সোলায়মান মারুফ : ধান-চালের বাজারে সরকারের তেমন নিয়ন্ত্রণ নেই। মূলত সরকারের পক্ষে ধান-চালের পর্যাপ্ত সংগ্রহ ও মজুদের অভাবেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আর তার সুযোগ নিচ্ছে অসাধু চক্র। তারা একদিকে যেমন কৃষককে ধান-চালের ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত করছে, অন্যদিকে সাধারণ মানুষের পকেট কেটে বিপুল মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছে। সাড়ে ১৬ কোটি জনসংখ্যার এই দেশে সরকার চালের চাহিদার মাত্র ৬ শতাংশ সংগ্রহ করছে। আর সেটা প্রতিবছর ২০ থেকে ২২ লাখ টন। চলতি অর্থবছরে সরকার ধান-চাল সংগ্রহে বড় ধরনের হোঁচট খেলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকারি মজুদ একটু একটু করে বাড়ানো হচ্ছে। তবে তা চাহিদার তুলনায় কম। আর দুর্বলতার কারণেই বাজারে সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকছে না। ব্যবসায়ীদের হাতে বাজার জিম্মি হয়ে পড়ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারের আপৎকালীন ধান-চালের মজুদ ৫০ লাখ টন হওয়া জরুরি। সেক্ষেত্রে সরকার নিবন্ধন পদ্ধতিতে কৃষকদের থেকে সরাসরি ধান কিনতে পারে। পাশাপাশি মিলারদের মাধ্যমে চাল প্রক্রিয়া করে সংরক্ষণের কর্মকৌশলও নির্ধারণ করতে হবে। তাছাড়া বাজার নিয়ন্ত্রণ ও সাধারণ মানুষের ন্যায্যমূল্যে চাল কেনার সুযোগ নিশ্চিত করতে রেশন কার্ড বা নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় নিম্ন আয়ের মানুষকে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে ধান-চালের বাজার স্থিতিশীল করা সম্ভব। বাজার ও কৃষিসংশ্লিষ্ট গবেষকদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ধান-চালে এদেশে বেশি মুনাফা করে মিল মালিক ও ব্যবসায়ীরা। বর্তমানে চাল উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। এখন অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও উৎপাদন প্রায় সমান সমান। তবে কোনো বছর সামান্য রপ্তানি হয় আবার কোনো বছর আমদানিও করতে হয়। কিন্তু সরকারের মজুদ কম থাকায় বাজার অস্থির হয়ে পড়ে। তখন চুক্তি করেও ব্যবসায়ীরা সরকারকে চাল দেয় না। বাজারে সরবরাহের ক্ষেত্রেও তারা নানা কৌশল অবলম্বন করে। বিগত ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে এবার বেশি দামে ধান-চাল বিক্রি বিক্রি হচ্ছে। বাজার অর্থনীতিতেও ব্যবসায়ীদের অনৈতিক কারসাজির মুখে সরকার যাতে জনস্বার্থে, বিশেষ করে গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষের স্বার্থে বাজারে হস্তক্ষেপ করতে পারে সেজন্য সরকারের হাতে পর্যাপ্ত মজুদ থাকা জরুরি। আর সঠিক কৌশলে মজুদ চালের বিতরণ বাড়িয়ে বাজার স্থিতিশীল করা সম্ভব। কিন্তু সরকারের সে সক্ষমতা থাকে না।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশে চালের বার্ষিক চাহিদা প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টন। কিন্তু দেশের বিপুলসংখ্যক কৃষকই উৎপাদনের ব্যয় মেটাতে ধান কেটে শুরুতেই বিক্রি করে দেয়। পরে আবার তারাই কিনে খায়। মিল মালিক ও ব্যবসায়ীরা কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনে মজুদ করে পুরো বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী প্রতি বছর প্রায় ২২ লাখ টন চাল মজুদ ও বিতরণ করা হয়। বোরো ও আমন মৌসুমে আলাদা চাল সংগ্রহ ও বিতরণ প্রক্রিয়ায় ১০ থেকে ১২ টন সরকারের কাছে বাস্তবিক মজুদ থাকে। এবার বোরো মৌসুমে সাড়ে ১১ লাখ টন চাল ও ৮ লাখ টন ধান এবং আমন মৌসুমে সাড়ে ৬ লাখ টন চাল ও ২ লাখ টন ধান কেনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু ওই দুই মৌসুম মিলে ৯ লাখ ৭৫ হাজার ৩৪৩ টন চাল সংগ্রহ হয়েছে। আমন মৌসুমে ১৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাত্র ৯ হাজার ৩৮৬ টন ধান ও ৬৫ হাজার ৪১৭ টন চাল সংগ্রহ করেছে সরকার। সর্বশেষ তথ্যে সরকারের মজুদ রয়েছে মাত্র ৫ লাখ ৩৮ হাজার টন, যা সারাদেশের চাহিদার মাত্র ৬ দিন মিটবে। মজুদের এমন নাজুক পরিস্থিতির কারণে ব্যবসায়ীরা বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। এখন মজুদ বাড়াতে আরো ১০ লাখ টন চাল আমদানি করছে সরকার। তবে বিশ্ববাজারে চাল আমদানি সহজ নয়। গত দুই মাসে মাত্র ৭১ হাজার ৭৭০ টন চাল আমদানি হয়েছে। বাজারে চালের সরবরাহ বাড়াতে বেসরকারি পর্যায়ে ১০ লাখ টন আমদানির অনুমতি দিয়েছে সরকার। সেজন্য ৭ জানুয়ারি চাল আমদানি শুল্ক ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। এখন পর্যন্ত বেসরকারিভাবে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৭৫০ টন চাল আমদানি হয়েছে। কিন্তু তাতেও বাজারে চালের দাম কমেনি। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যানুযায়ী, এখন বাজারে প্রতি কেজি মোটা চাল ৪৬ থেকে ৫০ টাকা, যা গত বছরের চেয়ে ২৬ শতাংশ বেশি। মাঝারি মানের চাল ৫২ থেকে ৫৮ টাকা ও সরু চাল ৬০ থেকে ৭০ টাকা, যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ১১ শতাংশ বেশি।
সূত্র আরো জানায়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী গত দুই মৌসুমে সরকারের ধান-চাল সংগ্রহ নীতি ব্যর্থ হয়েছে। ফলে দেশে পর্যাপ্ত চাল উৎপাদনের পরও আমদানি করতে হচ্ছে। সরকার মিল মালিকদের কাছ থেকে চালের বড় অংশ কিনছে। কিন্তু তা খুচরা ও পাইকারি বাজারে প্রভাব ফেলতে পারেনি। সরকার কৃষকদের কাছ থেকে উৎপাদিত ধানের মাত্র শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ সংগ্রহ করছে। সরকারের এতো কম পরিমাণ ক্রয় কৃষকের উৎপাদিত ধানের দাম বাড়াতে তেমন ভূমিকা রাখতে পারছে না। অথচ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা বাংলাদেশের চেয়ে সাড়ে ৬ কোটি কম। বাঙালি অধ্যুষিত ওই রাজ্য বছরে এ দেশের প্রায় দ্বিগুণ ধান কৃষকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়। নেপালের জনসংখ্যা বাংলাদেশের চার ভাগের এক ভাগ হলেও সেখানে ১৫ লাখ টন ধান কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি কেনা হয়। আর শ্রীলঙ্কার জনসংখ্যা বাংলাদেশের আট ভাগের এক ভাগ হলেও ওই তুলনায় কৃষকদের কাছ থেকে অনেক বেশি ধান কেনে। সম্প্রতি দেশে ধান-চালের উৎপাদন কোনো কোনো বছর চাহিদার চেয়ে বেশি হয়েছিল। সরকার রপ্তানির পরিকল্পনা করেছিল। আবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কোনো কোনো বছর উৎপাদনে ঘাটতি হয়েছে। গত বছর তেমন গেছে।
এদিকে দেশে ধান-চালের মজুদ বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সেজন্য গুদাম নির্মাণ করা হচ্ছে। দেড় লাখ টন ধান সংরক্ষণে প্রতিটি ৫ হাজার টন সক্ষমতার ৩০টি গুদাম নির্মাণ করতে প্রকল্প প্রস্তা করা হয়েছে। আরো এক লাখ ৬০ হাজার টন ধারণ ক্ষমতার গুদাম নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছে। শেষ পর্যায়ে নতুন ১৬২টি গুদাম নির্মাণ। তাছাড়া ৫ লাখ ৩৫ হাজার টন ধারণ ক্ষমতার ৮টি মডার্ন সাইলো নির্মাণ শুরু হয়েছে। সেগুলো শেষ হলে আরো ১১ লাখ টন সংরক্ষণের সক্ষমতা বাড়বে। সব মিলে তখন ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টন সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে।
অন্যদিকে বিশেষজ্ঞদের মতে, বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের ৪০ লাখ টন চাল মজুদ করা উচিত। তাছাড়া পশ্চিমবঙ্গের মতো কৃষকদের নিবন্ধন করে সরাসরি ধান কিনতে হবে। এখন মিল থেকে কেনায় মিলাররা গেম খেলছে। কিন্তু জরুরি প্রয়োজনে সরকারকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়ার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। এখন অনলাইন প্রক্রিয়ায় যাওয়া দরকার। পাশাপাশি ধান-চালের ক্ষেত্রে তিনটি জায়গায় নজর দেয়ার সময় এসেছে। প্রথমত, ভোগের চাহিদার পুনঃমূল্যায়ন প্রয়োজন। উৎপাদন, মজুদ ও বিতরণের সুনির্দিষ্ট হিসাব করা দরকার। ওই হিসাবে ভারসাম্যহীনতা রয়েছে। দ্বিতীয়ত, ধান-চাল সংগ্রহহ প্রক্রিয়া ত্রুটিযুক্ত। সেক্ষেত্রে সরকারের দুর্বলতা আছে। তৃতীয়ত, বাজার স্থিতিশীল রাখতে সমস্যা হলেই সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা করা যাবে না। সেক্ষত্রে খাদ্য, বাণিজ্যসহ ৮টি মন্ত্রণালয় জড়িত। সবাইকে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে।
এ প্রসঙ্গে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার জানান, সরকারের ধান-চাল সংগ্রহ ও মজুদ বাড়ানোর পরিকল্পনায় আরো গুদাম নির্মাণের প্রকল্প নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি এখন প্রান্তিক কৃষকের কাছ থেকে লটারির মাধ্যমে এবং কৃষক অ্যাপের মাধ্যমে ধান কেনা হচ্ছে, যা ভারতেও নেই। তবে ভারতে পূর্ণাঙ্গ রেশনিং ব্যবস্থা চালু আছে। আর এদেশে আংশিক রেশনিং আছে। তাছাড়া হতদরিদ্রদের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি আছে; কাবিখা, টিআর, ভিজিডি, ভিজিএফ, জিআরসহ অন্যান্য ব্যবস্থা চালু আছে। এখন সেগুলো অ্যাপসের মাধ্যমে করার চেষ্টা চলছে। তাতে প্রক্রিয়া আরো সহজ হবে। তবে সরকার যে পরিমাণ ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে, কৃষকরা তা সরবরাহ করেনি। কারণ বাজারে তারা ভালো দাম পাচ্ছে।