মিয়ানমারে এই সেনা অভ্যুত্থান কেন?

মিয়ানমারে এই সেনা অভ্যুত্থান কেন?
অং সান সু চি ও তাঁর সরকারের সঙ্গে কয়েক সপ্তাহ ধরেই উত্তেজনা চলছিল মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর। এরই ধারাবাহিকতায় আজ সোমবার মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে। পার্লামেন্টে প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হওয়ার দিনেই সু চি, মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট ও অন্য জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের আটক করেছে সেনাবাহিনী। মিয়ানমারে হঠাৎ এই সেনা অভ্যুত্থানের কারণ কী, তা এক বিশ্লেষণে তুলে ধরেছে এএফপি।

গত বছরের ৮ নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সু চির দল দ্য ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি ৮৩ শতাংশ আসনে জয়ী হয়। ২০১১ সালে সেনা শাসনের অবসানের পর এটি ছিল দ্বিতীয় দফা নির্বাচন। তবে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তোলে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। সংকটের শুরুটা মূলত এখান থেকেই।

সংকটের শুরু যেভাবে

২০১৭ সালে দেশটির সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিতাড়ন নিয়ে সু চি নিষ্প্রভ ভূমিকা রেখেছেন। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচনা রয়েছে। তবে তা সত্ত্বেও মিয়ানমারের অভ্যন্তরে অং সান সু চির যথেষ্ট জনপ্রিয়তা রয়েছে।

গত বছরের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সু চির ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। ২০১৫ সালের তুলনায়ও সে বছর সু চির দল বেশি ভোটে জয়ী হয়। এরপর নোবেলজয়ী সু চি ক্ষমতায় আসেন।

৬০ বছরের বেশি সময় ধরে মিয়ানমারে ক্ষমতাসীন ছিল জান্তা সরকার। দেশটির সেনাবাহিনীর অভিযোগ, ভোটে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে। সেনাবাহিনীর দাবি, ভোটে কারচুপির এক কোটির বেশি ঘটনার প্রমাণ রয়েছে তাঁদের কাছে। যাচাই–বাছাইয়ের জন্য সেনাবাহিনী সরকার পরিচালিত নির্বাচন কমিশনের কাছে ভোটার তালিকা দেওয়ার দাবি জানিয়েছে।

সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং কিছুদিন আগে এক বক্তব্যে মিয়ানমারের সংবিধান বাতিল করার হুঁশিয়ারি দেন। এরপরই উত্তেজনা চরমে ওঠে। গত সপ্তাহে ইয়াঙ্গুনের বাণিজ্যিক এলাকার রাস্তায়, রাজধানী নেপিডো ও অন্যান্য এলাকায় সেনাবাহিনীর ট্যাংক মোতায়েন করা হয়। নির্বাচনের ফল নিয়ে সেনা–সমর্থকেরা বিক্ষোভ করেন। এসবেরই ধারাবাহিকতায় আজ সেনা অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটল।

কী ঘটবে সামনে

সেনাবাহিনী মিয়ানমারে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। আগামী এক বছর ক্ষমতায় থাকার ঘোষণাও দিয়ে ফেলেছে সেনাবাহিনী। মিন্ত সুয়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সাবেক জেনারেল। তিনি ইয়াঙ্গুন সেনা কমান্ড পরিচালনা করেছেন। তিনি এখন মিয়ানমারের ভাইস প্রেসিডেন্ট। তিনিই মিয়ানমারের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী পরিচালিত মিয়াওয়ারদি টিভিতে মিন্ত সুয়ে স্বাক্ষরিত এক বিবৃতি পাঠ করা হয়। তাতে মিন্ত সুয়ে বলেছেন, মিয়ানমারের আইনব্যবস্থা, প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থা মিন অং হালিংয়ের কাছে হস্তান্তর করা হলো। মিয়ানমারে আবার সেনাশাসন ফিরে এল।

এমন ঘটনা কি এবারই প্রথম

১৯৪৮ সালে ব্রিটেনের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতার পর থেকেই বেশির ভাগ সময় সেনাশাসন চলেছে মিয়ানমারে। ১৯৬২ সালে বেসামরিক প্রশাসন বাতিল করেন জেনারেল নি উইন। সরকার পরিচালনার জন্য বেসামরিক প্রশাসন যথেষ্ট নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।

পরের ২৬ বছর সরকার পরিচালনা করেন নি উইন। ১৯৮৮ সালে অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও কর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রতিবাদে ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করেন তিনি। এর কয়েক সপ্তাহ পর দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুনরুদ্ধারের কথা বলে সামরিক নেতাদের নতুন একটি দল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়।

২০১১ সালে জান্তা সরকারের নেতা জেনারেল থান সুয়ে পদত্যাগ করেন। দেশের সংবিধান মেনে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলদের সমন্বয়ে গঠিত সরকারের কাছে তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।

সংবিধান কি এমনই থাকবে? ২০০৮ সালে মিয়ানমারের সংবিধানে দেশটির সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী রাজনৈতিক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সেনাবাহিনীর হাতে স্বরাষ্ট্র, সীমান্ত ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ দেওয়া হয়েছে।

মিয়ানমারের পার্লামেন্টে নির্ধারিত আসনের এক–চতুর্থাংশ নিয়ন্ত্রণ করে দেশটির সেনাবাহিনী। তাই যেকোনো পরিবর্তনের জন্য সামরিক আইনপ্রণেতাদের সমর্থন প্রয়োজন।

ইয়াঙ্গুনভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক খিন জ উইন বলেছেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দেশটির সংবিধানকে ব্যাপকভাবে অজনপ্রিয় করে তুলেছে। ২০১৫ সালের নির্বাচনে জয়ের পর থেকেই সু চি ও তাঁর সরকার সংবিধান সংশোধনের চেষ্টা করেছে। তবে এ ক্ষেত্রে খুব সামান্যই সফলতা এসেছে।

শেষ মেয়াদে সু চি নেতৃত্বে বাধা আসে এমন একটি নিয়ম নিষ্ক্রিয় করেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষক সো মিন্ত অং বলেন, আইনের এমন ফাঁকফোকরের কথা সেনাবাহিনী আগে ভাবেনি। সেনাবাহিনী মনে করছে এতে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় তাদের নিয়ন্ত্রণ কমেছে।সু চির পরিচয়

মিয়ানমারের স্বাধীনতার নায়ক হিসেবে খ্যাত জেনারেল অং সানের মেয়ে অং সান সু চি। ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতার আগমুহূর্তে তাঁকে হত্যা করা হয়। ১৯৮৯ থেকে ২০১০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে ১৫ বছর বন্দী ছিলেন সু চি। গৃহবন্দী থাকাকালে ১৯৯১ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান সু চি। ২০১৫ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সু চি নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করেন। সন্তানেরা বিদেশি নাগরিক হওয়ায় সে সময় সংবিধানের নিয়ম অনুসারে প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি সু চি। রাখাইনে সেনা নির্যাতনে মিয়ানমার ছেড়ে ২০১৭ সালে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসে। রোহিঙ্গা ধর্ষণ, হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনায় নীরব থাকায় আন্তর্জাতিক মহলে সু চি সমালোচিত হন।

Leave a reply

Minimum length: 20 characters ::

More News...

সারা দেশে ‘হিট স্ট্রোকে’ ৮ জনের মৃত্যু

কারাগারেও মাদকের আখড়া