একটি অকাল মৃত্যুকে ঘিরে নোবিপ্রবিতে ছাত্রলীগ পুর্নবাসনের অভিযোগ

একটি অকাল মৃত্যুকে ঘিরে নোবিপ্রবিতে ছাত্রলীগ পুর্নবাসনের অভিযোগ

নোবিপ্রবি প্রতিনিধি:: নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী মো: মোস্তফা তারেক সিয়ামের অকাল মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ছাত্রদের আন্দোলনকে ব্যবহার করে অপরাজনীতির মাধ্যমে বিভিন্ন পক্ষ তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের অভিযোগ উঠেছে।

গত ৩০ শে অক্টোবর(বুধবার) রাতে নোবিপ্রবির ২০২০-২১ সেশনের শিক্ষার্থী মো:মোস্তফা তারেক সিয়াম হার্টঅ্যাটাকে অকালে মৃত্যুবরণ করেন। তারেক সিয়ামের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন ধরে চলা নোবিপ্রবির মেডিকেল সেন্টারের অব্যবস্থাপনার প্রতিবাদে সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠে। পরবর্তীতে বিক্ষুদ্ধ শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারে সামনে বিক্ষোভ প্রকাশ করে। শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন পক্ষ তাদের রাজনৈতিক ফয়দা হাসিলের চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। রাজনৈতিক ফয়দার অংশ হিসেবে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগকে পুর্নবাসন, ছাত্ররাজনীতি প্রতিষ্ঠা, ছাত্রসংসদ প্রতিষ্ঠার দাবি উপস্থাপন করার মতো অভিযোগ সামনে এসেছে।

গত ৩০ শে অক্টোবর (বুধবার) রাতে ছাত্র বিক্ষোভের সময় নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে অভিযুক্ত নোবিপ্রবির আইসিই বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী আরমান হোসেনকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের নেতৃত্ব এবং দাবিদাওয়া পেশ করেছে বলে সামাজিক গণমাধ্যমে অভিযোগ করে পোস্ট প্রদান করেছে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা। অভিযুক্ত শিক্ষার্থীর সাথে নোবিপ্রবি ছাত্রলীগের সাথে সংযুক্তির বিভিন্ন ছবি এবং ছাত্রলীগ নেতাদের পক্ষে বিভিন্ন পোস্টের ছবি এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গ্রুপে ছড়িয়ে পড়েছে। ০৫ই আগষ্ট ছাত্রজনতার বিপ্লবের পর নোবিপ্রবি ছাত্রলীগ সভাপতি নাঈম রহমানের কক্ষ ভাংচুর করা হলে আরমান এর প্রতিবাদে এবং সহমর্মিতা জানিয়ে পোস্ট করেন। অভিযুক্ত আরমান হোসেনকে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক স্বপ্নীল নাঈমের অনুসারী হিসেবে ছাত্রলীগের বিভিন্ন কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতো বলে জানা যায়। জুলাই বিপ্লবের শেষের দিকে ১লা আগষ্ট এক ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে নিজেকে ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে সরে আসার বিষয় জানান অভিযুক্ত আরমান হোসেন।

এছাড়াও সিয়ামের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আন্দোলনে বিভিন্ন ছাত্রকে নেতৃত্বের ভূমিকায় আসতে দেখা গেলেও সিয়ামের গায়েবানা জানাজা এবং দোয়া অনুষ্ঠানে তাদেরকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে অভিযোগ করেছে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবী, সিয়ামের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে একটি পক্ষ নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের কিছু কর্মীকে ক্যাম্পাসের পুর্নবাসন করার চেষ্টা করছে। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সংস্কার ছাড়া তড়িগড়ি করে ছাত্রসংসদের দাবী আদায়ের চেষ্টা করার জন্য সিয়ামের মৃত্যুকে ইস্যু হিসেবে ব্যবহার করেছে।

সিয়ামের মৃত্যু নিয়ে অপরাজনীতি বন্ধের আহ্বান জানিয়ে আইন ১৪তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আবু সুফিয়ান বলেন,
“আরমান কখনোই বাধ্য হয়ে ছাত্রলীগ করতো না বরং সে সবাইকে সংঘঠিত করে মিছিলের সামনের সারিতে থেকে স্লোগান দিতো। তিনি অভিযুক্ত আরমানের ব্যাপারে আরো বলেন, ক্যাম্পাসের সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রশাসন ভবনে দাবি নিয়ে যাওয়াকে তাচ্ছিল্য করে ‘দালাল’ আখ্যা দেয় ছাত্রলীগের এই আরমান-যা অত্যন্ত হতাশাজনক। অবহেলায় ও চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুবরণ করার প্রতিবাদের নামে অপরাজনীতির সুযোগ গ্রহণ করে একদল শিক্ষার্থী জুলাই বিপ্লবের সম্মুখ সারিতে থাকা সম্মানিত শিক্ষককে অপমানিত করবে -এমন নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলো নোবিপ্রবি। এর সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া দরকার এবং এর মদদদাতা খুঁজে বের করা দরকার।”

ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী মাহবুবুল আলম তারেক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করে বলেন, “সিয়ামের মৃত্যু অবশ্যই কষ্টের এবং আল্লাহ তার জন্য জান্নাত কবুল করুক। কিন্তু এই মৃত্যুকে কেন্দ্র করে জুলাই বিপ্লবের শহীদদের সাথে বেইমানি এটা কখনো মেনে নেয়া যায়না। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, জুলাই বিপ্লবের একজন সমন্বয়ক ছাত্রলীগ পুনর্বাসনের সাথে সরাসরি জড়িত। সেদিন সিয়ামের মৃত্যুর পরে এটাকে ইস্যু করে রাতে মেয়েদেরকে হল থেকে বের করা, শিক্ষকদের সাথে রূঢ ব্যবহার করা, সাধারণ শিক্ষার্থীদের নেতা হয়ে নিজেকে জাহির করা সুশীল ছেলেটা এক্টিভ ছাত্রলীগের কর্মী আরমান।”
তিনি আরো বলেন, ” যে জুলাই বিপ্লবের পরেও ক্যাম্পাসে ত্রাসের রাজত্ব কায়েমকারী নাইম রহমানকে মিস করে। নাইম রহমানের গুনগান গাইতে গিয়ে নাইম রহমানকে চকবাজার মসজিদের ইমাম বানিয়ে ফেলেছে। অথচ নাইম রহমান ১৫জুলাই যখন হল চালু রাখার জন্য ক্যাম্পাসে আমরা আন্দোলনকারীরা যাচ্ছিলাম, তখন জেড মোড়ে সরাসরি আমাকে থ্রেট দিয়েছিল। এছাড়া ৩-৪ আগস্ট সোনাপুরে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নিয়েছিল। কিন্তু সুশীল আরমান নাইমকে আবার ক্যাম্পাসে দেখতে চায়৷ নাইম ছাড়া ক্যাম্পাস তার ভালো লাগে না। এজন্য সাধারণ শিক্ষার্থীদের নেতা হয়ে যদি তাদের পিও ভাইদের জন্য কিছু করা যায় এই দিবাস্বপ্ন সে দেখতেছে। ”

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে অভিযুক্ত আরমান বলেন, “সিয়ামের মৃত্যুর পর সিয়ামের বন্ধুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে অক্সিজেন সেবার অভাব ও সময়মতো এম্বুলেন্স না পাওয়ার অভিযোগ তুলে। তৎক্ষণাৎ সাধারণ শিক্ষার্থীদের তরফ থেকে তারা আন্দোলনের ডাক দেয়। এ সময় সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি হিসেবে আমি বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেই।কিন্ত একটি সুবিধাভোগী গোষ্ঠি সেদিনের বিক্ষোভ মিছিলকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে ষড়যন্ত্র করছে।”
নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের সাথে সম্পৃক্ততার প্রসজ্ঞে তিনি জানান, ক্যাম্পাসের অন্যান্য সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতোই তিনি বাধ্য হয়ে ছাত্রলীগ করতেন। তিনি ছাত্রলীগ থাকা কালে ক্যাম্পাসে কখনো কারো ক্ষতি করেননি। বরং সবসময়ই ছাত্রদের অধিকার আদায়ে কাজ করার চেষ্টা করতেন। এমনকি এসব করতে গিয়ে ছাত্রলীগের তরফ থেকে তাঁকে বিভিন্ন সময় শিবির, ছাত্রদল হিসেবে ট্যাগ দেয়া হতো বলেও তিনি জানান। তিনি ছাত্রলীগের কোনো পদের অধিকারী না হয়েও জুলাই বিপ্লবের সময় ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করেন এবং আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন বলে জানান।
ছাত্রলীগের নোবিপ্রবি শাখার সভাপতি নাইম রহমানকে নিয়ে দেয়া ০৫ আগষ্টের পোস্টের ব্যাপারে তিনি জানান, তিনি না জেনে পোস্ট করেন এবং পরে নাইম রহমানের ০৩ ও ০৪ আগষ্ট সোনাপুর ও দত্তের হাটে ছাত্রদের বিপক্ষে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে জানতে পেরে পোস্টটি ডিলিট করে দেন।
বিক্ষোভের নেতৃত্বে থাকা অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের পুর্ব রাজনৈতিক পরিচয়ের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি জানান, “সবাই নিজেদের জায়গা থেকে সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে বিক্ষোভে অংশ নিয়েছে। রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে কেউ আসেনি।” তিনি আরো বলেন, “অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের পূর্ব পরিচয়ের সাথে ছাত্রলীগ জড়িত। কারণ ক্যাম্পাসে সবাই বাধ্য হয়ে ছাত্রলীগ করতো। তবে সেদিন বিক্ষোভে কোনো প্রশ্নবিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতা ছিল না।”

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন,নোবিপ্রবির সমন্বয়ক বনি ইয়ামিন সিয়ামের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে বলেন, “একজন সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে সেদিন আমিও বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করি। আমরা চেয়েছিলাম মেডিকেল সেন্টার কর্তৃপক্ষ ও পরিবহন প্রশাসকের অবহেলার বিষয়ে আলোকপাত করে যেন আগামীতে আর কেউ এমন চিকিৎসা বঞ্চিত না হয় এবং ন্যায্য সুবিধা পায় তা আদায়ে কথা বলতে কিন্ত একদল শিক্ষার্থী যারা পূর্বে সন্ত্রাসী সংঘঠন ছাত্রলীগের সাথে জড়িত ছিল তারা অতি উৎসাহী হয়ে সম্মানিত শিক্ষকদের সাথে বাজে আচরণ করে।”
তিনি আরও বলেন, “তাদের আচরণ শিক্ষার্থী সুলভ ছিল না। তাদের মধ্যে অধিকাংশ ছাত্র রয়েছে যারা পদধারী ছাত্রলীগের নেতাদের খুব ঘনিষ্ঠ হিসেবে ক্যাম্পাসে পরিচিত ছিল। জুলাই বিপ্লবের পর তারা সবাই খোলস বদলেছে কিন্ত তাদের আদর্শগত পরিবর্তন হয়নি।তারা এখনো নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করছে।আমরা চাই না ফ্যাসিবাদী সংগঠন ছাত্রলীগের সাথে জড়িত কেউ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিক ও তাদের গোপন এজেন্ডা বাস্তবায়ন করুক। এছাড়া তিনি নোবিপ্রবির আরেক সমন্বয়ক জাহিদুল ইসলাম হাসানের নামে ছাত্রলীগ-কর্মীদের পূনর্বাসনের অভিযোগ তুলে বলেন, “জাহিদ ও তার অনুসারীরা এখন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরোধিতা করে এবং কোনো কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে না বরং সে ছাত্রলীগ পুনর্বাসনে কাজ করছে।”

এ ব্যাপারে জানতে সমন্বয়ক জাহিদুল ইসলাম হাসানকে বারবার কল দিলেও তার মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়।

এদিকে মৃত নোবিপ্রবি শিক্ষার্থী সিয়ামের বিভাগের সহপাঠীরা ক্যাম্পাসে সকল পক্ষকে তার মৃত্যুকে ইস্যু করে যেকোনো রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল কিংবা কাদাছুড়ি বন্ধ করার জন্য অনুরোধ জানিয়ে বিবৃতি প্রদান করেছে।

Leave a reply

Minimum length: 20 characters ::