নিরাপত্তা ব্যবস্থা অনিশ্চিত ভবন নির্মাণে মৃত্যু বাড়ছে

নিরাপত্তা ব্যবস্থা অনিশ্চিত ভবন নির্মাণে মৃত্যু বাড়ছে

মোঃ আবু তালেব : রাজধানীসহ দেশজুড়েই গড়ে উঠছে বিপুলসংখ্যক বহুতল ভবন। কিন্তু ওসব ভবন নির্মানে নির্মাণ শ্রমিকদের দুর্ঘটনা এড়াতে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। ফলে প্রতিনিয়তই আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যুর সংখ্যা। এমনকি ওই দুর্ঘটনা থেকে পথচারীরাও রেহাই পাচ্ছে না। পাশাপাশি কেউ কেউ মারাত্মকভাবে আহত হয়ে পঙ্গুত্বের অভিশাপ নিয়ে অনেকে বেঁচে আছে। মূলত যথাযথ তদারকির অভাবে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিআইএলএস) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, গত ৬ বছরে রাজধানীতে নির্মাণ খাতে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ৬২০ শ্রমিক নিহত হয়েছে। ওই সময় আহত হয়েছে ৫৭৮ শ্রমিক। তাদের মধ্যে অনেকেই পঙ্গুত্বের অভিশাপ নিয়ে বেঁচে আছে। রাজধানীসহ সারাদেশে প্রতিদিন গড়ে ৪০ লাখের মতো নির্মাণ শ্রমিক কাজ করছে। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হচ্ছে না। ফলে বহুতল ভবনে নির্মাণ শ্রমিকরা অরক্ষিত অবস্থায় কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। কারণ কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের কোন ধরনের জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয় না। ফলে নির্মাণ শ্রমিকদের পাশাপাশি আশপাশের মানুষ ও ভবনের নিচের পথচারীরা নিরাপত্তাহীনতায় থাকে। এককথায় নির্মাণ শ্রমিকরা আইনি সুরক্ষা পাচ্ছে না। মূলত সরকার ও মালিকপক্ষের অবহেলার কারণে নির্মাণ খাতে শ্রমিক মৃত্যু ও হতাহতের সারি দিন দিন দীর্ঘতর হচ্ছে।
সূত্র জানায়, জাতীয় বিল্ডিং কোডে কর্মকালীন একজন শ্রমকের কী কী নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে তার বিস্তারিত উল্লেখ থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। আর বিষয়টি তদারক করার দায়িত্ব যাদের, তারাও উদাসীন। ফলে নিরাপত্তা উপেক্ষিত থাকায় প্রাণহানির সংখ্যা বাড়ছে। কর্মক্ষেত্রে কোনো শ্রমিক মৃত্যুবরণ করলে আগে এক লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিধান ছিল। তবে ২০১৮ সালের শ্রমিক আইন মৃত্যুর কারণে শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দ্বিগুণ করে ২ লাখ টাকা করা হয়েছে। আহত হয়ে স্থায়ীভাবে অক্ষম হলে ক্ষতিপূরণের টাকাও দ্বিগুণ করা হয়েছে। আগে ওই ক্ষতিপূরণ ছিল এক লাখ ২৫ হাজার টাকা। এখন তা বাড়িয়ে আড়াই লাখ করা হয়েছে। ২০১৪ সালের জাতীয় বিল্ডিং কোড অনুযায়ী কাজের সময় কাজের শ্রমিকের মাথায় হেলমেট পরা বাধ্যতামূলক করা হয়। তাছাড়া যারা কংক্রিটের কাজে যুক্ত তাদের হাতে গ্লাভস ও চোখের জন্য ক্ষতিকর কাজে শ্রমিকদের চশমা ব্যবহার পরিধান করতে হবে। ওয়েল্ডার ও গ্যাস কাটার ব্যবহারের সময় রক্ষামূলক সরঞ্জাম যেমন গ্লাভস, নিরাপত্তা বুট, এ্যাপ্রোন ব্যবহার করতে হবে। তাছাড়া ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডে ভবনের ওপরে কাজ করার সময় শ্রমিকদের নিরাপত্তায় বেল্ট ব্যবহারও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু তার কোনটিই বাস্তবে দেখা যায় না। ভবন মালিকপক্ষের ওসব নিরাপত্তা সরঞ্জামাদি নিশ্চিত করার দায়িত্ব। যদিও কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তার জন্য যথেষ্ট আইন রয়েছে। কিন্তু ওই আইনের প্রয়োগ হচ্ছে না। বর্তমানে আইনের ১০ শতাংশও সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে নিরাপদ হচ্ছে না নির্মাণ খাত। তাতে দুর্ঘটনায় মৃত্যু মিছিল বাড়ছে। আর পার পেয়ে যাচ্ছে মালিক পক্ষ। তা দেখার কেউ নেই।
সূত্র আরো জানায়, রাজধানীতে কী পরিমাণ ভবন ঝুঁকি নিয়ে নির্মাণ হচ্ছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে তার কোন সঠিক তথ্য নেই। রাজউকের দাবি, তারা বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ভবন নির্মাণ হচ্ছে কিনা সে বিষয়টি দেখছে। তবে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের নির্মাণের ক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখাশোনার মূল দায়িত্ব। আর কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতর সংশ্লিষ্টদের দাবি, কোন ভবনে নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে নির্মাণ করা হচ্ছে প্রথমে ওই সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে ভবন মালিককে চিঠি দেয়া হয়। তাতে সমাধান না হলে দ্বিতীয় চিঠি দেয়া হয়। তারপরেও সমাধান না হলে তৃতীয় চিঠি দিয়ে কোর্টে মামলা করা হয়। কিন্তু বিষয়টিতে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা নেই। ফলে তাৎক্ষণিক কোন ব্যবস্থা নেয়া যায় না। আর কোর্টে মামলা হলে তাতে একটু দীর্ঘ সময় লেগে যায়। সেজন্য আইন প্রয়োগের ক্ষমতা দরকার। তাছাড়া জনবলের অভাব কারণেও নির্মাণ খাতের শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি ঠিকমতো তদারকি করা যাচ্ছে না। সেজন্য ২০ হাজার জনবল দরকার। কিন্তু সেখানে মন্ত্রণালয় থেকে ৩ হাজার জনবল চাওয়া হয়েছে। তার অনুমোদন পেলে হয়তো সমস্যার কিছুটা সমাধান হবে। ইতিমধ্যে তৈরি পোশাক শিল্পের (আরএমজি) পাশাপাশি নির্মাণ খাদকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। কারণ এ খাতে মৃত্যু বেশি ঘটছে।
এদিকে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিআইএলএস) তথ্যমতে, গত ৬ বছরে রাজধানীতে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ৬২০ শ্রমিক নিহত এবং ৫৭৮ জন আহত হয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকেই পঙ্গু জীবনযাপন করছে। তার মধ্যে ২০১৫ সালে ৬১ জন, ২০১৬ সালে ৮৫ জন, ২০১৭ সালে ১৩৪ জন, ২০১৮ সালে ১৬১ জন, ২০১৯ সালে ১৩৪ জন এবং ২০২০ সালের আগস্ট পর্যন্ত ৪৫ জন নিহত হয়েছে। প্রতিবছরই দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়ছে। আর ২০০২ সাল থেকে ২০২০ পর্যন্ত ১৯ বছরে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় এক হাজার ৭০৬ শ্রমিক নিহত হয়েছেন। মূলত ভাল সিঁড়ির অভাব ও সিঁড়িতে পর্যাপ্ত আলোর অভাব, এলোমেলোভাবে রড, বালু ও ইট রাখা, কর্মক্ষেত্রে নেট না থাকা অথবা নাজুক নেটের ব্যবহার, কপিকলের ব্যবস্থা না থাকা, হেলমেট, গ্লাভসের ব্যবস্থা না করা, খালি পায়ে কাজ করা, অসাবধানতা ও অসচেতনভাবে আবদ্ধ স্থানে প্রবেশ, প্রচণ্ড রোদে কাজ করা, ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্রপাতির ব্যবহার, বিশ্রাম কম, দুর্বল মাচা, দেয়াল বা মাটি চাপা পড়া, ঝুলন্ত অবস্থায় কাজের সময় বেল্ট ব্যবহার না করা, ভাল জুতা বা বুট ব্যবহার না করা, আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব ও ত্রুটিপূর্ণ বৈদ্যুতিক লাইনের কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। দুর্ঘটনার মধ্যে ওপর থেকে পড়ে মৃত্যু, ওপর থেকে পড়ে অঙ্গহানি, মাটিচাপা পড়ে মৃত্যু, বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনায় মৃত্যু, মাটি বহনকারী গাড়ি দুর্ঘটনা, অগ্নিদগ্ধ হওয়া, চোখে আঘাত লাগা বা অন্ধ হয়ে যাওয়া, মাথায় আঘাত পাওয়া, হাত, পা কেটে বা ভেঙে যাওয়া ও আবদ্ধ গ্যাসে মৃত্যু হচ্ছে।
অন্যদিকে সংশ্লিষ্ট শ্রমিক সংগঠন জানায়, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা রোধ করতে তদারকি সংস্থা কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতর এবং রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) একটু নজরদারি ব্যবস্থা নিলে শ্রমিক দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব। অথচ কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে তাদের কার্যক্রম মালিকপক্ষের সঙ্গে চিঠি চালাচালিতেই সীমাবদ্ধ। তাতে নির্মাণ খাতের সঙ্গে জড়িত শ্রমিক ও সাধারণ পথচারীরা ক্ষুব্ধ।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নির্মাণ শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সরকারের ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের সদস্য শেখ মোহাম্মদ নুরুল হক জানান, নির্মাণ শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্র কখনোই নিরাপদ ছিল না। আইনে যা যা বলা আছে বর্তমানে তার মাত্র ১০ শতাংশ বাস্তবায়ন হচ্ছে। এটাকে কমপক্ষে ৭০ শতাংশ যাতে নিশ্চিত করা হয় তার দাবি জানাচ্ছি। আইন যদি কড়াকড়িভাবে বাস্তবায়ন করা হয় তাহলে আশা করা যায় কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের মৃত্যু শূন্যে নেমে আসবে। এজন্য শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্র তদারকির দায়িত্ব থাকা প্রতিষ্ঠান কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের সক্ষমতা আরো বাড়াতে হবে।
একই প্রসঙ্গে বিআইএলএসের পরিচালক কোহিনূর মাহমুদ জানান, নির্মাণ খাতের বড় বড় ফার্ম কিছুটা নীতিমালা মেনে চলে। সেক্ষেত্রে ছোট ছোট কিংবা ব্যক্তি মালিকানাধীন ভবনগুলো ওই নীতিমালা মানতে চায় না। ফলে সেখানে ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। অনুসন্ধান করে দুর্ঘটনার যে সংখ্যা পাওয়া যাচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে তা অনেক বেশি। সেক্ষেত্রে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদফতরকে আরো শক্তিশালী করা জরুরি। ওই প্রতিষ্ঠান প্রধানের পদের নামই হচ্ছে ‘পরিদর্শক’। কিন্তু পরিদর্শনের জন্য যদি তার পর্যাপ্ত ক্ষমতা না থাকে তাহলে সেখানে আইনের প্রয়োগ কীভাবে হবে? তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দেয়া উচিত।

Leave a reply

Minimum length: 20 characters ::

More News...

পবিপ্রবি র‌্যাগিংয়ে আহত পাঁচ শিক্ষার্থী হাসপাতালে ভর্তি

বড়াইগ্রামে নির্যাতিত আ’লীগ কর্মীর বাড়িতে বিএনপি’র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী