ব্যাংক কর্মকর্তা মোরশেদ চৌধুরীর মামলা তদন্তে পিবিআই

ব্যাংক কর্মকর্তা মোরশেদ চৌধুরীর মামলা তদন্তে পিবিআই
চট্টগ্রাম: নগরের ব্যাংক কর্মকর্তা আব্দুল মোরশেদ চৌধুরীর আত্মহত্যা প্ররোচনার মামলা থানা পুলিশ ও ডিবির হাত ঘুরে এখন এসেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এর হাতে।  এর আগে ডিবি পুলিশ মামলার তদন্তভার পেয়ে আসামি পারভেজ ইকবালের প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক মো. আরাফাতকে গ্রেফতার করে।পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা  জানান, ব্যাংক কর্মকর্তা আব্দুল মোরশেদ চৌধুরীর আত্মহত্যার প্ররোচনা মামলাটি পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশে পিবিআইয়ের কাছে হস্তান্তর এবং নথিপত্র বুঝিয়ে দেওয়ার হয়েছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে পরিদর্শক কামরুল ইসলামকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।  পিবিআই সূত্রে জানা যায়, গত ৫ মে বাংলাদেশ পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল (আইজি) ড. বেনজির আহমেদ বরাবর আব্দুল মোরশেদ চৌধুরীর আত্মহত্যার প্ররোচনার মামলার দায়িত্ব পিবিআইকে হস্তান্তরের জন্য আবেদন করেন মামলার বাদি ইশরাত জাহান। আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ২০ মে মামলার তদন্তভার পিবিআইকে হস্তান্তর করেন আইজি ড. বেনজির আহমেদ। গত ২৭ মে এ সংক্রান্ত অফিস আদেশ পেয়েছে পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো।  গত ৭ এপ্রিল ভোরে নগরের পাঁচলাইশ থানাধীন মিমি সুপার মার্কেট সংলগ্ন হিলভিউ আবাসিক এলাকায় নাহার ভবনের ছয়তলার একটি ফ্ল্যাট থেকে ওই ব্যাংক কর্মকর্তার ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তিনি পূর্ব মাদারবাড়ির বাসিন্দা আব্দুল মোমিন চৌধুরীর ছেলে। এ ঘটনায় গত ১১ এপ্রিল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ব্যাংক কর্মকর্তার আত্মহননের জন্য দায়ীদের গ্রেফতার ও শাস্তির দাবিতে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন আব্দুল মোরশেদ চৌধুরীর স্ত্রী ইশরাত জাহান চৌধুরী।এসময় তিনি অভিযোগ করেন, তার স্বামী ব্যবসার জন্য জাবেদ ইকবাল চৌধুরী, পারভেজ ইকবাল চৌধুরী এবং সৈয়দ সাকিব নাঈম উদ্দিনের কাছ থেকে বিভিন্ন দফায় ২৫ কোটি টাকা ধার নেন। বিপরীতে তাদের কাছে লাভসহ ৩৮ কোটি টাকা পরিশোধ করেন। কিন্তু বেশি লভ্যাংশের দাবিতে তার স্বামীর ওপর মানসিক চাপ, রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন। তাদের অনৈতিক চাপের কারণে তার স্বামী আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন। যার প্রমাণ মিলেছে রেখে যাওয়া সুইসাইড নোটে।  এ ঘটনায় পাঁচলাইশ থানায় যুবলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শহীদুল হক চৌধুরী রাসেল, চিটাগাং চেম্বারের সাবেক দুই পরিচালক জাবেদ ইকবাল, তার ভাই পারভেজ ইকবাল ও নাইম উদ্দিন সাকিব নামে চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে মামলা করা হলেও পুলিশ কোনো আসামিকে গ্রেফতার করতে পারেনি। এখন আসামিপক্ষ উল্টো মামলা তুলে নেওয়ার জন্য হুমকি দিচ্ছে।অভিযোগে জানা যায়, ২০১৯ সালের ২৯ মে জাতীয় সংসদের হুইপ শামসুল হক চৌধুরীর পুত্র নাজমুল হক চৌধুরী ওরফে শারুন চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে দুটি গাড়িতে করে আসামিরা ১০-১২ জন যুবকসহ ব্যাংকার আব্দুল মোরশেদের বাসায় আসেন। পারভেজ ইকবাল দলের অন্যদের নিয়ে লিফটে ওপরে উঠে বাসার দরজা ধাক্কাতে থাকেন। এ সময় দরজা খুলতে না চাইলে লাথি মারতে থাকেন তারা। নিজের ও শিশুকন্যার নিরাপত্তার জন্য দরজা খুলতে না চাইলেও দরজার অন্য প্রান্ত থেকে হুমকি দিয়ে পারভেজ ইকবাল দরজা খুলতে চাপ দিতে থাকেন। উত্তেজিত পারভেজ ব্যাংকারের স্ত্রীর উদ্দেশে বলতে থাকেন, ‘আমরা আপনাকে আটকে রেখে ওকে (মোরশেদ) আনবো। ’এ সময় ভবনটির নিচে নম্বর প্লেটবিহীন গাড়িতে হুইপপুত্র শারুন চৌধুরী ও বাচ্চু বসা ছিলেন বলে জানান ইশরাত জাহান চৌধুরী।তিনি বলেন, ‘২০১৮ সালের মে মাসে আমার স্বামীকে পাঁচলাইশের এমএম টাওয়ারে নিয়ে যায় সৈয়দ সাকিন সাঈম উদ্দীন। সেখানে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে শারীরিক নির্যাতন, আমাকে বেঁধে ১২ কোটি টাকা অতিরিক্ত দাবি করে জোরপূর্বক স্ট্যাম্পে সই নেওয়া হয়েছিল। আমার ও মেয়ের পাসপোর্ট নিয়ে নেওয়া হয়। ২০১৯ সালে বাসায় হামলার ব্যাপারে মামলা করা হয়। বাসায় আক্রমণ, মেয়েকে অপহরণ, আমার স্বামীকে খুন করবে বলে অনেকবার প্রকাশ্যে হুমকি দেওয়া হয়। আপোস ও আলোচনার কথা বলে গত ২০১৯ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর সাকিব অস্ত্রের মুখে ৮৪টি চেকে জোরপূর্বক সই নিয়ে নেয়। আমাদের ছয়টি অলিখিত ও স্বাক্ষরিত নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প রয়েছে তাদের কাছে। ’টাকা লেনদেন সংক্রান্ত বিষয়ে হুইপপুত্র শারুনের সম্পৃক্ততা বিষয়ে ইশরাত বলেন, শারুনের সঙ্গে সরাসরি আমার স্বামীর কোনো লেনদেন ছিল না। এরপরও শারুন চৌধুরী কেন সক্রিয় হন, এ ব্যাপারে জানতে মোরশেদই একদিন প্রশ্ন করেছিলেন। জবাবে শারুন বলেছিলেন, ‘সরাসরি লেনদেন আমি করিনি। পারভেজের মাধ্যমে বিনিয়োগ করেছি। ’ তবে এ বিনিয়োগ অবৈধ কোনো ব্যবসার জন্য কী-না তা অস্পষ্টই রয়ে গেছে।সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবেও চাপ দেওয়া হয়। নানামুখী চাপে ওই ব্যাংকার বাধ্য হয়ে আত্মহত্যা করেন।চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) বিজয় বসাক জানান, শারুন চৌধুরী জামানত বাবদ চেক গ্রহণের বিপরীতে ব্যবসায় পারভেজের মাধ্যমে বিনিয়োগ করেন এবং পারভেজকে তার পাওনা টাকার জন্য চাপ দেন। যেহেতু মোরশেদের কাছে সরাসরি পাওনাদার নন, সেহেতু এর আগে হওয়া সমঝোতা বৈঠকে শারুন চৌধুরীকে আসতে দেওয়া হয়নি।তিনি বলেন, ব্যাংক কর্মকর্তা আব্দুল মোরশেদ ও তার স্ত্রী বাসায় হামলার ঘটনায় জিডি করার পরই উভয়পক্ষের একাধিক সমঝোতা বৈঠক হয়। সমঝোতা অনুযায়ী দেনা পরিশোধ প্রক্রিয়া চলছিলো।ব্যাংকার আব্দুল মোরশেদ চৌধুরীর সঙ্গে বিনিয়োগ, টাকা উদ্ধার প্রক্রিয়ায় হুইপ পুত্র শারুনের এক সমঝোতা বৈঠকে উপস্থিত থাকার কথা জানান আত্মহননকারীর নিকটাত্মীয় ব্যবসায়ী আজম খান। তবে শারুন চৌধুরীর দাবি করেন, তিনি মোরশেদ চৌধুরীর বাসায় যাননি। যে গাড়িতে তিনি ছিলেন বলে দাবি করা হচ্ছে সেই গাড়ি তার নয়। যে ভিডিও প্রচার করা হচ্ছে সেটি ২০২০ সালে ধারণ করা। আর ঘটনার সময় বলা হচ্ছে ২০১৯ সাল।তিনি বলেন, ‘আমার সঙ্গে মোরশেদ চৌধুরীর একবার মাত্র ১০ মিনিটের জন্য দেখা হয়েছিল পাঁচলাইশ এলাকার আজম সাহেবের বাসায়। পারভেজ ইকবাল ও আমাদের বাসা হালিশহর এলাকায়। একই এলাকায় বাস করার সুবাদে আমার পূর্বপরিচয় আছে। সেই কারণেই আজম সাহেবের বাসায় গিয়েছিলাম। এর মধ্যে মোরশেদ চৌধুরীর সঙ্গে আজম সাহেবের বাসায় দেখা হয়। সেখানে পারভেজের সঙ্গে ব্যবসায়িক লেনদেন নিয়ে কথা হচ্ছিলো। তা শুনে আমি আর বাচ্চু ভাই চলে এসেছি। এরপর আর কখনোই দেখা হয়নি। ’ইশরাত জাহান চৌধুরী বলেন, ‘মিথ্যা পাওনার দাবিতে নাইম উদ্দিন সাকিব ও আমার স্বামীর বিরুদ্ধে আটটি মামলা করেছিল। অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় সব মামলায় আমি খালাস পেয়েছি। আমার স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগও খালাসের প্রক্রিয়ায় ছিল। সীতাকুণ্ডের এমপি মধ্যস্থতার চেষ্টা করলেও জাবেদ ইকবালের ভাই পারভেজের অনাগ্রহে সেই উদ্যোগ ভেস্তে যায়।ইশরাত জাহানের আত্মীয় আজম খান বলেন, ‘আমি মধ্যস্থতা করার পর সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় কোটি টাকা সুদসহ পরিশোধ হয়েছে। এরপর ৭ কোটি টাকা দাবি করছিলেন পারভেজ। মোরশেদ রাজিও ছিল। মৃত্যুর আগে ৭ এপ্রিল এক দফায় দুই কোটি টাকা লেনদেনের কথা হয়েছিল। এই টাকা ব্যাংকে ট্রান্সফার দেওয়ার বিষয়টিও নিশ্চিত করেছিলেন মোরশেদ’।

Leave a reply

Minimum length: 20 characters ::

More News...

হামাসের দাবি মানবে না ইসরায়েল: নেতানিয়াহু

মাদারীপুরে সড়ক দূর্ঘটনায় অজ্ঞাত এক ব্যক্তি নিহত