সুজাউদ্দিন রোমেন : বিশ্বজুড়ে গণপরিবহনে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার নেতৃত্ব থাকলেও বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট করপোরেশন-বিআরটিসি নিয়মিত পিছিয়ে পড়ছে। গণপরিবহন খাতে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বিআরটিসি কোনো কার্যকর ভূমিকাই রাখতে পারছে না। অথচ বিআরটিসির নতুন বাস-ট্রাক কেনায় সরকার গত এক দশকে ১ হাজার ৬১২ কোটি টাকা খরচ করেছে। কিন্তু বিপুল বিনিয়োগের পরও বিআরটিসি লাভের ধারায় ফিরতে পারেনি। মূলত নানা পর্যায়ের অনিয়মের কারণেই সংস্থাটির এমন অবস্থায় উপনীত হয়েছে। সংস্থাটিতে ধারাবাহিক দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও সড়কে বেসরকারি বাস মালিক-শ্রমিকদের বৈরী আচরণে গুপরিবহন খাতে বিআরটিসির সেবা কার্যক্রম কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। সরকার সংস্থাটির বহরে চাহিদামাফিক বাস-ট্রাক সংযোজন করলেও দুর্নীতি-অনিয়মের মাধ্যমে কেনা ওসব বাস ঘোষিত লাইফটাইমের এক-তৃতীয়াংশ সময়ের মধ্যেই বিকল হয়ে পড়ছে। অবহেলা আর কার্যকর রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কোনো বাস অচল হয়ে ডিপোতে গেলে সেটি আর রাস্তায় ফিরে আসছে না। ফলে সরকারি এ সংস্থাটির মোট বাসের এক-তৃতীয়াংশের বেশি অচল পড়ে রয়েছে। বিআরটিসি সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, নষ্ট গাড়ির ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে বিআরটিসির অধিকাংশ ডিপো। সংস্থাটির ২২টি ডিপোর অধিকাংশই মেরামত-অযোগ্য পরিত্যক্ত গাড়ির কারণে অবরুদ্ধ হয়ে আছে। গাড়ি সংখ্যা কমে যাওয়ায় সংস্থাটির আয়ও কমে গেছে। ফলে অনেক ডিপোতে শ্রমিক-কর্মচারীদের তিন-চার মাসের বেতন বাকি পড়েছে। ফলে সরকারি সংস্থায় চাকরি করেও সংস্থাটির শ্রমিক-কর্মচারীরা অর্থকষ্টে রয়েছে। আর গত দুই দশকে বিআরটিসিতে কেনা গণপরিবহন কেনা হয়েছে তার মধ্যে ভলভো দ্বিতল বাসগুলো ছাড়া বাকি সবই নিম্নমানের। ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই ওসব যানবাহন লক্কড়ঝক্কড় অবস্থায় ডিপোতে ঠাঁই নিয়েছে। আর ভলভো বাসগুলোও কার্যকর রক্ষণাবেক্ষণ না করে নির্ধারিত লাইফটাইমের আগেই বিকল করে ডিপোবন্দি করে ফেলা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে বিপুলসংখ্যক যাত্রীবাহী বাসের বহর নিয়েও লোকসানে ধুঁকছে বিআরটিসি। সংস্থাটির লুটপাটের পথ প্রশস্ত করতে গত কয়েক বছরে চীন, কোরিয়া ও ভারত থেকে কেনা হয়েছে একের পর এক নিম্নমানের বাস। বছর না যেতেই সেগুলো অচল হয়ে ডিপোতে পড়ে থাকছে। বাড়ছে মেরামত খরচ, গুনতে হচ্ছে লোকসান। বিআরটিসির বহরে একসময় ভারতীয় ‘অশোক লিল্যান্ড’ বাসের আধিপত্য ছিল। কিন্তু গত এক যুগ ধরে বিআরটিসি বাসের বহরে মিশ্র যানবাহনের জোড়াতালি চলছে। সংস্থাটির বহরে এখন টাটা, অশোক দ্বিতল (পুরনো), অশোক দ্বিতল (২০১২), সিএনজি (চায়না), দাইয়্যু এসি, দাইয়্যু নন-এসি, অশোক এসি (পুরনো), ভলভো, হিনো, আর্টিকুলেটেড, অশোক দ্বিতল (নতুন), অশোক এসি (নতুন), টাটা (নতুন), মিনিবাস ও অন্যান্য মডেলের বাস রয়েছে। সব মিলিয়ে বর্তমানে বিআরটিসির বহরে থাকা বাসের সংখ্যা প্রায় ১ হাজার ৮০০। তার মধ্যে সচল আছে ১ হাজার ১৫২টি। তা থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি সংস্থায় ৯১টি বাস দীর্ঘমেয়াদি লিজে দেয়া আছে। আর ব্যবহার অনুপযোগী ও ভারী মেরামতের অপেক্ষায় ডিপোবন্দি হয়ে আছে সাড়ে ৫০০ বাস। বিআরটিসির বহরে থাকা বাসের প্রায় ৩৫ শতাংশই এখন অচল হয়ে ডিপোগুলোতে পড়ে আছে। এ অচল বাসের অধিকাংশই গত ১০ বছরে কেনা।
সূত্র আরো জানায়, নিম্নমানের গাড়ি কেনার দীর্ঘ ধারাবাহিকতায় ২০০৯ সালে চীন থেকে ১২২ কোটি টাকায় কেনা হয় ২৭৯টি বাস। অভিযোগ রয়েছে, টাকার অঙ্ক বেশি দেখানো হলেও কম টাকায় কেনা নিম্নমানের বাসের বেশির ভাগই নষ্ট হয়ে বিভিন্ন ডিপোতে পড়ে আছে। মূলত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে দুই বছরের মাথায় ওসব বাস নষ্ট হতে শুরু করে। চীনের পর ২০১১-১২ অর্থবছরে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ২৮১ কোটি টাকায় কেনা হয় আরও ২৫৫টি বাস। তার বেশির ভাগও বিভিন্ন ডিপোতে নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। প্রতিটি বাসের দাম পড়ে কোটি টাকার বেশি। বিআরটিসির কারিগরি শাখার তথ্যানুযায়ী ৬ বছর পার না হতেই দেড় শতাধিক বাস নষ্ট হয়ে যায়। তার বেশির ভাগই এখন মেরামতের উপযোগীও নয়। ২০১৩ সালে ভারত থেকে ঋণ নিয়ে কেনা আর্টিকুলেটেডসহ ৪২৮টি বাসের একটি বড় অংশ বিকল হয়ে গেছে। আর ২০১২-১৩ সালে ১০০ কোটি টাকায় ৫০টি আর্টিকুলেটেড এবং ৮৮টি এসি বাস কেনে বিআরটিসি। শুরুতে ওসব বাসের আয়ু ১৫ বছরের বেশি বলা হলেও মাত্র দু-তিন বছরের মধ্যেই সেগুলো নষ্ট হতে থাকে। একেকটি আর্টিকুলেটেড বাসের দাম পড়ে ১ কোটি ১১ লাখ টাকা। বর্তমানে ৫০টি আর্টিকুলেটেড বাসের অর্ধেকই অচল হয়ে বিভিন্ন ডিপোতে পড়ে আছে। বর্তমানে নির্মাণাধীন গাজীপুর-বিমানবন্দর রুটের বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের জন্য ৫৪ ফুট দীর্ঘ জোড়া লাগানো ওসব বাস কেনার কথা ছিল। কিন্তু লুটপাটের জন্য কোটি টাকার বেশি মূল্যের ওসব বাস বিআরটি প্রকল্পের কাজ শুরুর অনেক আগেই কেনা হয়। তবে বিআরটিসি বাসের বহরে সবচেয়ে আকর্ষণীয় গাড়ি ছিল দ্বিতল ভলভো। ওই গাড়িতে করেই ঢাকার যাত্রীরা স্বচ্ছন্দে লাইনে দাঁড়িয়ে বাসে উঠে যাতায়াত করতো। সুইডেন থেকে কেনা ৫০টি ভলভো দ্বিতল বাসের সবই বিকল হয়ে গেছে। ওসব বাসের ক্রয়মূল্য প্রায় ৫২ কোটি টাকা। ঋণের টাকায় কেনা ওসব বাস না চললেও সরকারকে সুদসহ ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে। ইচ্ছাকৃত অবহেলায় ওসব বাস নষ্ট করে ফেলা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ১৯৯১ সালে বিআরটিসি সুইডিশ ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির (সিডা) টাকায় ৫০টি দ্বিতল বাস কেনার প্রকল্প নেয়। সিডা ওই প্রকল্পে ৬১ কোটি টাকা অর্থায়ন করে। তবে এর মধ্যে অর্ধেক ছিল ঋণ ও বাকি অর্ধেক অনুদান। প্রতিটি বাসের জন্য তখন মূল্য ধরা হয় ১ কোটি ৩ লাখ টাকা। ওই হিসাবে ৫০টি বাসের মূল্য দাঁড়ায় ৫২ কোটি টাকা। বাকি ৯ কোটি টাকা রাখা ছিল বাসগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য।
এদিকে বিআরটিসি সরকারি সংস্থা হলেও এর আয় দিয়ে সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দেয়া হয়। পাশাপাশি ঋণের টাকাও পরিশোধ করতে হয়। তাই অনেক গাড়ি অচল হয়ে যাওয়ার কারণে বিভিন্ন ডিপোতে চালক, হেলপারসহ অন্য কর্মচারীদের বেতন বকেয়া পড়েছে। জোয়ারসাহারা ডিপোতে বেতন বাকি চার মাস। কল্যাণপুর ডিপোর বেতন বাকি পড়েছে তিন মাস।
অন্যদিকে বিআরটিসি প্রসঙ্গে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. শামসুল হক জানান, অবহেলায় জনগণের মূল্যবান সম্পদগুলো নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। সঠিকভাবে মেরামত করা হলে জনগণের সেবায় আরো ২৫ থেকে ৩০ বছর ভলভো বাসগুলো সার্ভিস দিতে পারতো। ভলভো বাসের আয়ুষ্কাল ধরা হয়েছিল ১৫ বছর। প্রতিটি বাস ৬ হাজার কিলোমিটার চালানো ও ৭ লাখ ২০ হাজার যাত্রী পরিবহনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। কিন্তু ২০০৪ সাল পর্যন্ত প্রতিটি বাসে বছরে যাত্রী পরিবহন করা হয় ৩ লাখ ১৪ হাজার ৮০০ জন। নষ্ট হওয়ার পর সেগুলোর যন্ত্রাংশ সময়মতো লাগানো হয়নি। ফলে ব্যবহারের ৮ বছরের মধ্যেই বাসগুলো পরিত্যক্ত ও নষ্ট হয়ে যায়। তারপর প্রধানমন্ত্রী ওসব ভলভো বাস মেরামতের জন্য বিশেষভাবে ৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেও ওই টাকা অন্য বাস মেরামতের নামে লোপাট করে বিআরটিসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। সব মিলিয়ে বিআরটিসির রাজধানীর মিরপুর, কল্যাণপুর, জোয়ারসাহারা, মতিঝিল, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, রংপুর, বগুড়া, নরসিংদীসহ বিভিন্ন ডিপো এখন নষ্ট বাসের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে।