নিজস্ব প্রতিবেদক ;মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরে একটি ডেডিকেটেড এলপিজি টার্মিনাল স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি)। দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দরের বহুমুখী ব্যবহারের সম্পূর্ণ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতেই সেখানে গড়ে তোলা তিনটি পৃথক টার্মিনাল হবে। সেগুলো হচ্ছে কয়লা আমদানির জন্য কয়লা টার্মিনাল, এলএনজি আমদানির জন্য এলএনজি টার্মিনাল এবং এলপিজি আমদানির জন্য এলপিজি টার্মিনাল। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ এবং বিপিসি সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরে এলপিজি টার্মিনাল স্থাপনের জন্য বিপিসি দুটি জাপানী কোম্পানির কাছ থেকে প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। তবে ওই প্রস্তাবগুলো মূল্যায়নের জন্য নির্ধারিত কোন মাপকাঠি বা ক্রাইটেরিয়া না থাকায় বিপিসি কিংবা জ্বালানি বিভাগ সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। তাছাড়া প্রস্তাবিত এলপিজি টার্মিনালের জন্য কোন সম্ভাব্যতা সমীক্ষাও পরিচালনা করেনি বিপিসি কিংবা জ্বালানি বিভাগ। এমন পরিস্থিতিতে জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞদের অভিমত, প্রয়োজনীয় যোগ্যতার মানদণ্ড নির্ধারণ এবং কোন সম্ভাব্যতা পরীক্ষা করা ছাড়া এ ধরনের গ্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন ভবিষ্যতে নানা জটিলতা ও ঝুঁকির সৃষ্টি করতে পারে।
সূত্র জানায়, জাপানী উন্নয়ন সংস্থা জাইকার অর্থায়নে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর এবং এর টার্মিনালগুলো নির্মিত হবে। প্রধানমন্ত্রী গত বছর জাপান সফরকালে জাপান সরকার ওসব প্রকল্পে অতিরিক্ত ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দেয়। পাশাপাশি এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে একটি প্রতিশ্রুতি আদায় করে যে, ওই টার্মিনাল প্রকল্পগুলো জাপানি কোম্পানির বিনিয়োগের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে। বাংলাদেশ সরকার পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) ভিত্তিতে ওই প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব জ্বালানি বিভাগের অধীন রাষ্ট্রীয় তেল আমদানিকারক সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনকে দেয়। ওই প্রেক্ষিতে সম্প্রতি জাপানী কোম্পানি মিতসুইয়ের নেতৃত্বে একটি কনসোর্টিয়াম বাংলাদেশ সরকারের কাছে একটি বিনিয়োগ প্রস্তাব পেশ করে। মিতসুই এ্যান্ড কোং লিমিটেডের নেতৃত্বাধীন কনসোর্টিয়াম বিল্ড-ওউন-অপারেট (বিওইউ) ভিত্তিতে ওই এলপিজি টার্মিনাল গড়ে তুলবে বলে প্রস্তাবে উল্লেখ করে। ওই কনসোর্টিয়ামে যুক্ত করা হয় এস কে গ্যাস নামে একটি কোরিয়ান কোম্পানিকে, যারা খুব বড় গ্যাস ক্যারিয়ারের মালিক (ভিএলজিসি)। একই সঙ্গে স্থানীয় পার্টনার হিসাবে এই অঞ্চলের বৃহত্তম এলপিজি অপারেটর ইস্ট কোস্ট গ্রুপকে যুক্ত করা হয়, যাদের বাংলাদেশে এলপিজিসহ ডাউন স্ট্রিম পেট্রোলিয়াম খাতে প্রায় ৩৫ বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, মিতসুই গ্রুপের সঙ্গে প্রায় দেড় বছরের দীর্ঘ আলোচনার পর জ্বালানি বিভাগ যখন একটি সম্ভাব্য চুক্তির জন্য চূড়ান্ত পর্যায় উপনীত হয়, ঠিক তখনই আশ্চর্যজনকভাবে দৃশ্যপটে উপস্থিত হয় জাপানের আরেকটি সংস্থা মারুবেণী কর্পোরেশন। তারা ভিটল নামে নেদারল্যান্ডস ভিত্তিক একটি কোম্পানিকে সঙ্গে নিয়ে পাল্টা একটি প্রস্তাব পেশ করে। মারুবেণী বা তার সহযোগী ভিটল আন্তর্জাতিক বাজারে এলপিজি সরবরাহ করলেও কখনো এ জাতীয় এলপিজির গভীর সমুদ্র টার্মিনাল নির্মাণ বা পরিচালনা করেনি। কিন্তু মারুবেণী কর্পোরেশনও ৩০ শতাংশ ইক্যুইটি দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। মারুবেণী ভিটল নামক যে সংস্থাকে অংশীদার হিসেবে সঙ্গে নিয়েছে তারা ২-৩ বছর ধরে বাংলাদেশে এলপিজি সরবরাহ করে আসছে। তবে প্রকল্প বাস্তবায়ন বা এ জাতীয় গভীর সমুদ্র টার্মিনাল নির্মাণ কিংবা পরিচালনার কোন অভিজ্ঞতা তাদের নেই।
এদিকে বিপিসি, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সঙ্গে এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে একাধিক বৈঠকের পর মিতসুই বিপিসির কাছে ৩০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের জন্য একটি প্রস্তাব জমা দেয়। যেখানে বিপিসির জন্য ৩০ শতাংশ ইক্যুইটি দেয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রস্তাবে আরো উল্লেখ করা হয়, ইস্ট কোস্ট গ্রুপ ভবিষ্যত আমদানিকৃত এলপিজি কিনে নেবে এবং এলপিজি টার্মিনাল থেকে অপারেটর টার্মিনালে পণ্য পরিবহনের জন্য ৬টি নতুন জাহাজ কিনতে অতিরিক্ত ১৫০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের গ্যারান্টি বা নিশ্চয়তা দেবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে জাইকা এ ধরনের একটি শর্ত যুক্ত করেছে।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের এক উর্ধতন কর্মকর্তা জানান, এখন উভয় জাপানী সংস্থা প্রকল্পটি পাবার জন্য চরম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে এবং সেজন্য তারা সরকারের শীর্ষ নীতিনির্ধারকদের নিজ নিজ পক্ষে টানার চেষ্টা করছে। তবে জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞদের মতে, এ প্রকল্প বাস্তবায়নে বিপিসির প্রথমে সম্ভাব্যতা যাচাই করার কাজ হাতে নেয়া উচিত এবং তার পর একটি সিলেকশন ক্রাইটেরিয়া বা উদ্যোক্তা নির্বাচন নীতিমালা তৈরি করে এলপিজি টার্মিনাল প্রকল্প বাস্তায়নের কাজে হাত দেয়া উচিত। বিশদভাবে প্রাক-সম্ভাব্যতা এবং সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা ছাড়া এ জাতীয় বৃহত্তম প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন কোন সুবিবেচনামূলক সিদ্ধান্ত হবে না। কারণ সেটি করা হলে তা বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রচুর ঝুঁকি ও ও চ্যালেঞ্জ তৈরি হতে পারে।