আবু নোমান : কেরানীগঞ্জের বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চলে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. নুর মোহাম্মদ উচ্চ বিদ্যালয়। ধলেশ্বরী নদীর তীর ঘেঁষে কেরানীগঞ্জের কলাতিয়া ও হযরতপুর ইউনিয়নের জনবিচ্ছিন্ন পাঁচটি গ্রাম হচ্ছে চর চামারদহ, চর খাড়াকান্দি, হোগলাগাতি, মধুরচর ও দক্ষিণ ঢালিকান্দি। এই পাঁচটি গ্রামে প্রায় ১৫ হাজার মানুষের বসবাস। গ্রামগুলোতে দুইটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও স্বাধীনতার ৫১ বছর ধরে ছিলো না কোন মাধ্যমিক বিদ্যালয়। বিচ্ছিন্ন এই গ্রামগুলোর শিক্ষার্থীদের আশার আলো দেখাচ্ছে বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. নুর মোহাম্মদ উচ্চ বিদ্যালয়ে। বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা হওয়ায় এখন থেকে আর ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা করে ধলেশ্বরী নদী পাড়ি দিয়ে কেরানীগঞ্জের কলাতিয়া উচ্চ বিদ্যালয় ও তালেপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে যেতে হবেনা। এবছর বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন কেরানীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ। তিনি নিজ অর্থায়নে পাঁচ বিঘা জমি কিনে টিনশেডের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি নির্মাণ করেন। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবিদ হোসেন বলেন, গত ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে এই পর্যন্ত ৮০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে। বিদ্যালয়ে শিক্ষক রয়েছেন ১০ জন। বিদ্যালয়টি ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠদান করা হবে। তিনি আরও বলেন, ধলেশ্বরী নদীর তীরে এই পাঁচ গ্রামের মধ্যে কোন মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিলো না। আমাদের উপজেলা চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদের প্রচেষ্টা ও আর্থিক সহযোগিতায় পাঁচ বিঘা জমি কিনে টিনশেডের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা হয়। ইতোমধ্যে এটিকে আধুনিক মানসম্মমত বিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তোলার জন্যে নকশা প্রণয়ন করা হয়েছে। বেসরকারি কলেজের শিক্ষার্থী রুপম হাসান জানান, আমাদের গ্রামে কোন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিলো না। আমাদের গ্রামের ছেলে মেয়েরা নবাবগঞ্জ ও ধলেশ্বরী নদী পার হয়ে কলাতিয়া হাই স্কুল অথবা তালেপুর উচ্চ বিদ্যালয় গিয়ে পড়াশুনা করে। তিনি আরও জানান, যদি সড়কপথে বিদ্যালয় যেতে হয় তবে সিএনজি অটোরিকশাযোগে প্রায় ৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে কেরানীগঞ্জের রোহিতপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে যেতে হয়। এছাড়া নদীপথে খেয়ানৌকা বা ট্রলারযোগে ধলেশ্বরী নদী পাড়ি দিয়ে তিন কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে কলাতিয়া উচ্চ বিদ্যালয় অথবা দুই কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে তালেপুর হাই স্কুলে যেতে হচ্ছে। আমাদের গ্রামে মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হওয়ায় এখন থেকে শিক্ষার্থীদের আর কষ্ট করে নদী পাড়ি দিয়ে যেতে হবে না। হোগলাকান্দি গ্রামের বাসিন্দা রোকসানা আক্তার জানান, স্বাধীনতার পরে এখানে কোন মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। আমার জন্মের পর থেকে কোন মাধ্যমিক বিদ্যালয় হতে দেখিনি। এই গ্রামগুলোতে কেরানীগঞ্জ উপজেলাধীন দুইটি ও নবাবগঞ্জ উপজেলাধীন একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। তিনি আরও বলেন, এই গ্রামের শিক্ষার্থীরা ঝড় বৃষ্টি মাথায় নিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নদী পার হয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেত। উক্ত বিদ্যালয় আমাদের গ্রামে জ্ঞানের আলো ছড়াবে। সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থী শম্পা আক্তার জানান, আমি চর চামারদহ প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণী পাস করেছি। এবছর বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. নুর মোহাম্মদ উচ্চ বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছি। এখন আর কষ্ট করে সেখানে যেতে হবে না। বাড়ির পাশে বিদ্যালয় আমরা ভীষণ খুশি। অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থী ও চরচামারদহ গ্রামের বাসিন্দা ফিরোজ মিয়া জানান, আমাদের কোন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিলোনা। নতুন খাড়াকান্দি স্কুল থেকে পঞ্চম শ্রেণী পাস করেছি। কলাতিয়া হাই স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিলাম। গত দুই বছর বাসা থেকে স্কুলে যাতায়াত করতে অনেক কষ্ট পোহাতে হয়েছে। ভয়ে ভয়ে নৌকা নদী পার হতাম। নদীতে ঢেউ বেশি থাকলে আতংকে থাকতাম। বর্ষাকালে অনেক সময় বিদ্যালয়ে যেতে পারতাম না। বিদ্যালয় হওয়াতে আমরা অনেক আনন্দিত। এখন আর আগের মতো কষ্ট করতে হবেনা। কেরানীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ বলেন, ধলেশ্বরী নদীর তীর ঘেঁষে কেরানীগঞ্জের ছিটমহল বলে খ্যাত পাঁচটি গ্রামে শিক্ষার্থীদের ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ২০০ থেকে ২৫০ শিক্ষার্থীর ধলেশ্বরী নদী পাড়ি দিয়ে কেরানীগঞ্জের কলাতিয়া উচ্চ বিদ্যালয় ও তালেপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে যেতে হতো। স্বাধীনতার পর এখানে কোন মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়নি। তাদের কষ্টের কথা চিন্তা করে পাঁচ বিঘা জমি কিনে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছি। পাঁচ গ্রামের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং শিক্ষার্থীরা যাতে ঝড়ে না পরে সেই জন্যে নিজস্ব অর্থায়নে আমার বাবার নামে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেছি। বিদ্যালয়টিকে ক্রমেক্রমে আরো উন্নত ও দৃষ্টি নন্দন করা হবে। আমি আশাবাদী একদিন এই বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চলে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিবে বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা: নুর মোহাম্মদ উচ্চ বিদ্যালয়।