের দাবি তোলেন। সিডরের পর তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান ড. ফখরুদ্দিন আহম্মেদ ও সেনাপ্রধান মইন ইউ আহম্মেদসহ সরকারের একাধিক উপদেষ্টা বেড়িবাঁধ উঁচু করাসহ টেকসইভাবে বাঁধ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন। তবে তাদের শাসনামল শেষ হওয়ার পরে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকারের একটি পুরো মেয়াদ (২০০৯-২০১৩) পার হলেও বাগেরহাটের সিডর ক্ষতিগ্রস্তরা বাঁধের দেখা পাননি। অবশেষে এর পরের মেয়াদের আওয়ামী লীগ সরকার (২০১৪-১৮) ক্ষমতায় এসে ২০১৬ সালের ২৬ জানুয়ারি বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি বাঁধের কাজ এখানে শুরু করে। ‘সিএইচডব্লিউই’ নামের চীনের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মাটি ও ব্লক বাঁধ দিয়ে এখনও এর নির্মাণ কাজ বাস্তবায়ন করছে। কিন্তু, বাঁধ নির্মাণ শুরু হলেও নদী শাসনের কোনও ব্যবস্থা না থাকায় এই বাঁধ কতদিন টেকসই হবে তা নিয়ে ভীষণ সংশয় এলাকার মানুষের। শরণখোলা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান রায়হান উদ্দীন শান্ত বলেন, সিডরের পরে শরণখোলাবাসীর একটাই দাবি ছিল টেকসই বেড়িবাঁধের আগে নদী শাসন করা। কিন্তু, আমরা দেখছি বেড়িবাঁধের কাজ ঠিকই চলছে কিন্তু কোনও নদী শাসনের ব্যবস্থা এখনও হয়নি। এখনও যদি নদী শাসনের কাজটি করে বেড়িবাঁধের কাজ শেষ করা যায় তাহলে শরণখোলাবাসী উপকৃত হবে।

Leave a reply

Minimum length: 20 characters ::

More News...

সারা দেশে ‘হিট স্ট্রোকে’ ৮ জনের মৃত্যু

কারাগারেও মাদকের আখড়া