নিজস্ব প্রতিবেদক : গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত তিন জন রোগীর কথা জানায় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। তার ঠিক ১০ দিন পর করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যুর কথাও জানায় প্রতিষ্ঠানটি। সেদিন প্রতিষ্ঠানটির সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ৭০ বছর বয়সী রোগী ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি সমস্যা ও হৃদরোগে ভুগছিলেন। আবার কোভিডে আক্রান্ত রোগীরা আগে থেকে যেসব অন্যান্য জটিল রোগে ভুগছেন সেসব রোগের মধ্য প্রথম হচ্ছে ডায়াবেটিস, নিপসমের এক গবেষণায় এমন তথ্যই উঠে এসেছে। এরপর রয়েছে, উচ্চ রক্তচাপ, ফুসফুসের সংক্রমণ, কিডনি রোগসহ অন্যান্য রোগ। শুরু থেকেই ষাটোর্ধ্ব ও অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্তরা করোনার মৃত্যুঝুঁকিতেও বেশি বলে জানিয়ে এসেছেন চিকিৎসকরা। অন্যান্য জটিল রোগের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ডায়াবেটিস। ৫৭ বছরের আয়েশা খানম করোনাতে আক্রান্ত হওয়ার পর কোভিড ডেডিকেটেড এক হাসপাতালে ভর্তি হন। কিন্তু ডায়াবেটিস থাকার কারণে তিনি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। অক্সিজেন মাস্ক ছাড়া স্যাচুরেশন নেমে যায় ৭০-এর কাছাকাছি। ১৪ নভেম্বর ছিল বিশ্ব ডায়াবেটিক দিবস। এবারে ডায়াবেটিক দিবসের সঙ্গে বিশেষ গুরুত্ব বহন করেছে করোনা সংক্রমণের বিষয়টি। চিকিৎসকরা বলছেন, যে কয়েকটি অসুখে আগে থেকে আক্রান্ত থাকার করোনার ঝুঁকি কয়েকগুণ বেড়ে যায় তার মধ্যে ডায়াবেটিস অন্যতম। আন্তর্জাতিক জরিপ বলছে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের ডায়াবেটিস হলে তার মৃত্যুঝুঁকি সাত দশমিক তিন শতাংশ বেশি। তবে আমাদের দেশে এখনও আক্রান্তদের কত শতাংশ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, তাদের কত শতাংশ মারা গেছেন তার তথ্য-উপাত্ত এখনও পুরোপুরি পাওয়া যায়নি। তারপরও করোনায় আক্রান্তদের মধ্যে যারা হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন, তাদের একটা বড় অংশই ডায়াবেটিসের রোগী, বলছেন চিকিৎসকরা। আন্তর্জাতিক কয়েকটি জরিপের কথা উল্লেখ করে গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজের অ্যান্ডোক্রাইনলোজি অ্যান্ড মেটাবোলিজম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. তানজিনা হোসেনবলেন, করোনা আক্রান্ত হয়েছেন এমন রোগীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ অন্যান্য রোগের মধ্যে হৃদরোগ এক নম্বর, দুই নম্বরে কিডনি রোগ আর তিন নম্বরেই রয়েছে ডায়াবেটিস। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে ডা. তানজিনা হোসেন বলেন, আমার হাসপাতালে যত রোগী ভর্তি হন, তাদের মধ্যে শতকরা ৬০ শতাংশই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। অর্থাৎ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীরা কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার পর তাদের অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। তাদের হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে, অক্সিজেন লাগছে, তারাই আইসিইউতে যাচ্ছেন। আবার ডায়াবেটিসের কারণেই হৃদরোগ, কিডনি রোগ, উচ্চ রক্তচাপের মতো অসুখে আক্রান্ত হন, সব মিলিয়ে করোনা আক্রান্ত হলে এসব রোগীই সবচেয়ে ঝুঁকিতে পড়েন। যাদের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার পরও একে নিয়ন্ত্রণে রেখে জীবন যাপন করছেন, তারা করোনা আক্রান্তের কারণে ঝুঁকিতে পড়ছেন। ডায়াবেটিস রোগীদের করোনা হলে তাদের অবস্থা ‘টালমাটাল’ অবস্থায় থাকে বলে মন্তব্য করেন ডা. তানজিনা হোসেন। তিনি বলেন, এই রোগীদের স্টেরয়েড দেওয়ার কারণে সুগার বেড়ে যায়। সব মিলিয়ে তাদের ডায়াবেটিস টালমাটাল হয়ে যায়, খুব ফ্ল্যাকচুয়েট করে, অনেক বেড়ে যায়। যাদের আগে নিয়ন্ত্রিত ছিল তাদের ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়। কারও কারও আবার সুগার কমে যায়, বিভিন্ন ধরনের সমস্যার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় তাদের। আর সে সময় ডায়াবেটিসের যদি ঠিকমতো ম্যানেজমেন্ট না করা যায়, তাহলে মৃত্যুঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। কিন্তু করোনায় আক্রান্ত হওয়া ডায়াবেটিস রোগীদের ম্যানেজ করা খুব জটিল হয়ে যায় জানিয়ে ডা. তানজিনা হোসেন বলেন, খাবারে স্বাদ-রুচি না থাকার কারণে তারা ঠিকমতো খেতে পারেন না, সে কারণে সুগার কমে যায়। আবার স্টেরয়েডের কারণে সুগার বেড়ে যায়, ইনফেকশন নিজেই আবার সুগার বাড়ায়, যার কারণে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের ম্যানেজ করতে খুব বেগ পেতে হয় আমাদের। তাই যারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত তাদের প্রতি বিশেষভাবে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, বাইরে বের না হওয়ার পরামর্শই থাকবে, কিন্তু যদি বিশেষ প্রয়োজনে বের হতেই হয় মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, জনসমাগমে না যাওয়ার মতো স্বাস্থ্যবিধি অবশ্যই মেনে চলতে হবে। পরিবারে যিনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, তাদের অন্যান্যের তুলনায় বিশেষভাবে দেখভাল করার কথা বলেন ডা. তানজিনা হোসেন। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য সচেতনতা অনেক বেশি দরকার, যোগ করেন তিনি। অতি সম্প্রতি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব প্রিভেন্টিভ অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিন (নিপসম) ‘বাংলাদেশে কোভিড আক্রান্তদের ঝুঁকিগুলোর কারণ নির্ধারণ’ বিষয়ে গবেষণা করেছে। সেখানে তারা বলছে, করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর জন্য ধোঁয়াবিহীন তামাকের ব্যবহার, ফুসফুসের দীর্ঘস্থায়ী সংক্রমণসহ অন্যান্য রোগের সহাবস্থান দায়ী। ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, দীর্ঘমেয়াদি কিডনি, লিভার ও ক্যানসারের কথাও উঠে এসেছে গবেষণাতে। নিপসম পরিচালক অধ্যাপক ডা. বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজবলেন, কোভিড আক্রান্তদের মধ্যে অধিকাংশই পুরুষ, বয়স্ক, বিবাহিত, চাকরিজীবী, শহুরে এবং শিক্ষিত জনগোষ্ঠী। তিনি বলেন, করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ১৪ দিন পরও যারা অসুস্থ রয়েছেন, তার মধ্যে প্রধান কারণ সিওপিডি অর্থাৎ দীর্ঘদিন ধরে যারা ফুসফুসের সংক্রমণে ভুগছেন। আবার ১৪ দিন পর যারা মারা গেছেন, তাদের বেশিরভাগই ষাট বা ষাটোর্ধ্ব। ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারকারী, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি রোগ অথবা ক্যানসারে আক্রান্ত। আবার ২৮ দিন পরেও যারা মারা যাচ্ছেন, তাদের রিস্ক ফ্যাক্টরগুলোও এগুলোই, এখানেও ডায়াবেটিস কারণ হিসেবে কাজ করেছে। যেসব করোনা আক্রান্ত রোগীকে জরিপে নেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে ৩৫ শতাংশের সহরোগ ছিল ডায়াবেটিস। এরপর ছিল উচ্চ রক্তচাপ এবং তৃতীয়ত তাদের ছিল ফুসফুসের জটিলতা। আবার ১৪ দিন শেষে বেঁচে গেছেন কিন্তু ডায়াবেটিস ছিল, এ ধরনের রোগীর সংখ?্যা ১৬ দশমিক পাঁচ শতাংশ মন্তব্য করেন ডা. বায়জীদ খুরশীদ। তিনি বলেন, কিন্তু ১৪ দিন শেষে মারা গেছেন এবং ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন এমন ব্যক্তির সংখ্যা ৩৯ দশমিক এক ভাগ। আবার ২৮ দিন শেষে বেঁচে আছেন, কিন্তু ডায়াবেটিস ছিল এমন মানুষের সংখ্যা ১৭ দশমিক দুই শতাংশ। আর ২৮ দিন শেষে মারা গেছেন ডায়াবেটিস ছিল, এমন রোগীর সংখ্যা ৩৬ দশমিক শূন্য শতাংশ। করোনায় যারা আক্রান্ত হচ্ছেন এবং যাদের মৃত্যু হচ্ছে তাদের যেসব রিস্ক ফ্যাক্টর চিহ্নিত করা হয়েছে, সেসব প্রোটোকল রিভিজিট করার কথা বলেন ডা. বায়জীদ খুরশীদ। একইসঙ্গে যাদের কোমরবিটি বা সহরোগ রয়েছে, তাদের প্রতি স্পেশাল কেয়ার নেওয়ার কথা বলেন তিনি।