যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের ঘটনায় তদন্ত কমিটি

যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের ঘটনায় তদন্ত কমিটি

যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের তিন বন্দি কিশোর নিহত ও অন্তত ১৪ জন আহত হওয়ার ঘটনায় দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে সমাজসেবা অধিদপ্তর।শুক্রবার (১৪ আগস্ট) দুপুরে প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক শেখ রফিকুল ইসলাম স্বাক্ষরিত চিঠিতে এই কমিটি গঠন করা হয়।আগামী তিন কর্মদিবসের মধ্যে সরেজমিন তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।তদন্ত কমিটির দুই সদস্য হলেন- সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রতিষ্ঠান) যুগ্মসচিব সৈয়দ মো. নূরুল বাসির ও সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (প্রতিষ্ঠান-২) এমএম মাহমুদুল্লাহ।যশোরের জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান জানান, সরেজমিনে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র পরিদর্শন করে এ ঘটনার নেপথ্য সব সূত্র উদঘাটন করতে হবে। এ ঘটনার সঙ্গে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের কোনো কর্মকর্তা, কর্মচারীর প্রত্যেক্ষ, পরোক্ষ সংশ্লিষ্টতা বা সম্পৃক্ততা আছে কি না যাচাই করতে হবে। তাৎক্ষণিকভাবে কেন্দ্রে অবস্থানরত নিরাপত্তাকর্মীদের ভূমিকা কি ছিল তা যাচাই করতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক ও অন্যান্য কর্মচারীদের দায়িত্ব পালনে কোনরূপ উদাসিনতা, অবহেলা, গাফিলতি ও ব্যর্থতা ছিল কিনা তা যাচাই করতে হবে। এছাড়া উপ-পরিচালক জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের কোনরূপ ব্যর্থতা ছিল কিনা তাও যাচাই করতে হবে। এ বিষয়গুলো ছাড়া অন্যকোন বিষয় তদন্ত কমিটির দৃষ্টিগোচর হলে সেই বিষয়েও তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করতে বলা হয়েছে।এরআগে,সংঘর্ষ নয়, বরং কর্মকর্তা ও আনসার সদস্যদের বেধড়ক মারধরে যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে বন্দিদের হতাহতের ঘটনা ঘটেছে বলে জারিয়েছে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কিশোর বন্দিরা।এছাড়া পুলিশ ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও প্রাথমিকভাবে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। ঘটনার প্রায় ছয় ঘণ্টা পর বিষয়টি জানা গেছে বলেও নিশ্চিত করেছেন পুলিশের খুলনা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি এ কে এম নাহিদুল ইসলাম। বৃহস্পতিবার (১৩ আগস্ট) দুপুরের এ ঘটনায় যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের তিন বন্দি নিহত ও ১৪ জন আহত হয়।  নিহতরা হলো- বগুড়ার শিবগঞ্জের তালিবপুর পূর্ব পাড়ার নান্নু পরমাণিকের ছেলে নাঈম হোসেন, একই জেলার শেরপুর উপজেলার মহিপুর গ্রামের নুরুল ইসলাম নুরুর ছেলে রাসেল ওরফে সুজন ও খুলনার দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশা পশ্চিম সেনপাড়ার রোকা মিয়ার ছেলে পারভেজ হাসান রাব্বি। নিহত নাঈম ধর্ষণ ও রাব্বি হত্যা মামলার আসামি ছিল।  গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র পরিদর্শন শেষে পুলিশের খুলনা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি নাহিদুল ইসলাম বলেন, এখানে আসলে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি।  ঘটনাটি একপক্ষীয়।  তিনি আরও বলেন, ঘটনাটির প্রায় ছয় ঘণ্টা পর জানা গেছে। স্থানীয় সংবাদকর্মীরাও ঘটনা জেনেছেন সন্ধ্যার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে। তিনি নিজেও রাত ১০টার পর ঘটনা জেনে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে এসেছেন। এখানে কী হয়েছে এবং কেন হয়েছে তা পুলিশ তদন্ত করবে। প্রশাসনের পক্ষ থেকেও তদন্ত হবে। আর ক্ষতিগ্রস্ত কিশোরদের স্বজনরা মামলা করলে পুলিশ মামলা নেবে। তদন্তাধীন ঘটনা হওয়ায় এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে তিনি রাজি হননি। রাতে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র পরিদর্শন শেষে যশোরের জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান বলেন, কীভাবে এ কিশোররা হতাহত হলো তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তদন্তের পরই পুরো বিষয়টি পরিষ্কার হবে।  এদিকে যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালে ভর্তি বন্দি কিশোররা তুলে ধরেন তাদের ওপর নির্যাতনের বর্ণনা।  তারা জানান, ঘটনার সূত্রপাত গত ৩ আগস্ট। শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের আনসার সদস্য নূর ইসলাম কয়েকজন কিশোরের চুল কেটে দিতে চান। কিন্তু কিশোররা চুল কাটতে রাজি না হওয়ায় তিনি কর্মকর্তাদের কাছে অভিযোগ করেন ওই কিশোররা নেশা করে। এর প্রতিবাদে ওইদিন কয়েকজন কিশোর তাকে মারধর করেন।আহত কিশোরদের দাবি, ওই ঘটনার সূত্র ধরে বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে ১৮ জন বন্দিকে রুম থেকে বাইরে বের করে আনা হয়। এরপর বিকেল ৩টা পর্যন্ত পালাক্রমে তাদের লাঠি ও রড দিয়ে বেধড়ক মারধর করা হয়। এভাবে মারধরের পর তারা অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদের ফেলে রাখা হয়। পরে কয়েকজন মারা গেলে সন্ধ্যার দিকে তাদের মরদেহ যশোর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।  শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে আনসার সদস্য ও তাদের নির্দেশে কয়েকজন কিশোর ওই ১৮ জনকে বেধড়ক মারধর করে। মারধরের কারণে তারা অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদের ফেলে রাখা হয়। কয়েকজন অচেতন থাকায় তারা অজ্ঞান হয়ে গেছে মনে করলেও পরে তারা বুঝতে পারে এরা নিহত হয়েছে। এরপর সন্ধ্যায় এক এক করে তাদের মরদেহ হাসপাতালে এনে রাখা হয়।  হাসপাতাল সূত্র জানায়, শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ দীর্ঘসময় পর সন্ধ্যা ৭টায় রাব্বি, সুজন ও নাঈমকে যশোর জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায়।  যশোর জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক অমিয় দাস বলেন, দেড় ঘণ্টার ব্যবধানে তিনটি মরদেহ আসে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে। সন্ধ্যা ৬টা ৩৮ মিনিটে নাইম হাসান, সাড়ে ৭টায় পারভেজ হাসান ও রাত ৮টায় আসে রাসেলের মরদেহ। এ চিকিৎসক বলেন, একজনের মাথায় ভারী কোনো বস্তু দিয়ে আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে। অন্যদের শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন এখনও শনাক্ত হয়নি।  তিন কিশোরের মরদেহ হাসপাতাল মর্গে রয়েছে বলে খবর পেয়ে সেখানে সংবাদকর্মীরা ভিড় করেন। তখন হাসপাতালে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের কাউকে পাওয়া যায়নি। শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক আব্দুল্লাহ আল মাসুদের নম্বরে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে বক্তব্য নেওয়ার জন্য স্বশরীরে উন্নয়ন কেন্দ্রে যাওয়া হলেও কর্তব্যরত আনসার সদস্যরা জানান, ভেতরে পুলিশ ছাড়া অন্য কারো প্রবেশ নিষেধ।  এক পর্যায়ে কেন্দ্রের প্রশিক্ষক মুশফিক দাবি করেন, কয়েকদিন আগে সংশোধনাগারে শিশুদের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন আহত হয়। ওই ঘটনার জেরে বৃহস্পতিবার দুপুরের পর আবার সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে নাইম, রাব্বি ও রাসেল হোসেন গুরুতর আহত হয়। পরে তাদের যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন। কেন্দ্রের সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মাসুদ দাবি করেন, সংঘর্ষে ১০ জন আহত হয়েছেন।এসময় তারা সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে বন্দি পাভেল ও রবিউলের নেতৃত্বাধীন দু’টি গ্রুপ রয়েছে। এ দুই গ্রুপ দুপুর ২টার দিকে লাঠি ও রড নিয়ে সংঘাতে লিপ্ত হয়। এতে হাতহতের ঘটনা ঘটেছে। নিহত তিনজন হলো- রাব্বি, রাসেল ও নাঈম। এরমধ্যে পাভেল গ্রুপের সদস্য রাব্বি ও রাসেল আর রবিউল গ্রুপের সদস্য নাঈম।  যশোর পুলিশের ডিএসবি ডিআই-১ পুলিশ পরিদর্শক এম মশিউর রহমান জানান, শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে এ ঘটনা দুপুরে ঘটলেও মরদেহ হাসপাতালে আনা হয়েছে সন্ধ্যার পর।  ঘটনা জানাজানির পর রাতে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে যান যশোরের জেলা প্রশাসন তমিজুল ইসলাম খান, পুলিশ সুপার আশরাফ হোসেনসহ পুলিশের কর্মকর্তারা। মধ্যরাতে খুলনা থেকে ঘটনাস্থলে আসেন পুলিশের খুলনা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি নাহিদুল ইসলাম।  বালকদের জন্য দেশে দু’টি শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র আছে। যার একটি গাজীপুরের টঙ্গীতে, অন্যটি যশোর শহরতলীর পুলেরহাটে। কিশোর অপরাধীদের জেলখানায় না পাঠিয়ে সংশোধনের জন্য এ উন্নয়ন কেন্দ্রে রাখা হয়। সমাজসেবা অধিদপ্তর এ কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রক। যশোর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে প্রায়ই অঘটন ঘটে। মরদেহ উদ্ধার, মারধরের ঘটনা এর আগেও ঘটেছে। সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বে অবহেলা, দুর্নীতির কারণে প্রতিষ্ঠানটিতে অনিয়ম জেকে বসেছে। এর আগে একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটি এ তথ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি সুষ্ঠুভাবে চালানোর জন্য একগুচ্ছ সুপারিশ করেছিল। কিন্তু অবস্থার উন্নতি হয়নি বরং অবনতি হয়েছে। তিন মরদেহ উদ্ধারের মাধ্যমে তা প্রমাণিত হয়েছে।

Leave a reply

Minimum length: 20 characters ::

More News...

দুর্ঘটনার আশঙ্কায় জনমনে উদ্বগে বীরগঞ্জের সড়কগুলো দাপিয়ে বড়োচ্ছে কিশোর চালকরা

সন্দ্বীপে কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনা উদ্বোধন