অষ্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী পনির যাচ্ছে বিদেশেও

অষ্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী পনির যাচ্ছে বিদেশেও

আতাউল গণি, অষ্টগ্রাম (কিশোরগঞ্জ) প্রতিনিধি : ভাটী বাংলার অপরূপ নৈস্বর্গীক অনিবন্দ্য সৌন্দর্যের লীলা ভূমি খ্যাত কিশোরগঞ্জের হাওর উপজেলা অষ্টগ্রাম। ইতিহাস ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ অষ্টগ্রাম নানা দিক থেকে বিখ্যাত। তন্মধ্যে অষ্টগ্রামের পনির সাড়ে তিনশত বছরের পুরানো মোঘল আমলের ঐতিহ্য লালন করে আসছে। পনিরের জন্যই অষ্টগ্রাম সারাদেশে সুখ্যাতি অর্জন করেছে।
কাঁচা দুধ মন্থন করে তৈরী এক প্রকার উপাদেয়, সম্পুর্ণ ভিন্ন স্বাদযুক্ত দানাদার জাতীয় এ পনির। একেবারে জিভে জল আসে। পুষ্টি ও স্বাদ গুণে দেশ বিদেশে সুখ্যাতি অর্জন করেছে এই পনির। দেশের সর্বোচ্চ স্থান বঙ্গভবন-গণভবন থেকে শুরু করে ভারতবর্ষের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানসহ সুদূর ইংল্যান্ড পর্যন্ত প্রশংসা অর্জন করেছে অষ্টগ্রামের পনির।
মহামান্য রাষ্ট্রপতি মোঃ আব্দুল হামিদের অত্যন্ত প্রিয় খাদ্য এ পনির। অষ্টগ্রামের এ পনিরের প্রশংসা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও।
প্রখ্যাত চিকিৎসাবিদ অধ্যাপক ডাঃ এম মজিবুল হক সমাচারকে বলেন, পনির অত্যান্ত গুন সমৃদ্ধ খাবার। পনিরে রয়েছে ক্যালসিয়াম, ফ্যাট, প্রোটিন। এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-এ, বি-১২ পাশাপাশি জিংক, ফসফরাস, রিবোফ্লাভিন। এছাড়াও ওমেগা-৩, ফ্যাটিএসিড, ভিটামিন কে-২ পাওয়া যায়। পনির হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়, দাঁত ও হাড় শক্ত করে। ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়, কোলেস্টরল কমায়, ক্যান্সার প্রতিরোধ করে এবং ওজনের সামঞ্জস্য বজায় রাখে।
বিভিন্ন তথ্যসূত্রে জানা যায়- অষ্টগ্রামে বিস্তীর্ণ হাওর এলাকায় আগে অনেক জমি অনাবাদী থাকত এবং সেখানে প্রচুর ঘাস হতো। এ ঘাসের মধ্যে অত্যন্ত প্রোটিন সমৃদ্ধ ও পুষ্টিকর এক প্রকার ঘাস জন্মাত যাকে স্থানীয় ভাষায় ‘চাইল্যা’ বলা হতো। দুধ উৎপাদনে অত্যন্ত সহায়ক এ চাইল্যা ঘাস। সুপ্রাচীনকাল থেকেই অষ্টগ্রাম ও এর আশে পাশের কৃষকগণ হাল চাষসহ কৃষি কাজের জন্য প্রচুর মহিষ পালন করতেন। হওরের প্রত্যেক কৃষকের ছিল গোয়াল ভরা গরু-মহিষ, গোলা ভরা ধান। পাশাপাশি মহিষের খামারও ছিল প্রচুর। কিশোরগঞ্জ, নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার কৃষকগণও শুকনো মৌসুমে এ হাওরে এসে মহিষের খামার দিত, যাকে স্থানীয় ভাষায় ‘বাতান’ দিত বলা হয়। হাওরে বিচরণ করা এ গরু-মহিষ দুগ্ধ উৎপাদন সহায়ক ঘাস খাওয়ার ফলে প্রচুর দুধ পাওয়া যেত, যা খেয়ে বা স্থানীয় হাটে বিক্রয় করে শেষ করা যেত না। হাওরের যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্গম থাকায় উদ্বৃত্ত এ দুধ বাজারজাত করণের জন্য এলাকার বাইরে পাঠানো যেত না। ফলে বাধ্য হয়েই মণ মণ দুধ ফেলে দিতে হতো। হয়তো সে কারণেই পনির তৈরীর মাধ্যমে এ দুধ সংরক্ষণের বিষয়টি কারোও মাথায় আসে।
কথিত আছে-এ অঞ্চলে যখন দুধের এ বিশাল সমারোহ, ঠিক তখনই শুরু হয় ঈশাখা-মানসিংহের যুদ্ধ। যুদ্ধের এক পর্যায়ে মোঘল সেনারা এসে অষ্টগ্রামের কাস্তুলে ও পাশ^বর্তী বিভিন্ন এলাকায় ছাউনী গড়ে তুলেন এবং পরবর্তীতে অষ্টগ্রামে মোঘল বংশধর ও দত্ত বংশীয় অভিজাত শ্রেণির বসতী গড়ে ওঠে।
জনশ্রুতি আছে- একদিন কোন এক মোঘল পাঠান বিস্তীর্ণ হাওরে গিয়ে গরু-মহিষের বিশাল পাল দেখে বিস্মিত হন এবং বিপুল পরিমাণ দুধের উৎপাদন তার চোখে পড়ে। ওই সময় স্থানীয়দের দুগ্ধজাত খাদ্যদ্রব্য তৈরী করতে দেখে তিনিও তাতে হাত লাগান এবং একদিন নিজের অজান্তেই দুধের ছানা দিয়ে এক ধরনের নতুন খাবার তৈরী করে বসেন। পরবর্তীতে এর নাম রাখা হয় পনির। আবার অনেকে মনে করেন মোঘলদের উত্তরসূরী কোন এক দেওয়ানের নাম ছিল পনির খা’ তার নামানুসারে এ খাবারের নাম রাখা হয় পনির। তাছাড়া দত্ত বংশীয় অভিজাত শ্রেণি এ দেশে আগমনের সঙ্গে পনির উৎপাদনের যোগসূত্র থাকতে পারে বলেও অনেকে ধারণা করেন।
অষ্টগ্রামে পনির তৈরীর বর্তমান হালচিত্র জানতে অষ্টগ্রাম শাহ কুতুব মসজিদ পাড়া গিয়ে দেখা যায়-রাস্তার পাশে দু’চালা টিনের তৈরী একটি ছোট ঘরের বেড়ায় ভাই বোন পনির আড়ৎ খচিত ছোট একটি ব্যানার ঝুলছে। দরজায় টানানো কাপড়ের পর্দার ফাঁক দিয়ে উকি দিতেই দেখা যায় ভিতরে ৭০ বছর বয়সী এক বৃদ্ধ পনির তৈরীতে ব্যস্ত। সাংবাদিক জেনে অনেক সখ্যতা করে ভিতরে বসতে দেন। একে একে ৭০ বছর বয়সী তোরাব আলীর কাছ থেকে জানা যায় পনির তৈরীর ইতিহাস।
তিনি জানান ৫০ বছর যাবত পনির তৈরী করছেন। এর পূর্বে তার বাবা-চাচাও পনিরের ব্যবসা করতেন। তবে পূর্বের তুলনায় বর্তমানে পনিরের কদর বেশি। পূর্বে যাতায়াতের অসুবিধার কারণে পনির বাইরে বিক্রি করা যেত না। বর্তমানে তার তৈরী পনির ঢাকা-সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় অভিজাত শ্রেণির লোকজন সংগ্রহ করে থাকেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি মোঃ আব্দুল হামিদ মহোদয়ের অসংখ্য উন্নয়ন মূলক কাজের একাংশ যা ইতিমধ্যে নেট দুনিয়ায় দেশ-বিদেশে ভাইরাল অষ্টগ্রাম-মিঠামইন-ইটনা অলওয়েদার রাস্তা। সেখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঘুরতে আসা অগণিত পর্যটক তার এ পনির ক্রয় করে থাকেন। তিনি আরও জানান-আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে চাহিদানুযায়ী পন্য সরবরাহ করতে পারছেন না। দিন দিন এ পনিরের কদর এবং চাহিদা দেশ-বিদেশে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এ শিল্পকে আরও প্রসারিত করা যাবে এবং অপার সম্ভাবনার দিকে নেওয়া যাবে। জানা যায় অষ্টগ্রামে প্রায় অর্ধশতাধিক পরিবার এ পেশায় জড়িত।
তবে বর্তমান কৃষি ব্যবস্থা পশু নির্ভর না হয়ে আধুনিক যান্ত্রিকায়ন হওয়ায়, চারণভূমি কমে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে হাওরের কৃষকের গরু-মহিষ পালন পূর্বের তুলনায় অনেকাংশে কমে গেছে। ফলে পনির তৈরীর উপজাত দুধ উৎপাদনও কমে গেছে। দুধের দাম বেশি হওয়ায় পনির উৎপাদন খরচ বেশি হয়। জানা যায়-১ কেজি পনির তৈরী করতে ১১লিটার দুধ লাগে। সে হিসাবে প্রতি কেজি পনিরের দাম পড়ে ৭০০-৮০০টাকা। পনির তৈরীর পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান- প্রথমে বড় পাত্রে কাঁচা দুধ ঢালা হয়। এরপর কাঁচা দুধের ছানা পানি যাকে স্থানীয় ভাষায় মাওয়া বা জুরান বলা হয়। তাতে পরিমাণ মত মাওয়া বা জুরান মিশানো হয়। এতে কিছুক্ষণের মধ্যেই দুধ জমাট বেঁধে ফেলে। তখন হাত দিয়ে এবং বাঁশের চিকন চিতা দিয়ে এ ছানা কেটে ছোট ছোট করে দানার মত করা হয়। তারপর সেই দানা আস্তে আস্তে তোলে বাঁশের তৈরী ছোট ছোট বাটি সদৃশ টুকরিতে চেপে চেপে রাখা হয়। এতে টুকরির ফাক দিয়ে চুইয়ে পানি পড়তে থাকে। ছানা টুকরী সদৃশ দলা বাঁধে এবং দলার গায়ে টুকরির ডুরা ডুরা দাগ পড়ে। পানি জড়া শেষ হলে পনিরের ভিতর ছোট ছোট ছিদ্র করে তাতে লবণ প্রবেশ করানো হয়। শেষে চাপ দিয়ে পনিরের চুড়ান্ত আকার দেওয়ার পর তা বাজারজাত করা হয়। পরিশেষে তোরাব আলী এ শিল্পকে প্রসারিত করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সদয় দৃষ্টি কামনা করেন।

Leave a reply

Minimum length: 20 characters ::

More News...

সারা দেশে ‘হিট স্ট্রোকে’ ৮ জনের মৃত্যু

কারাগারেও মাদকের আখড়া