জাতির পিতা হত্যার সশস্ত্র প্রতিবাদকারী প্রতিরোধযোদ্ধারা স্বীকৃতি পাক

জাতির পিতা হত্যার সশস্ত্র প্রতিবাদকারী প্রতিরোধযোদ্ধারা স্বীকৃতি পাক

অধ্যাপক ড. মো. আবুল হোসেন :  ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঠিক ফজরের নামাজের সময় ধানমণ্ডির বত্রিশ নং সড়কের বাড়িতে ইতিহাসের কলঙ্কতম অধ্যায় রচিত হয়। ১৫ আগস্টের ভোরে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বাংলাদেশের স্থপতি বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজ বাসভবনে সেনাবাহিনীর কতিপয় সদস্যের হাতে নিহত হন। সেদিন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী মহীয়সী নারী বেগম ফজিলাতুন নেছা, বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র মুক্তিযোদ্ধা লেঃ শেখ কামাল, পুত্র লেঃ শেখ জামাল, কনিষ্ঠ রাসেল রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, ভগ্নিপতি ও কৃষিমন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও তার কন্যা বেবি সেরনিয়াবাত, আরিফ সেরনিয়াবাত, দৌহিত্র সেরনিয়াবাত, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবনেতা ও সাংবাদিক শেখ ফজলুল হক মনি ও তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি, বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা অফিসার কর্নেল জামিল আহমেদ, নঈম খান রিন্টুসহ পরিবারের ১৬ জন সদস্য ও আত্নীয়স্বজনকে ঘাতকরা হত্যা করে। অনেকেই আশা করেছিল এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ হবে। কিন্তু শীর্ষস্থানীয় নেতাদের অধিকাংশই আত্মগোপন করেন ( রহমান,২০১৯:৩)। তৎকালীন সেনা, বিমান, নৌবাহিনী প্রধান, বিডিআরের মহাপরিচালক, পুলিশের আইজিসহ সরকারি সব বাহিনীর প্রধান গিয়ে একে একে খুনিদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। জাতীয় চার নেতা তাজউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, এএইচএম কামরুজ্জামান এবং তোফায়েল আহমদ, আবদুর রাজ্জাকসহ যারা মোশতাকের সঙ্গে হাত মেলালেন না, ২২ আগষ্ট ১৯৭৫ -এর মধ্যে তাদের যেতে হল কারাগারে। ১৫ আগষ্টের পরদিন মোশতাকের মন্ত্রীসভায় অধিকাংশ আওয়ামী লীগ মন্ত্রীর যোগদানে সাধারণ নেতাকর্মীরা দিকভ্রান্ত, হতাশ ও ভীত সস্ত্রস্ত হয়ে পড়ে ( হাননান, ১৯৯৮: ২১-২২)।
এসব দেখে হতাশ হয়ে পড়েন সারা দেশের অগণিত মুজিবভক্ত। ছাত্রলীগ, যুবলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা কিছু একটা করার জন্য তৎপর হয়ে ওঠেন। নিজেদের মধ্যে তারা যোগাযোগ শুরু করেন। ২২ আগষ্ট টাঙ্গাইলে তৎকালীন জেলা গভর্ণর বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম ছয়জন সঙ্গী নিয়ে জামালপুর সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। সেখানে গিয়ে বঙ্গবন্ধুহত্যাকারী অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধের ডাক দেন, গড়ে তোলেন ‘জাতীয় মুক্তিবাহিনী’ ৭৫ (প্রতিরোধযোদ্ধা) জাতির পিতাকে হারানোর শোকে মূহ্যমান একজন বীরযোদ্ধা জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েন গেরিলাযুদ্ধে।
১৫ আগস্টের শোককে শক্তিতে পরিণত করে রাজনৈতিকভাবে পিতা মুজিব হত্যার বদলা নেয়া এবং হত্যার বিচারের দাবিতে দৃপ্ত শপথে বলীয়ার হয়েছিলেন জাতীয় মুক্তিবাহিনীরা। এদের বেশীর ভাগই অজগড়া গাঁয়ের খেটে খাওয়া মানুষ। যাদের অন্থিমজ্জায়, রক্তে, চিন্তায়, চেতনায় বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কিছু নেই। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় অংশগ্রহণকারী, মুক্তিযুদ্ধের চিরঞ্জীব আদর্শ-চেতনা, বোধ-বিবেচনা-বিশ^াসে উদ্বুদ্ধ এবং অঙ্গীকারে দীপ্ত। কারো কারো মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্র বুকে যুদ্ধ করার বিপুল অভিজ্ঞতা আছে যা ভয়ঙ্করভাবে প্রত্যক্ষজ্ঞানে মণ্ডিত। রণাঙ্গনে প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর হাতছানি তাঁদের তাড়িত করেছে; সেখানে একমাত্র অবলম্বন ছিল অসীম সাহস, প্রতুৎপন্নমতিত্ব এবং সদ্য অবিচলিত (বিশ্বাস, ২০১৭)।
মেঘালয় সীমান্তের অভ্যন্তরে ঘন বনাঞ্চল ঘেরা দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল চান্দুভুঁইতে গড়ে উঠে সদর দপ্তর, এবং উক্ত দপ্তরে বসে পুরোটা সময় সর্বাধিনায়কের নেতৃত্ব দেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। প্রশাসনিক কাজের সুবিধার জন্য জাতীয় মুক্তিবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ে কতকগুলো বিভাগ/দপ্তর সৃষ্টি করা হয়েছিল। সেগুলো হলো অতিথি (মঁবংঃ) ব্যারাক, নিরাপত্তা পপ্তর, গোয়েন্দা বিভাগ, গার্ড রেজিমেন্ট, অ্যাডজুট্যান্টের দপ্তর, অর্থ দপ্তর, কোথ (অস্ত্রাগার), প্রচার বিভাগ, কোয়ার্টার গার্ড (কারা বিভাগ), কেন্দ্রীয় স্টোর, চিকিৎসাকেন্দ্র ইত্যাদি। ৩৬ জন কমান্ডারের অধীনে প্রায় ১৭ হাজার প্রতিরোধযোদ্ধা অংশগ্রহণ করেন। জাতীয় মুক্তিবাহিনীর প্রধান সদর দপ্তরের বাইরে অনেক ক্যাম্প ও ডিফেন্স গড়ে তোলা হয়েছিল। কাদের সিদ্দিকীর নির্দেশে সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, শেরপুর, জামারপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট জেলার বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অনেকগুলো ক্যাম্প ও ডিফেন্স স্থাপন করা হয়েছিল। সেসব ক্যাম্প বা ডিফেন্স হতে জাতীয় মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা পরিচালনা করা হতো। ১৯৭৫ সনের আগষ্টের পর থেকে ১৯৭৮ সন পর্যন্ত সময়কালে ভারতের চান্দুভঁই, ভবানীপুর, বেতগড়া থেকে শুরু করে বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলে এই প্রতিরোধের ক্যাম্প গড়ে উঠে।

এ যুদ্ধ শুধু প্রতীকী যুদ্ধ ছিল না, বরং ময়মনসিংহ, শেরপুর, নেত্রকোনা জেলার সীমান্তবর্তী অনেক বড় এলাকা দখল করে নিয়েছিলেন জাতীয় মুক্তিবাহিনী ১৯৭৫ থেকে শুরু হয়ে ১৯৭৮ পর্যন্ত সংগঠিত এ প্রতিরোধযুদ্ধে অনেকেই শাহাদত বরণ করেন। শহীদ হয় ১০৪ জন।
প্রতিরোধযুদ্ধের মূল নেতৃত্বে থাকা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর বরাত দিয়ে সাঈদুর রহমান রিমন আরো লিখেন যে, জাতীয় মুক্তিবাহিনী সীমান্তবর্তী এলাকার পাঁচটি বিডিআর ক্যাম্প ও দ’ুটি থানা দখল করেছিলেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে একাধিকবার সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন তাঁরা। তাঁরা টহল পুলিশ ও বিডিআরের ওপর বিচ্ছিন্ন হামলা পরিচালনার মাধ্যমে কব্জা করতে থাকেন আগ্নেয়াস্ত্র। এসব খন্ডযুদ্ধের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো হালোয়াট যুদ্ধ, বারোমারী (নালিতাবাড়ী) যুদ্ধ ধানুয়া কামালপুর (জামালপুর) যুদ্ধ, পাথরের চর (ধানুয়া কামালপুর) যুদ্ধ, কলমাকান্দা থানা অপারেশন, কলাপাড়া (আটপাড়া) যুদ্ধ. পাথরের চরদিয়া ডার (দেওয়ানগঞ্জ) অপারেশন, বারহাট্টা থানা অপারেশন, নিশ্চিন্তপুর (কাজিপুর, সিরাজগঞ্জ) যুদ্ধ, হলদি গ্রাম (শ্রীবরদী) যুদ্ধ, ডেফুলিয়া পাড়া (ধোবাউড়া) যুদ্ধ, কাওয়ানি (মধ্যনগর) যুদ্ধ অন্যতম। সে সময় যে কয়েকটি খন্ড যুদ্ধ সংগঠিত হয় তার মধ্যে নেত্রকোনা অঞ্চলের খলাপাড়া যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য। একের পর এক থানা ও বিডিআর ক্যাম্প দখল করে জাতীয় মুক্তিবাহিনী বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ ছড়িয়ে দিয়েছিলেন বিশ^জুড়ে। জাতীয় মুক্তিবাহিনী কলমাকান্দা থানা আক্রমন করে থানার ওসিকে সস্ত্রীক তাদের কব্জায় নিয়ে গেলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এ খবর ঠাঁই পেতে থাকে।

এ সম্পর্কে সাঈদুর রহমান রিমন বাংলাদেশ প্রতিদিনের বিভিন্ন সংখ্যায় লিখেন,অনুসন্ধানে দেখা যায়, প্রতিরোধযুদ্ধ ১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বরে শুরু হয়ে স্থায়ী হয় ’৭৭ সালের জুলাই পর্যন্ত। তবে প্রতিরোধযুদ্ধের সেক্টর হেডকোয়ার্টার ও সাব সেক্টরগুলোয় অবস্থান নেওয়া যোদ্ধাদের শেষ দলটি অস্ত্র ত্যাগ করে ’৭৮ সালের এপ্রিলে। পরবর্তী প্রত্যেকটি সরকারের আমলেই প্রতিরোধযোদ্ধারা রোশনলের অসহায় শীকারে পরিনত হয়েছেন, জেল জুলুম নির্যাতনে পৃষ্ঠ হয়েছেন। এ সম্পর্কে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বলেন,মোশতাক ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদী প্রতিরোধযোদ্ধাদের দুস্কৃতিকারী ঘোষণা করে যেখানে যাকে পেয়েছে গ্রেফতার করেছে। যোদ্ধাদের না পেলে তাদের আত্নীয়স্বজন, বাবা মাকে অত্যাচার করেছে, সীমান্তে বাড়ি ঘর, জমি জমা বাজেয়াপ্ত করেছে। মেজর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইর সঙ্গে চুক্তি করে প্রায় ৬ হাজার প্রতিরোধযোদ্ধাকে নানা জেলে, নানা ক্যাম্পে আটক করে রেখেছিল। অনেক জাতীয় মুক্তিবাহিনীকে জেলে পাঠিয়ে দেয়া হয় এবং অনেককে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে পঙ্গু বানানো হয় (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২০২০, পৃষ্ঠা ০৪)। উপজাতি যোদ্ধাদের জায়গা জমি সরকারের প্রভাবশালী মহল দখল করে তাঁদেরকে রিক্ত, নিঃস্ব, সর্বহারা করে দেয়া হয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে প্রতিরোধযুদ্ধের চার যুগ পরও গণ-মানুষের অবদানের স্বীকৃতি যেমন মেলেনি, তেমনি তাদের অবদানের ইতিহাসও লেখা হয়নি।
প্রতিরোযোদ্ধারা বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী দুঃসময়ের সেই ঐতিহাসিক জটিল রক্তাক বাঁকে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর হত্যার বদলা নেওয়ার জন্য, বাঙালি জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করার জন্য, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-আদর্শ ও গণতান্ত্রিক ধারাকে সমুন্বত রাখার স্বার্থে খুনিদের চক্রের বিরুদ্ধে যে সশস্ত্র প্রতিবাদ প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু করেছিলেন তা ছিল এক ঐতিহাসিক রাজনৈতিক যুদ্ধ। এই সশস্ত্র রাজনৈতিক যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশে পুনরায় বঙ্গবন্ধুর নাম সগৌরবে উচ্চারিত হয় এবং পরবর্তীতে আওয়ামী লীগে দলীয় ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পথ সুপ্রশস্ত হয়। বিচারপতি খায়রুল হক প্রদত্ত পঞ্চম সংশোধনী মামলা রায়ে মোস্তাক, সায়েম এবং জিয়াকে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে সাব্যস্ত করে যে ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত প্রদান করা হয তাতেও প্রতিরোধ যোদ্ধাদের যুদ্ধকালীর দর্শনের প্রতিধ্বনি এবং সেই যুদ্ধের যথার্থতা প্রতীয়মান হয়। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পরে যাঁরা পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে জীবন বাজি রেখে প্রতিরোধযদ্ধে গিয়েছেন, সম্পদ হারিয়েছেন, সম্ভম হারিয়েছেন, সর্বোপরি যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন তাঁদের এই ত্যাগকে মূল্যায়িত করা আজ সময়ের দাবি।
পরিচালক সেন্টার ফর সোশ্যাল সাইন্স রিসার্চ এন্ড ট্রেনিং, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, সভাপতি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় নীলদল।

Leave a reply

Minimum length: 20 characters ::

More News...

সারা দেশে ‘হিট স্ট্রোকে’ ৮ জনের মৃত্যু

কারাগারেও মাদকের আখড়া