একসময় সিঙ্গালিলার জঙ্গল থেকে প্রজাপতি ধরে জাপান, কোরিয়ায় পাচারের একটি চক্র খুব সক্রিয় হয়ে উঠেছিল ধোত্রের আশপাশে। এই জাতীয় উদ্যানে আছে হরেক প্রজাতির রডোডেনড্রন, বিরল গুণসম্পন্ন ওষধি গাছপালা, দুষ্প্রাপ্য রেড পান্ডা আর বহুবিচিত্র প্রজাপতির সম্ভার।ফড়েদের উসকানি আর অল্প আয়াসে মোটা উপার্জনের লোভে গ্রামের যুবকেরা এক একটা প্রজাপতি ২৫-৩০ হাজার টাকায় তুলে দিচ্ছিলেন বহিরাগতের হাতে। এহেন শঠতায় অরণ্য পাহাড় কাঁদছিল। আর প্রজাপতিদের হয়ে কাঁদছিলেন সোনম ওয়াংদি। ফরেস্টবাবুরা গা করেননি, সোনম একাই বোঝাচ্ছিলেন বেপথু যুবকদের। প্রজাপতির জবানিতে তাদের আর্তি তিনি লিখে রাখলেন ছন্দোবদ্ধ নেপালি কবিতায়। টুমলিং যাওয়ার পথে তিনটে ঘোড়ারাতে খাওয়ার টেবিলে তিনি যখন আমাদের স্মৃতি থেকে শোনাচ্ছিলেন সেই কবিতা, মাতৃভাষার মতো না বুঝলেও তার ছন্দ আর কাতরতা প্রাণতন্ত্রীতে এসে ঠিকই বেজে উঠল, ভাষাকে ডিঙিয়ে গিয়ে গভীর একটা সুর যেমন ভেতরে এসে বাজে। সোনমজির কাব্যপ্রতিভার কথা অবশ্য আশপাশের লোকেরা জানেন। তিনি প্রথাগতভাবে অল্পশিক্ষিত বটে, প্রকৃতির শিক্ষায় তো তিনি প্রাচীন গাছেরই মতো দাঁড়িয়ে আছেন। স্থানীয় মাস্টারমশাইরা একদিন বেড়াতে এসে আবিষ্কার করেন সোনম ওয়াংদির কবিতা। রিম্বিকের দিকে মাঝেমধ্যে কাব্যসভা বসে, সোনমজির ডাক পড়ে কবিতা পড়তে সেসব আসরে- বেশ গর্বভরে বুড়োর ছোটো মেয়ে ছোড়েন আমাদের পাশ থেকে জানাতে ভোলে না। সোনমজির সঙ্গে কথা হয় ভাষা নিয়ে। তাঁরা যে ভাষায় কথা বলেন তাতে তিব্বতি ভাষার প্রভাবই বেশি। তবে ক্রমশ নেপালির প্রভাব বাড়তে থাকায় তিনি সে ভাষাকেই প্রকাশমাধ্যম করেছেন। দূরে ছোট্ট নেপালি জনপদ টুমলিংসোনমজির এক ছেলে বৌদ্ধ লামা, সন্ন্যাসী কিন্তু গৃহী। তিন বছর, তিন মাস, তিন সপ্তাহ, তিন দিন, তিন ঘণ্টা, তিন মিনিট, তিন সেকেন্ড এক গুম্ফায় ধ্যানে বসেছিলেন তিনি। ধ্যান ভেঙে গার্হস্থ্য বেছে নেন, তবে, এই চর্যার কারণে বৌদ্ধ পুরোহিত হিসেবে তার বেশ পরিচিতি। আর ছোড়েন এর মা চলে গেছেন অল্প বয়সে, তাই সে বাবার পাশে পাশে রয়ে গেছে সারাজীবন ছায়ার মতন। কবিতা লেখা ছাড়বেন না কিন্তু আপনি, সোনমজি- আসার সময় জড়িয়ে ধরে বুড়োকে বলে আসি।সাদা সারসের মতো গাছভরা ম্যাগনোলিয়াআমরা যাবো এবার পুরোদস্তুর ট্রেকপথে ধোত্রে থেকে গহীন অরণ্যের ভেতর দিয়ে টংলু হয়ে টুমলিং। ঢুকে পড়বো নেপালে। সঙ্গে গরম জামাকাপড় যথেষ্ট আনা হয়নি, তাই টুমলিংয়ে রাত কাটানোর ইচ্ছেয় দাঁড়ি দিয়েছি। অর্থাৎ যাওয়া এবং ফেরা, ফের ১৪ কিলোমিটার হাঁটা। এবং সে হাঁটা আরও তো অনির্বচনীয়। মার্চ-এপ্রিলে তো ছুটি থাকে না সাধারণত, তাই পাহাড় যখন লাল হয়ে থাকে রডোডেনড্রনে, আমরা দক্ষিণবঙ্গের গরমে সেদ্ধ হই। এবার সেই লোভেই আসা, অথচ কোত্থাও রডোডেনড্রন গাছে ফুল নেই, সবে কুঁড়ি দেখা দিয়েছে, অর্থাৎ এবছর লেট ব্লুম হবে। ধোত্রে থেকে টংলু আড়াই হাজার ফুটের মতো উঁচু। যত উপরে উঠলাম আশা পূর্ণ হতে থাকলো আমার। দেখা মিললো লাল-গোলাপি-সাদা রডোডেনড্রনের। বৃক্ষভরা থোকা থোকা ম্যাগনোলিয়া, যেন ডালে ডালে সাদা সারস ফুটে আছে। চেরি ব্লসমের মিষ্টিরঙা ফুল এদিক-ওদিক। ঘনঘোর মস আর ফার্নে, ফুলের ঝরা পাপড়ি আর খসে পড়া বুনোফলে আকীর্ণ পথ পৌঁছে দেয় হুই উপরে, টংলুতে, যেখান থেকে নাকি আবহাওয়া পরিষ্কার থাকলে আকাশজুড়ে দেখা দেন ঘুমন্ত বুদ্ধ- চিরতুষারের কাঞ্চনজঙ্ঘা পরিবার। এই এপ্রিলদুপুরে আকাশ তেমন নয়, কিন্তু তাতে কী! টংলুর উপর থেকে নিচে তাকাই, থাকে থাকে সিঙ্গালিলার জঙ্গলে রং খেলছে লাল-সাদা-গোলাপি-হলুদ-সবুজ আরও কতো! রডোডেনড্রনে ছাওয়া পথ। স্থানীয় নাম গুরাশ।টংলু-টুমলিং অনেকেই গেছেন। পাহাড়ের পিঠের ওপর দিয়ে টংলু থেকে টুমলিং – ওই সামান্য দুই কিলোমিটার রিজ ট্রেকটা যে কী সুন্দর! পাল্টে গেল ল্যান্ডস্কেপ, উচ্চতার সঙ্গে সঙ্গে যেমন যায়। ঘাসের হলুদ রং আর গাছের কালচে। তিনটে ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে। জামাকাপড় কেচে পিঠের ঝুড়িতে করে বয়ে টংলুতে নিয়ে আসছে একটি মেয়ে, বেদম হাওয়ায় দ্রুত শুকিয়ে নেওয়া যাবে। যেন হৃদয়ে হাত রাখা কোনো সিনেমার ছবি। মনের ভেতরে তখন সেই নেপালি গানটা, পাঁচ বছর আগে গোয়েচালা ট্রেকে গিয়ে যা শিখেছিলাম, ট্রেকপথের জাতীয় সঙ্গীত- ‘রেশম ফিরিরি… রেশম ফিরিরি/উড়েরা জাওংকি ডারামা বানজাং… রেশম ফিরিরি’ – রেশমের মতো উড়ছি এই হাওয়ায়/উড়েই যাবো নাকি বসবো এই পাহাড়ে, বুঝতে পারছি না যে!নাম না জানা পাহাড়ি ফুলটুমলিং এর একটা দোকানে চা খেতে খেতে মনে হলো, আরে এখানে কিন্তু আমার মিথ্যুক দেশনেতার ভার আর নেই! ভারি অদ্ভুত জায়গা তো! এঁরা সরকারিভাবে থাকেন নেপালে, ভোট দেন ভারতে। গণ্ডগোল কিছু ঘটলে ভারতের সুখিয়াপোখরি আর নেপালের জৌভরি দুই থানা থেকেই পুলিশ আসে। কোথাও কোনো কাগজপত্র দেখানোর বালাই নেই, ভারি মিলিটারি বুটের শব্দ নেই, অশান্তিও নেই। ভাবি, পৃথিবীর সব সীমান্তই যদি এমন সহজসরল হতো!পাহাড়ের প্রত্যেক ডেরায়, সে যত সামান্যই হোক, সামনে এক সারি সাকুলেন্ট আর ফুলের গাছ থাকেই। ছোড়েন আমাদের দার্জিলিং ফেরার গাড়িতে উঠিয়ে দেওয়া অবধি দাঁড়িয়ে ছিল। তার কাছ থেকে চেয়ে এনেছি সাকুলেন্ট এর চারা। দেখি, আমাদের মিথ্যেকথার সমতলে তাকে বাঁচাতে পারি কিনা!