চালকদের অদক্ষতার কারণেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না সড়ক দুর্ঘটনা

চালকদের অদক্ষতার কারণেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না সড়ক দুর্ঘটনা

সুদেব কুমার সাহা : দেশজুড়ে সড়ক-মহাসড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে লাখ লাখ অদক্ষ চালক। বর্তমানে দেশে অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালকের সংখ্যা প্রায় ২৪ লাখ। নতুন চালক তৈরির প্রকল্প আলোর মুখ না দেখায় কাটছে না চালক সঙ্কট। কবে ওই প্রকল্পের কাজে গতি আসবে তাও সংশ্লিষ্টরা নিশ্চিত করে বলতে পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞদের অভিমত, ৪৬ লাখ যানবাহনের মধ্যে অর্ধেকের বেশি অবৈধ চালক রেখে সড়ক কোন অবস্থাতেই নিরাপদ করা সম্ভব হবে না। সেজন্য দ্রুত সময়ের মধ্যে চালকের পেশাকে মর্যাদার স্থানে নিয়ে যেতে হবে। একই সঙ্গে এ পেশায় শিক্ষিত তরুণসহ নারীদের নিয়ে আসতে হবে। বাড়াতে হবে সুযোগ-সুবিধা। কার্যকর করতে হবে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮। পাশাপাশি নিরাপদ সড়কের জন্য গঠিত টাস্কফোর্সের ১১১ দফা সুপারিশও বাস্তবায়নও জরুরি। প্রায় দুই বছর আগে টাস্কফোর্স সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ১১১ দফা সুপারিশের পর কয়েকটি বৈঠক হলেও তা নিয়ে এখনো তেমন কোন অগ্রগতি হয়নি। যদিও গতবছরের ২৩ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছিলেন, দেশের সড়ক পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা জোরদার ও দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে পর্যায়ক্রমে ১১১ দফা সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হবে। নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন (নিসচা) এবং বিআরটিএ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে,সড়ক দুর্ঘটনা রোধ ও পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে সরকার। সড়ক পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা জোরদার ও দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে করা সুপারিশ বাস্তবায়নে গঠিত চারটি কমিটি তাদের সুপারিশ জমা দিয়েছে। সেগুলো বাস্তবায়নে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। আর প্রদত্ত সুপারিশ বাস্তবায়ন করার বিষয়ে সবাই তাদের সুচিন্তিত মতামতও দিয়েছে। তবে তাতে একটু সময় লাগবে।
সূত্র জানায়, নিচসার হিসাবে করোনা মহামারীর মধ্যে দুই মাসের বেশি সময় সারাদেশে গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও সড়কে প্রায় ৫ হাজার মানুষের প্রাণ গেছে। আর যাত্রীকল্যাণ সমিতির হিসেবে গত বছর সড়কে সাড়ে ৬ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। নিসচার দাবি- দীর্ঘদিন পরিবহন চলাচল বন্ধ থাকার থাকার পরও মৃত্যুর যে সংখ্যা দাঁড়িয়েছে তাতে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে এসেছে তা বলার সুযোগ নেই। এক বছরের এক পরিসংখ্যানের তথ্যানুযায়ী নিহতদের মধ্যে ২৫ ভাগ চালক ও পরিবহন শ্রমিক। সারাদেশে দুর্ঘটনার শিকার ৫১ হাজার ৬৬৮টি বাসের মধ্যে ৬৯৮টি বাস। ট্রাক, কাভার্ডভ্যান ও পিক-আপ মিলে সর্বোচ্চ এক হাজার ৪৭৭টি দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। তাছাড়া পুরো বছরে এক হাজার ১২৭টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় তার আগের বছরের চেয়ে মৃত্যু ৮ ভাগ বেড়ে ২৭ ভাগে দাঁড়িয়েছে। তারপরই পুরো বছরে মুখোমুখি সংঘর্ষ, উল্টে গিয়ে এবং গাড়িচাপায় দুর্ঘটনার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। গাড়িচাপায় নিহতের সংখ্যা ২ হাজার ৯০, মুখোমুখি সংঘর্ষে ৬৯৮ ও উল্টে গিয়ে ৫৩০ জনের মৃত্যু হয়েছে। দুর্ঘটনায় পথচারী মৃত্যুর সংখ্যা এক হাজার ৪৬ জন, যা মোট দুর্ঘটনার ২১ ভাগ। গত বছরের জানুয়ারি মাসে সবচেয়ে বেশি ৪৪৭টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। ওসব দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা ৪৯৫ জন। আর দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ঢাকায় দুর্ঘটনার সংখ্যা ও মৃত্যু সবচেয়ে বেশি। তাছাড়া ব্রাকের এক গবেষণায় বলা হয়, বিশ্বে প্রতি বছর সাড়ে ১৩ লাখ মানুষ সড়ক দুর্ঘটনা মারা যায়। বাংলাদেশে ৫ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুদের মৃত্যুর চতুর্থ প্রধান কারণ হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনা। আর দুর্ঘটনায় আক্রান্তদের ৬৭ শতাংশই ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সের।
সূত্র আরো জানায়, লার্নার লাইসেন্স ফরমের শর্ত অনুযায়ী বিআরটিএ নিবন্ধিত ট্রেনিং সেন্টার থেকে শিক্ষানবিস চালকদের প্রশিক্ষণ নেয়ার কথা। বাস্তবে তা কার্যকর হচ্ছে না। আর সেটা দেখারও কেউ নেই। বেশিরভাগ চালক ওস্তাদদের কাছ থেকে ট্রেনিং নেয়। সেজন্য তারা গাড়ি চালাতে সাইন-সিগন্যালসহ রাস্তার ভাষা শিখতে পারে না। নতুন সড়ক পরিবহন আইন অনুযায়ী যাদের হালকা তাদের মিডিয়াম, যাদের মিডিয়াম রয়েছে তাদের ভারি লাইসেন্স দেয়ার কথা ছিল। ওই সিদ্ধান্ত কার্যকর করা গেলে ভারি যানবাহনের চালক বাড়তো। একই সঙ্গে সড়ক নিরাপত্তাও বাড়তো। তাছাড়া হেভি লাইসেন্স দেয়ার আগে সরকার নির্ধারিত ট্রেনিং সেন্টারে অন্তত ১৫ দিন চালকদের প্রশিক্ষণ নেয়া বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। তাতে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রীর ৫ লাখ দক্ষ চালক তৈরির পরিকল্পনাও কার্যকর হয়নি। ওই পরিকল্পনা কার্যকর করা হলে দেশে দক্ষ চালক সঙ্কট অনেকটাই কমে আসতো। পাশাপাশি মহাসড়কে অনুমোদনহীন যানবাহন উচ্ছেদ নিশ্চিত করা জরুরি। কারণ অদক্ষ চালকই সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। মোদ্দা কথা- দক্ষ চালক তৈরি করতে না পারায় সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আসছে না।
এদিকে বিশেষজ্ঞদের মতে, সড়কের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিংয়ের অভাব, টাস্কফোর্স প্রদত্ত ১১১টি সুপারিশনামা বাস্তবায়ন না হওয়া, চালকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানোর প্রবণতা, দৈনিক চুক্তিভিত্তিক গাড়ি চালনা করা, লাইসেন্স ছাড়া চালক নিয়োগ, পথচারীদের মধ্যে সচেতনতার অভাব, ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করে ওভারটেকিং করা, বিরতি ছাড়াই দীর্ঘসময় ধরে গাড়ি চালানো, ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালানো বন্ধে আইনের প্রয়োগ না থাকা, সড়ক ও মহাসড়কে মোটরসাইকেল ও তিন চাকার গাড়ি বাড়ানো, মহাসড়কের নির্মাণ ত্রুটি, একই রাস্তায় বৈধ ও অবৈধ এবং দ্রুত ও শ্লথ যানবাহন চলাচল, রাস্তার পাশে হাটবাজার ও দোকানপাট এবং অশিক্ষিত ও অদক্ষ চালক, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ বাস্তবায়ন না হওয়াই বিপুল সংখ্যক দুর্ঘটনার মূল কারণ। গত বছর বড় বড় শহর ও হাইওয়েতে বেশিরভাগ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। তাছাড়া অবৈধ যানবাহন যেমন- ভ্যান, রিক্সা, নসিমন, অটোরিক্সা ইত্যাদিও সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ি। গতবছর বাস-ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান মিলিয়ে সর্বোচ্চ ৪০ ভাগ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। মোটরসাইলে দুর্ঘটনা ২৬ ভাগ। সড়ক পরিবহন আইন পুরোপুরি কার্যকর না হওয়ায় দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আসবে না। তাছাড়া নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের পক্ষ থেকে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ১১ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ কার্যকর করতে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ, প্রধানমন্ত্রীর ৬ দফা নির্দেশনা বাস্তবায়ন, টাস্কফোর্সের দাখিল করা ১১১ দফা সুপারিশ বাস্তবায়ন, হাইওয়েতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে উচ্চ পর্যায়ের মনিটরিং সেল গঠন, দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে প্রচার, পাঠ্যক্রমে সড়ক দুর্ঘটনা বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা, ঢাকায় রুট ফ্র্যান্সাইজ পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করা, ট্রাফিক আইনসহ অন্যান্য বিধি নিষেধ কঠোরভাবে মেনে চলাসহ প্রভৃতির বাস্তবায়ন।
অন্যদিকে মালিক সমিতির পক্ষ থেকে সরাসরি চালক তৈরির কোন সুযোগ নেই জানিয়ে সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ জানান, সরকারের পক্ষ থেকে চালক তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে। সেজন্য বহুবার বিআরটিএ, সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়সহ বিআরটিসিকে চিঠি দেয়া হয়েছে। ঢাকা যানবাহন সমন্বয় বোর্ডকেও বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে। অনেক চিঠি চালাচালির পর সরকারের পক্ষ থেকে ৩ লাখ চালক তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়। তার মধ্যে একটি বড় অংশকে ভারি লাইসেন্স দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনার আগে নতুন চালকদের জন্য প্রশিক্ষণ শুরু হলেও করোনার জন্য এখন পুরো প্রকল্পের কাজ বন্ধ।
সড়ক দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে নিসচা চেয়ারম্যান ও চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন জানান, গত বছরের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বিআরটিএর তথ্যানুযায়ী সারাদেশে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ৪৫ লাখ ২৩ হাজার ৬০০টি। তার বাইরে অনিবন্ধিত নসিমন, করিমন, ভটভটি, ব্যাটারিচালিত রিক্সা, অটোসহ কয়েক লাখ যানবাহন দিব্যি চলাচল করছে। সারাদেশে ২৪ লাখ অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালক পরিবহন খাতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এর মধ্যে প্রায় একলাখ অদক্ষ চালক বাস, ট্রাক ও কাভার্ডভ্যানসহ ভারি যানবাহন চালাচ্ছে। আর মোটরসাইকেলের চালকদের অধিকাংশেরই লাইসেন্স নেই।
এ প্রসঙ্গে বিআরটিএর পরিচালক (অপারেশন) সিতাংশু শেখর বিশ্বাস জানান, চালক বাড়াতে সরকারিভাবে বিআরটিসিকে নিয়ে একটি প্রকল্প নেয়া হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ২ লাখেরও বেশি দক্ষ চালক তৈরি হবে। ভারি যানবাহনসহ সকল প্রকার যানবাহন থেকে চালক বেশি থাকার কথা। কিন্তু চালকের পেশায় সাধারণ মানুষ আসতে খুব একটা আগ্রহ দেখায় না। প্রয়োজনীয় আর্থিক সুবিধা না পাওয়া ও সামাজিক মর্যাদা না বাড়ায় অনেকে চালক হিসেবে পেশা বেছে নিতে চায় না। তাছাড়া অনেক পরিবহন মালিক চালকসহ পরিবহন শ্রমিকদের নিয়মিত বেতনও দিতে চায় না। শ্রমআইন থেকে শুরু করে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ অনুযায়ী চালক নিয়োগ নিশ্চিত করা গেলে এ পেশায় আসতে হয়তো অনেকেই উৎসাহ বোধ করবে। দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ এর বাস্তবায়ন জরুরি। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী নির্দেশিত ৬ দফা নির্দেশনামা দ্রুত বাস্তবায়ন করা, টাস্কফোর্স দাখিল করা ১১১টি সুপারিশনামা যতো দ্রুত সম্ভব বাস্তবায়ন করতে হবে।
দেশের সড়ক ব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ক এক অনুষ্ঠানে জানান, নিরাপদ ও ভ্রমণবান্ধব সড়ক গড়ে তোলা সরকারের অগ্রাধিকার। আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে বাংলাদেশের সড়ক নেটওয়ার্কে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হবে। উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে চালু করা হয়েছে রোড সেফটি অডিট।

Leave a reply

Minimum length: 20 characters ::

More News...

বাকেরগঞ্জে বিদ্যুৎ স্পর্শ হয়ে একই পরিবারের ৩ জনের মৃত্যু

মাদারীপুরে সুশাসন প্রতিষ্ঠার নিমিত্ত অংশীজনের (Stakeholders) অংশগ্রহণে মতবিনিময় সভা