আবুল কালাম আজাদ,রাজশাহী:জুলাই অভ্যুর্থানের পর সাধারন ট্রেন যাত্রীরা তিন মানদণ্ডে রেলের উন্নতি প্রত্যাশা করেছিলেন । কিন্তু বাংলাদেশ রেলওয়েতে এ পর্যন্ত পাঁচ স্টেশন ও এক সেতুর নাম ছাড়া কিছুই বদলায়নি রেলে।
সময় মেনে ট্রেন চলবে, ভ্রমণকালে সেগুলো থাকবে পরিচ্ছন্ন আর বন্ধ হবে টিকিট কালোবাজারি। জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ রেলওয়ের কাছ থেকে মোটা দাগে এ তিন মানদণ্ডে রেলের উন্নতি প্রত্যাশা করেছিলেন সাধারণ যাত্রীরা।
সময় মেনে ট্রেন চলবে, ভ্রমণকালে সেগুলো থাকবে পরিচ্ছন্ন আর বন্ধ হবে টিকিট কালোবাজারি। জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ রেলওয়ের কাছ থেকে মোটা দাগে এ তিন মানদণ্ডে রেলের উন্নতি প্রত্যাশা করেছিলেন সাধারণ যাত্রীরা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গড়ে ওঠা অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাস পার হলেও রেলওয়ের পরিষেবায় অবশ্য দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন আসেনি। প্রায়ই গড়বড় হচ্ছে ট্রেনের সময়সূচি। ট্রেনের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও টিকিট কালোবাজারি নিয়ে এখনো বিস্তর অভিযোগ যাত্রীদের। ছয় মাসে দুই জোড়া কমিউটার ও দুটি নিয়মিত ট্রেন চালু, পাঁচটি স্টেশন আর একটি সেতুর নাম পরিবর্তন ছাড়া দৃশ্যমান কোনো উন্নতিই হয়নি রেলে।
অন্তর্বর্তী সরকারের রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্বে রয়েছেন মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। সাবেক এ আমলা দায়িত্ব গ্রহণের পর ঢাকা-জয়দেবপুর রুটে দুই জোড়া কমিউটার ট্রেন ও চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে দুটি নিয়মিত ট্রেন চালু হয়েছে। যেসব রুটে যাত্রীর চাহিদা কম, সেগুলোয় কমিয়ে বেশি চাহিদার রুটে ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানোর লক্ষ্যে একটি কমিটি করে দিয়েছেন উপদেষ্টা। এখন পর্যন্ত তিনটি সভা হলেও ‘রুট যৌক্তিকীকরণ’ প্রক্রিয়াটি কোনো কাঠামোই পায়নি বলে জানিয়েছেন কমিটির এক সদস্য।
এর বাইরে উপদেষ্টার নির্দেশে ট্রেনের টিকিট বিক্রির ওয়েবসাইটে কতজন সক্রিয় ব্যবহারকারী রয়েছেন, তা টিকিট প্রত্যাশীদের দেখানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছে সহজডটকম। এ সময়ে জামালপুরের জগন্নাথগঞ্জ আপার স্টেশনের নাম পরিবর্তন করে অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান তালুকদার, ময়মনসিংহের সুতিয়াখালী স্টেশনের নাম পরিবর্তন করে উমেদনগর, বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম স্টেশনের নাম পরিবর্তন করে পঞ্চগড়, বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব স্টেশনের নাম পরিবর্তন করে ইব্রাহিমাবাদ ও বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম স্টেশনের নাম পরিবর্তন করে সয়দাবাদ করা হয়েছে। আর যমুনা নদীতে সদ্যনির্মিত ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু’র নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে ‘যমুনা রেল সেতু’। মোটা দাগে এ ছাড়া রেল খাতে গত ছয় মাসে আর কোনো পরিবর্তন বা অগ্রগতি দেখা যায়নি।
বিপরীতে এ সময়ে রানিং স্টাফদের ধর্মঘটের কারণে ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে সারা দেশে রেল পরিষেবা বন্ধ থাকার মতো ঘটনা ঘটেছে। এখনো ট্রেনের সময়সূচি আগের মতোই। উল্টো ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে সময়ানুবর্তিতার হার হ্রাস পেয়েছে বলে তুলে ধরা হয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ের এক সভায়।
রেলের সময়সূচিতে উন্নতি না হওয়ার জন্য যদিও ইঞ্জিন (লোকোমোটিভ) ও কোচ সংকটকে দায়ী করেছেন উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘লোকোমোটিভ নেই। কোচ নেই। তাই সময়সূচি ঠিক করা যাচ্ছে না। কীভাবে রেলের সময়সূচিতে উন্নতি করা যায়, সে চেষ্টা আমরা করে যাচ্ছি।’
টিকিট প্রাপ্যতা আগের চেয়ে বেড়েছে বলে দাবি করে উপদেষ্টা বলেন, ‘আগে টিকিট একদমই পাওয়া যেত না। এখন টিকিটের সফটওয়্যারে কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে। রেলকর্মীদের রিজার্ভ বন্ধ করা হয়েছে। এর ফলে এখন কিন্তু সহজেই ট্রেনের টিকিট পাওয়া যায়।’
রেলের উন্নতিটা আসলে সময়সাপেক্ষ, এগুলো ছয় মাসে হওয়ার মতো কিছু নয় উল্লেখ করে ফাওজুল কবির বলেন, ‘কক্সবাজারগামী যাত্রীদের একটা চাহিদা ছিল, সেটা পূরণের জন্য আমরা দুটো ট্যুরিস্ট ট্রেন চালু করেছি। জয়দেবপুর থেকে একটা কমিউটার সার্ভিস চালু করা হয়েছে। আগামী ২৬ মার্চ থেকে নরসিংদী-ঢাকা রুটে চালু হবে একটি কমিউটার সার্ভিস। নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা রুটে আরেকটি কমিউটার সার্ভিস চালু করা হবে। এখন আমার তো একটা সম্পদের সীমাবদ্ধতা আছে। নতুন কোচ এলে, নতুন লোকোমোটিভ এলে আরো ট্রেন বাড়াব।’
তিনি আরো বলেন, ‘আগের তুলনায় বর্তমানে রেলওয়ে কারখানাগুলোর সক্ষমতা কিন্তু বেড়েছে। আর রেল রুট র্যাশনালাইজেশনের একটি উদ্যোগ আমরা গ্রহণ করেছি। তবে এখানে কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। যেসব জায়গায় ট্রেনের চাহিদা কম, সেই ট্রেনগুলো আমরা সরিয়ে নিতে চাইলে স্থানীয় মানুষের বাধার মুখে পড়ার শঙ্কা আছে। তারপরও চেষ্টা করছি, কম গুরুত্বপূর্ণ রুটে ট্রেন কমিয়ে ব্যস্ত রুটগুলোয় ট্রেনের সংখ্যা বাড়াতে।’
রেল পরিষেবায় উপদেষ্টা উন্নতির প্রচেষ্টার কথা বললেও অন্তর্বর্তী সরকার এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কিছু করে দেখাতে পারেনি বলে মত দিয়েছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. সামছুল হক। তবে এজন্য অন্তর্বর্তী সরকার নয়, তিনি দায়ী করেছেন বিগত সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলোকে। এ প্রসঙ্গে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. সামছুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আগের সরকার প্রচুর প্রকল্প নিয়েছে। কিন্তু সে অনুযায়ী লোকবল নিয়োগ দেয়া হয়নি। এখন এমন অবস্থা হয়েছে যে একটা জায়গায় সংস্কার করতে গেলে আরেক জায়গায় টান পড়ে। এ অবস্থায় যে সীমাবদ্ধতা দেখা যাচ্ছে, তা অন্তর্বর্তী সরকারের নয়। বরং আগের সরকারের ভুল পদক্ষেপের ফলে রেল এখন সংকটাপন্ন রোগীতে পরিণত হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘(অন্তর্বর্তী সরকার) এখানে হয়তো অনেক কিছু করতে পারত। কিন্তু যাদের দিয়ে করবে, সবাই একই মানসিকতার। সুবিধাবাদীরা এখনো রয়ে গেছে। সে হিসেবে আমি বলব, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার একটা উদ্যোগ অন্তর্বর্তী সরকার নিতে পারত। কিন্তু এক উপদেষ্টার ওপরে দেয়া হয়েছে বড় দুটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। উপদেষ্টা অনেক দক্ষ এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ডাক্তার যতই দক্ষ হোক, সময় না দিলে কিন্তু রোগী মারা যাবে।’
ঢাকা-গাজীপুর রুটে চালু করা কমিউটার ট্রেন পরিষেবাকে স্বাগত জানিয়ে অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, ‘গাজীপুরের যে কমিউটার ট্রেন চালু করেছে, সেটা কেমন ফাংশনিং করছে আমি জানি না। এটা মেট্রোরেলের মতো একটি পরিষেবা হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগ রয়েছে। তবে জয়দেবপুরের কমিউটার ট্রেন ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকারের রেল নিয়ে আর কোনো দৃশ্যমান উন্নতি দেখি না।