দেশব্যাপী শুদ্ধি অভিযান শুরুর পর চট্টগ্রামে প্রথম অস্ত্রসহ গ্রেফতার হয় চকবাজার এলাকার আলোচিত সন্ত্রাসী নূর মোস্তফা টিনু। সেসময় চকবাজারে অপরাধ কিছুটা কমে আসলেও বর্তমানে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপ ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা থেকে শুরু করে অস্ত্র ব্যবসা সবকিছুই চলছে। রাজনৈতিক গ্রুপিংয়ে কদর বাড়ছে চকবাজার এলাকার ছিঁচকে অপরাধী থেকে দাগি সন্ত্রাসীদের। অন্তত ৮-১০টি গ্রুপ পৃথকভাবে সন্ত্রাসী কার্যকলাপে সক্রিয় আছে চকবাজার এলাকায়।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ঘিরে অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করছে নূরে আলম ওরফে নুরু। অ্যাম্বুলেন্স স্ট্যান্ড, ফার্মেসি, ল্যাব ও হাসপাতালগুলোতে নিয়মিত চাঁদা আদায় করছে নুরু বাহিনী।
শুধু তাই নয়, মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ভেতর একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছে নুরু বাহিনী। সরকারি ওষুধ আত্মসাৎ, জাল সার্টিফিকেট, বাচ্চা চুরি থেকে শুরু করে সমস্ত অপরাধের নিয়ন্ত্রক নুরু সিন্ডিকেট।
চকবাজারে নতুন করে সক্রিয় হয়ে উঠেছে একসময়ের দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী গিয়াস সিদ্দিকী ওরফে পিস্তল গিয়াস। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তালিকায় একসময় শীর্ষে থাকা এই সন্ত্রাসী হঠাৎ প্রকাশ্যে চলে আসায় এলাকায় আতংক ছড়িয়েছে।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে আন্দরকিল্লা চৌরঙ্গী হোটেলে ফিল্মি স্টাইলে তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা রায়হানকে গুলি করার পর অপরাধ জগতে আলোচনায় উঠে আসে গিয়াস। সেই থেকে একের পর এক হত্যাকাণ্ড বা হত্যার উদ্দেশ্যে গুলিবর্ষণ, ডাকাতি, চাঁদাবাজির অভিযোগে অন্তত এক ডজন মামলার আসামি হয়। বহদ্দারহাট থেকে র্যাবের হাতে অস্ত্রসহ গ্রেফতারও হয়েছিল একবার। বিগত কিছুদিন যাবৎ চকবাজার এলাকায় চাঁদাবাজি, জায়গা দখল, কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ, অস্ত্র প্রদর্শনসহ সন্ত্রাসী কার্যকলাপে পুরোদমে সক্রিয় গিয়াস।
এদিকে কারাগারে আটক নূর মোস্তফা টিনুর অনুসারী সন্ত্রাসীরা দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকার পর ফের এলাকায় সক্রিয় হয়েছে। গ্রুপটি নিয়ন্ত্রণ করছে টিনুর ভাই নুরুল আলম শিপু ও কাপাসগোলার সাদ্দাম হোসেন ইভান। শিপুর বিরুদ্ধে ছিনতাই ও বিস্ফোরণের অন্তত দশটি মামলা আছে।
টিনুর সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে পরিচিত সাদ্দাম হোসেন ইভান। কথায় কথায় গুলি চালানো, অস্ত্র প্রদর্শন, নির্মাণাধীন ভবন, কোচিং সেন্টার ও ফুটপাত থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় ও কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করছে সে।
এক ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনায় (পাঁচলাইশ থানার মামলা নং-৭[৭]১৭) গ্রেফতার হয়েছিল ইভান। এছাড়া চকবাজার থানায় আরো তিনটি চাঁদাবাজি ও হত্যার চেষ্টার অভিযোগে মামলা আছে।
চকবাজার এলাকায় মাদক সম্রাট হিসেবে পরিচিত মোরশেদ আলম। ২০১২ সালে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় র্যাবের সোর্স এরশাদ৷ চাঞ্চল্যকর এই মামলার চার্জশিটভুক্ত প্রধান আসামি খোরশেদ আলমের ছোট ভাই মোরশেদ। মামলাটি বর্তমানে (মামলা নম্বর-এসটি-৬২৫/১২) মহানগর দায়রা জজ প্রথম আদালতে বিচারাধীন।
চক সুপার মার্কেটের আশপাশ ও খাল পাড়ে একচ্ছত্র মাদক বিক্রি, পতিতালয় ও জুয়ার আসর পরিচালনা করছে মোরশেদ। বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা আছে তার বিরুদ্ধে।
এদিকে চকবাজার এলাকায় আতঙ্কের নাম ছোট দেলোয়ার ও কিলার ফয়সাল। পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী তারা। তাদের পৃথক দুটি গ্রুপ অস্ত্র ব্যবসা, চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তারে দীর্ঘদিন যাবত সক্রিয়। প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইমন ও ডিসি রোডের যুবলীগ নেতা ফরিদ হত্যার আসামি কিলার ফয়সাল। বারবার গ্রেফতার হলেও জামিনে এসে ফের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালিয়ে যায় ফয়সাল।
চকবাজার ও পাঁচলাইশ এলাকায় ছিনতাই চক্রের হোতা স্টাফ কোয়ার্টারের রবিউল ইসলাম ওরফে হামকা রাজু ও পাঁচলাইশের শাহাদাত হোসেন ওরফে ল্যাংডা রিফাত। তারা পৃথকভাবে নিজস্ব গ্রুপে ছিনতাই ও ব্ল্যাকমেইল করার মতো অপরাধে জড়িত। রাজুর বিরুদ্ধে তিনটি এবং ল্যাংডা রিফাতের বিরুদ্ধে অন্তত দশটি মামলা আছে চকবাজার ও পাঁচলাইশ থানায়।
চকবাজার এলাকায় পরিবহন স্ট্যান্ড থেকে নিয়মিত চাঁদাবাজিতে জড়িত ধুনিরপুলের এস এম সামাদ। ফুটপাত থেকে চাঁদাবাজি ও ডিসি রোড এলাকায় জুয়ার আসর তার নিয়ন্ত্রণে। পুলিশকে ‘ম্যানেজ’ করে সামাদ নানা অপরাধ চালাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগ আছে পুলিশের কথিত দুই সোর্সের বিরুদ্ধেও। তারা হলো ল্যাড়া নাছির ও সেকান্দর। নাছির একসময় শিবিরের দুর্ধর্ষ ক্যাডার ছিল। নিজ মাকে হত্যাসহ একাধিক মামলার আসামি সে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর গ্রেফতার এড়াতে পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করছে জানা গেছে।
সেকান্দরের বিরুদ্ধে তিন পুলিশ কর্মকর্তাসহ চান্দগাঁও থেকে এক বিউটিশিয়ানকে তুলে নিয়ে ১১ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল গত জানুয়ারি মাসে। তাদের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী মহিলা পুলিশ কমিশনার কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছিলেন।
এছাড়া সেকান্দরের ভাই মিন্টু একটি মাদক স্পট পরিচালনা করছে চকবাজার ঘাসিয়াপাড়ায়। পুলিশ সোর্স হিসেবে চকবাজার দাপিয়ে বেড়ায় নাছির ও সেকান্দর। জড়িত নানান অপরাধে। এলাকায় মাদক কারবারিদের থেকেও পুলিশের নামে রীতিমতো অর্থ আদায় করার অভিযোগ আছে তাদের বিরুদ্ধে।
এসব অপরাধীরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারিতে রয়েছেন বলে জানিয়েছেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।