নিয়মবহির্ভূতভাবে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) দুই সিন্ডিকেট সদস্যকে বাদ দেওয়ার অভিযোগ ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য অধ্যাপক ড. শূচিতা শরমিন এর বিরুদ্ধে। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই গত ৬ ফেব্রুয়ারি ৪৯ তম একাডেমিক কাউন্সিলের মিটিংয়ে তাঁদের (সিন্ডিকেট সদস্য) বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। উপাচার্য ওই দুই সদস্যকে শিক্ষার্থীদের দাবির কথা উল্লেখ করে (স্বৈরাচারের দোসর আখ্যা) এককভাবে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন বলে জানান একাধিক শিক্ষক। সদ্য অপসারণ হওয়া দু’জন সিন্ডিকেট সদস্য হলেন- গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোঃ ফরহাদ উদ্দীন এবং সমাজকর্ম বিভাগের প্রভাষক মোস্তাকিম মিয়া।
এদিকে অপসারণ হওয়া সিন্ডিকেট সদস্য সমাজকর্ম বিভাগের প্রভাষক মোস্তাকিম মিয়ার অভিযোগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত স্বৈরাচার আওয়ামী দোসর সাবেক ট্রেজারার কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) আবু হেনা মোস্তফা কামাল খানের বিরুদ্ধে কথা বলা ও সামনে থেকে আন্দোলন করায় উপাচার্য ব্যক্তিগত ক্ষোভে তাঁকে সিন্ডিকেট সদস্য থেকে বাদ দিয়েছেন। কারণ, সেনাবাহিনীর ওই সাবেক কর্মকর্তা ববি উপাচার্যের ঘনিষ্ঠজন ছিলেন বলে জানান তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী সিন্ডিকেট সদস্যদের দুই বছরের জন্য নির্বাচিত হলেও মাত্র নয় মাসের ব্যবধানে নিয়ম বহির্ভূতভাবে সিন্ডিকেট সদস্য থেকে দুই শিক্ষককে অব্যহতি দেয়া হয়েছে। গত বছরের ৩০ এপ্রিল ৪৪ তম একাডেমিক কাউন্সিলে সহকারী অধ্যাপক ক্যাটাগরি থেকে একজন ও প্রভাষক ক্যাটাগরিতে একজনকে আগামি দুই বছরের জন্য সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবে মনোনীত করা হয়েছিলো।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সূত্র বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছের লোককে নিয়োগ দিতেই দুজন সিন্ডিকেট সদস্যকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সিন্ডিকেট সদস্যদের বাদ দেয়ার উদাহরণ আছে বলে জানা নেই । ব্যক্তিগত ক্ষোভ বা অসন্তোষের জন্য যদি দু’জন সদস্যকে অপসারণ করা হয়,তাহলে সেটি সম্পূর্ণ নিয়মবহির্ভূত ও অবৈধ।
অপসারিত হওয়া সিন্ডিকেট সদস্য মোস্তাকিম মিয়া বলেন, আওয়ামী দোসর ও সেনাবাহিনীর সাবেক এক কর্মকর্তাকে ট্রেজারার হিসেবে নিয়োগ দিলে আমরা শিক্ষককেরা নিয়োগের বাতিল চেয়ে আন্দোলন করি। আমি সেই আন্দোলনে প্রথম সারিতে ছিলাম। সেজন্য উপাচার্যের সাথে আমার একবার বাকবিতন্ড হয়েছিলো। তাছাড়া সাবেক ওই সেনা কর্মকর্তা উপাচার্যের খুবই ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। সেজন্য আমার উপর ব্যক্তিগত ক্ষোভের কারণে বাদ দিছে। উপাচার্য মনে করেছেন আমরা হয়তো ভিসির ঘনিষ্ঠজন না,অন্যায় বা অনিয়ম করলে প্রতিবাদ করবো, সেজন্য আমাদের বাদ দেওয়া হয়েছে।
তিনি জানান, শুনেছি উপাচার্য শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে স্বৈরাচারীর দোসর হিসেবে আমাদের বাদ দিয়েছেন। কিন্তু আমরা তো শিক্ষার্থীদের বিপক্ষে ছিলাম না।তাছাড়া যদি এমনই হয়,তাহলে তো উপাচার্যকে আগে পদত্যাগ করা উচিত। কারণ তিনি নিজেই আওয়ামীর দোসর,যেটা সকল শিক্ষার্থীরা জানে। এমনকি কয়েকদিন আগে শিক্ষার্থীদের দাবিও ছিলো উপাচার্যের পদত্যাগের। শিক্ষার্থীদের মূল দাবি উপেক্ষা করে উপাচার্য স্বেচ্ছাচারিতা করছেন বলে অভিযোগ তোলেন তিনি।
একাডেমিক কাউন্সিলের একাধিক সদস্যের সাথে যোগাযোগ করে এই প্রতিবেদক। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা জানান, একাডেমিক কাউন্সিলে শিক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষিতে স্বৈরাচারের দোসরদের সিন্ডিকেট থেকে বাদ দেওয়ার কথা উল্লেখ করেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. শুচিতা শরমিন। তখন ওই দুই সদস্যকে বাদ দেওয়ার বিষয়ে উপাচার্য বাকিদের সিদ্ধান্ত জানতে চান এবং বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। যেহেতু এটি ক্রিটিকাল ব্যাপার ছিলো,স্বৈরাচারী দোসর ট্যাগ ছিলো তাই সবাই চুপচাপ উপাচার্যের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছিলেন। নাহলে বিপাকে পড়তে হতো বলে জানান তাঁরা।
তাঁরা আরও জানান, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের অন্যতম একটি দাবি ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটকে আওয়ামী দোসরমুক্ত করা।উপাচার্য গত পাঁচ মাসেও সেটি করতে পারেননি। পাঁচ মাস অতিবাহিত হয়ে গেলেও তিনি সিন্ডিকেট সভা ডাকতে পারেন নি। এতে শিক্ষক নিয়োগসহ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আটকে রয়েছে বলে জানান তাঁরা।
একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য ও কোস্টাল স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. হাফিজ আশরাফুল হক বলেন, তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। তিনি যে হিসাবে দুজনকে বাদ দিয়েছেন সাথে সাথেই তো শূন্যপদ পূরণ করার কথা। অথচ তিনি এটি না করে বলেছেন এটা নিয়ে পরে ভাববেন। এ থেকে বোঝা যায়, এটি উপাচার্যের স্বেচ্ছাচারিতা ছাড়া কিছুই নয়।
তিনি জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন দপ্তরে এমনকি উপাচার্যের নিজ দপ্তরেও স্বৈরাচারের দোসরদের দিয়ে চলছে। সেখানে কোন সমস্যা হচ্ছে না? নিজের কাছের লোক স্বৈরাচার হলে সমস্যা নেই কিন্তু বিরোধী মতাদর্শের লোককে স্বৈরাচারের দোসর ট্যাগ দিয়ে অপসারণ করা হচ্ছে, এটা দুঃখজনক।
এবিষয়ে একাডেমিক কাউন্সিলের সচিব ও বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মোঃ মনিরুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে একটি সূত্র বলছেন,যখন উপাচার্য মহোদয় দু’জন সদস্যকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্তে মতামত জানতে চাইলেন, তখন কেউই তো কোন কথা বলেনি। সেখানে তো বিভিন্ন বিভাগের ডিন ও চেয়ারম্যানবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
এসকল বিষয় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শুচিতা শরমিন’কে একাধিকবার মুঠোফোনে কল করলেও তিনি সাড়া দেননি।এমনকি তাঁকে ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও প্রত্যুত্তর পাওয়া যায়নি।