অনুপ বালো : গম আমদানি দূর করতে সারাদেশে গম আবাদে কৃষকদের আগ্রহ বাড়ছে। বর্তমানে দেশে গমের চাহিদা ৩৫ থেকে ৪০ লাখ টন। উৎপাদন হয় ১০ থেকে ১২ লাখ টন। চলতি মওসুমে দেশে গমের উৎপাদন ১৪ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে। কৃষি বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত নতুন জাতের বীজ ব্যবহার করে দেশে গমের উৎপাদন প্রতিবছর বেড়েই চলেছে।
এছাড়া আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে গম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ১৭ লাখ টনে পৌঁছাতে বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের কৃষি বিজ্ঞানীরা নতুন নতুন জাতের গমবীজ উদ্ভাবনে গবেষণার কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন।
জানা গেছে, গত বছর সর্বশেষ গম উৎপাদনের পরিমাণ ছিল সাড়ে ১২ লাখ টন। চাহিদার সিংহ পরিমাণ গমই আমদানি করতে হয় বিভিন্ন দেশ হতে। গমের চাহিদা মেটাতে প্রতি বছর ২৫ থেকে ৩০ লাখ টন বিদেশ থেকে আর আমদানি করতে না হয় এ লক্ষ্যে গম আবাদের উপর জোর দেয় কৃষি মন্ত্রণালয়। চলতি মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অতিরিক্ত ৩৮ হাজার হেক্টর জমিতে গম আবাদ হয়েছে। যেখানে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৮৮ হাজার হেক্টর জমি। আর আবাদ হয়েছে ৫ লাখ ২৬ হাজার হেক্টর জমিতে। কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. এছরাইল হোসেন জানান, মুজিব শতবর্ষকে ঘিরে নতুন দু’টি তাপসহিঞ্চু উচ্চ ফলনশীল গমবীজ উদ্ভাবনসহ দেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দিনরাত গবেষণার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিবছরই দেশে বাড়ছে গম আবাদের জমির পরিধি। তবে চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত বীজ সরবরাহ করতে পারছেন না তারা। প্রজনন বীজ উৎপাদনের জন্য আরও বেশি জমির প্রয়োজন। প্রজনন বীজ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় জমির চাহিদাপত্র ইতিমধ্যে কৃষি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। গবেষণা স্টেশনে জমির স্বল্পতার কারণে টিএলএস উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে কৃষকের জমি ব্যবহার করা হচ্ছে।
মহাপরিচালক জানান, ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত গম ক্ষেতের প্রধান শত্রু ব্লাষ্ট রোগ প্রতিরোধ সক্ষম ডাব্লিউএমআরআই গমবীজ-২ ও ডাব্লিউএমআরআই গমবীজ-৩ কৃষকদের মাঝে ইতিমধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে। এ জাতের গমবীজ জমিতে ব্যববার করে কৃষকরা প্রতারিত হচ্ছেন না। এ বীজে গম গাছ অপেক্ষাকৃত খাটো, রোগ-বালাই প্রতিরোধ ও তাপসহিঞ্চু ক্ষমতা বেশি। ফলনও পাওয়া যাবে হেক্টর প্রতি সাড়ে ৪ হতে সাড়ে ৫ মেট্রিকটন। এছাড়াও জিংক সমৃদ্ধ গমবীজ জাত-৩৩ জমিতে ব্যবহার করে অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছেন কৃষকরা। আমদানি করা গমবীজ ব্যবহার করে কৃষকদের সর্বশান্ত হওয়ার কষ্টের দিন শেষ হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।
মহাপরিচালক দেশে গম চাষ সম্প্রসারণের কথা উল্লেখ করে আরও বলেন, রাজশাহীর খরাপ্রবণ বরেন্দ্র এলাকা, শীতকালে দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের যেমন-খুলনা, ভোলা ও পাটুয়াখালীর অব্যবহারযোগ্য জমি, রবি মওসুমে সিলেট বিভাগের পতিত জমি এবং উত্তরাঞ্চলের উঁচু ও বেলে মাটি যেখানে বোরো ধান চাষ লাভজনক নয় এমন সব জমিতে আবাদ করে দেশে গমের আবাদ বৃদ্ধি করা যায়।
কৃষিসম্প্রসাণ অধিদপ্তরের কৃষি তথ্য সার্ভিস এর উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. আবু সায়েম গমের ফলন বৃদ্ধির উপায় সম্পর্কে জানিয়েছেন, পুষ্টিমানের বিবেচনায় গম ধানের চেয়ে এগিয়ে। ভূগর্ভস্থ পানি অধিক হারে ব্যবহারে পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে ফলে পরিবেশের উপর বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে।
সেক্ষেত্রে গম আবাদে পানির প্রয়োজন কম। গমে রোগ-বালাই ও পোকা-মাকড়ের আক্রমণ খুবই কম। ফলে বালাইনাশকের ব্যবহার নেই বললেই চলে। কাজেই গম চাষ পরিবেশ বান্ধব বলে জানান আবু সায়েম। তিনি বলেন, শীতের প্রভাব বাড়ায় গমের গাছের বৃদ্ধিও ভালো। আর উৎপাদন ব্যয় কম ও বাজারে চাহিদা বেশি থাকায় গম চাষ হয়েছে বেশি।
কৃষক ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মাঠকর্মীরা জানান, চাহিদা ও দাম বাড়ায় বোরো আবাদ কমিয়ে গম চাষে ঝুঁকেছেন কৃষক। উত্তর থেকে দক্ষিণবঙ্গের নদী তীরবর্তী জেলাগুলোতে গমের আবাদ ছাড়িয়ে গেছে। কৃষকরা জানান, গমে সেচ কম লাগে, গমের চাহিদা ও দাম বাড়ার পাশাপাশি ধান চাষে অধিক খরচ এবং দাম কম পাওয়ায় তারা গম চাষ বাড়িয়ে দিয়েছেন। উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোর পাশাপাশি দক্ষিণ-পশ্চিমের মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহসহ পদ্মা ও যমুনা নদী তীরবর্তী জেলা মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জসহ অন্য জেলাগুলোতে গমের চাষ বেড়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সরেজমিন বিভাগের হিসাবে শুধু চলতি মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অতিরিক্ত ৩৮ হাজার হেক্টর জমিতে গম চাষ হয়েছে। চলতি মৌসুমে দেশে ৪ লাখ ৮৮ হাজার হেক্টর জমিতে গমের আবাদ হয়েছে। গত বছর ৪ লাখ ৮১ হাজার হেক্টর জমিতে গমের আবাদ হয়।
মানিকগঞ্জ জেলার কৃষি কর্মকর্তারা জানান, শীতের তীব্রতা বাড়ায় চলতি মৌসুমে গম ফসল ভালো হয়েছে। ফলনও বাড়বে। জেলার সাটুরিয়া, শিবালয়, দৌলতপুর ও সদর উপজেলায় নতুন নতুন জায়গায় গমের আবাদ শুরু হয়েছে। মানিকগঞ্জ ও সিরাজগঞ্জ ছাড়াও উত্তরবঙ্গের রাজশাহী এবং রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জেলা, পদ্মা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর চরাঞ্চলে এ বছর গমের বাম্পার ফলন হয়েছে বলে এসব অঞ্চলের কৃষি কর্মকর্তারা জানান।
গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) গম গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আবদুল মান্নাফ বলেন, গত কয়েক বছরে গমের আবাদ এলাকা ও ফলন দুই-ই বেড়েছে। বর্তমানে দক্ষিণের জেলাগুলোতে গমের আবাদ শুরু হয়েছে। এর মধ্যে ফরিদপুর ও বরিশাল অন্যতম।
বারির গম গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা গম বিজ্ঞানী ড. নরেশ চন্দ্র দেব বর্মা বলেন, স্বল্প সময়ে ফলন উপযোগী আমন ধানের চাষ হওয়ায় কৃষকরা এ বছর আগাম গম বপন করতে পেরেছেন। বোরো ধানের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় কৃষকরা গমের দিকে ঝুঁকেছিলেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেই সঙ্গে বেশকিছু উন্নত জাতের বীজ কৃষকরা বাজার থেকে সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন। এর মধ্যে বারি গম-২৫, বারি গম-২৬, প্রদীপ ও বিজয়সহ বেশকিছু জাতের গম চাষ করে কৃষক ভালো ফলন পেয়েছেন। তিনি বলেন, অনেক স্থানে কৃষক তামাকের পরিবর্তে গম উৎপাদন করেছেন। দেশে বেকারি শিল্পের বিকাশ ও নাগরিক খাদ্য অভ্যাসের কিছুটা পরিবর্তন হওয়ায় প্রতিবছর গমের চাহিদা বাড়ছে।