নিউজ ডেস্ক : বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রধান খাদ্যশস্য গম। কিন্তু রাশিয়া ও ইউক্রেনের পর ভারত গম রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে।ফলে দেশের বাজারে গমের দাম বেড়েছে। এজন্য বর্তমান সংকটকালে গমসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত ও স্থিতিশীল রাখাটাই এখন সরকারের মূল লক্ষ্য। বাজারে গমের কোনো ঘাটতি নেই। ভারত গম রপ্তানি বন্ধ করলেও বেসরকারিভাবে পাশ্ববর্তী দেশগুলোর জন্য একটা সুযোগ রেখেছে তারা। এবিষয়ে নতুন করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে চুক্তি করা নিয়ে কথা চলছে। বেসরকারিভাবে গম আমদানির ক্ষেত্রে সুযোগ দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়ে চিঠি লেখা হবে। পাশাপাশি বুলগেরিয়া থেকে ২ লাখ টন গম আনার আলাপ আলোচনা চলছে বলে খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।এ বিষয়ে সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ভারতসহ গম রপ্তানিকারক দেশগুলোর সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগ করে সরবরাহ চেইনটা সচল রাখতে হবে। বর্তমান এই পরিস্থিতি যে সহসা উঠে যাবে তা কিন্তু নয়। রপ্তানির ক্ষেত্রে এ ধরনের পরিস্থিতি বেশ কিছু দিন অব্যাহত থাকবে। ফলে বিকল্প উৎস থেকে বেসরকারি খাতকে আমদানির চেষ্টা করতে হবে।গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আমদানিকারকরা প্রয়োজনে ভবিষ্যৎ বাজার থেকে এখনই গম কিনে রাখতে পারেন। যেটা অন্যান্য দেশ যেমন চীন এটা করছে। এজন্য আগামী ৬ মাসের চাহিদা অভ্যন্তরীণ উৎপাদন এবং মজুদ পরিস্থিতি বিবেচনা করে বেসরকারি খাতের পাশাপাশি সরকারও ভবিষ্যৎ বাজারে কিছু বিনিয়োগ করতে পারে। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নিয়ম কানুন না থাকলে এবিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।তিনি বলেন, আগামীতে বৈশ্বিক পর্যায়ে গমের সরবরাহ সীমিত থাকবে। ফলে চাহিদার বিপরীতে দাম বাড়বে। এসবের ভেতরেও সরকারের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিৎ বাজারে পণ্য সরবরাহ স্থিতিশীল রাখা। আমদানি করে ও অভ্যন্তরীণ উৎপাদন যেটা হয় সেটা যাতে নিশ্চিত থাকে সে বিষয়গুলো সরকারকে নজরে রাখতে হবে।বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, ভারত গম রপ্তানি বন্ধ করেছে শুধু বেসরকারি পর্যায়ে। জিটুজি পর্যায়ে এখনও বন্ধ হয়নি। এখন আমাদের বেসরকারি গম আমদানিকারকদের ভারতের বাইরে বিকল্প সোর্সগুলো দেখতে হবে। ভারতসহ গম রপ্তানিকারক অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগ করতে হবে। আমরা কৃষি, খাদ্য, অর্থমন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে একটি সভা করে করণীয় নির্ধারণ করে কাজ করবো। আমরাও হয়তো একটি চিঠির মাধ্যমে অনুরোধ জানাবো যাতে বেসরকারি পর্যায়ে গম রপ্তানির বিষয়টি শিথিল করে বা বিবেচনা করে।কৃষি সচিব মো. সায়েদুল ইসলাম বলেন, দেশে বছরে ৭৫ লাখ টন গমের চাহিদা রয়েছে। এরমধ্যে ১৪ লাখ টনের মতো দেশে উৎপাদিন হয়। বাকিটা আমদানি করা হয় রাশিয়া, ইউক্রেন, ভারতসহ ৮ টি দেশ থেকে। ইউক্রেন রাশিয়ার পর ভারত গম রপ্তানি বন্ধ করায় চালের দামেও প্রভাব পড়েছে। আর আন্তর্জাতিক বাজারেও গমের দাম বেড়েছে। সে কারণে আমাদের দেশেও দাম বেড়েছে। আমরা গম উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিস্তু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। গমের চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন চেষ্টা করেও বেশি করতে পারবো না। কারণ আমাদের দেশে সব অঞ্চলে গম হয় না। শীত প্রধান অঞ্চলেই গম ভালো হয়।খাদ্য মন্ত্রণালয় মনে করছে, ভারত রপ্তানি বন্ধ করলেও বাংলাদেশ সরকার আমদানি করতে পারবে। তবে দুশ্চিন্তা বেসরকারি খাত আমদানি করতে পারবে কিনা তা নিয়ে। দেশের গমের বড় অংশই বেসরকারি খাত আমদানি করে।এ বিষয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব মুহাম্মদ মাহবুবর রহমান (বৈদেশিক সংগ্রহ) বলেন, ভারত গম রপ্তানি বন্ধে সরকারিভাবে কোনো সমস্যা হবে না। আমাদের সাড়ে ৬ লাখ টন গম প্রয়োজন সেটা ইতোমধ্যে টেন্ডার করা হয়েছে। আগামী জুন মাসের মধ্যে সব গম চলে আসবে। সোমবার ১৬ মে আসবে ৫০ হাজার টন এবং ২০ মে আসবে আরো ৫০ হাজার টন গম। বাকিগুলো আমরা জুনের মধ্যে পেয়ে যাব। ভারত থেকে আরও গম আনতে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে চুক্তি করা নিয়ে কথা চলছে।বেসরকারিভাবে আমাদের অনেক গম আমদানি করতে হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ভারত গম রপ্তানি বন্ধ করলেও বেসরকারিভাবে পাশ্ববর্তী দেশগুলোর জন্য একটা সুযোগ তারা রেখেছে। ফলে বেসরকারি খাতগুলো যদি যোগাযোগ করে তাহলে তারা দেবে হয়তো। আমরা একটি চিঠি লিখছি যা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়ে আমাদের অ্যামবাসির মাধ্যমে ভারত সরকারকে অনুরোধ জানাবো যাতে গম আমদানির ক্ষেত্রে আমাদের সুযোগ দেওয়া হয়।খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব বলেন, এই মুহূর্তে বাজারে গমের কোনো ঘাটতি নেই। আমাদের গমের সরবরাহ ভালো আছে। ভারত হঠাৎ করে রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ায় দাম একটু বেড়েছে। তবে সেটা বেশি দিন থাকবে না। আমরা ভারত ছাড়াও বুলগেরিয়া থেকে ২ লাখ টন গম আনার আলাপ আলোচনা চলছে। ইতোমধ্যে তারা আমাদের প্রস্তাবও দিয়েছে। চাইলেই আমরা বুলগেরিয়া থেকেও গম আমদানি করতে পারবো।মাহবুবর রহমান বলেন, রাশিয়া ইউক্রেন ছিল গমের সবচেয়ে বড় বাজার। যুদ্ধের কারণে সে বাজারগুলো বন্ধ। অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করবো। তারা হয়তো দিতে পারে। বেসরকারি খাত যদি গম আমদানির ব্যাপারে সহায়তা চায়, তাহলে লিখিতভাবে চাইতে হবে। আমরা অবশ্যই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সে চেষ্টা করবো। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে গত ১ জুলাই থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে মোট ৫৫ লাখ ৪৬ হাজার টন গম দেশে এসেছে। বাংলাদেশ মোট গম আমদানির ৬৩ শতাংশ রাশিয়া ও ইউক্রেন, ১৮ শতাংশ কানাডা এবং বাকিটা যুক্তরাষ্ট্র, আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়াসহ আটটি দেশ থেকে আমদানি করে। ভারত গম রপ্তানির ক্ষেত্রে অনিয়মিত। উৎপাদন বেশি হলেই দেশটি রপ্তানির দরজা খুলে দেয়। দুই বছর ধরে ভারত থেকে বেশি পরিমাণ গম আমদানি করছে বাংলাদেশ। যেমন ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশে আমদানি হওয়া মোট গমের ৪৫ শতাংশ রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে, ২৩ শতাংশ কানাডা থেকে, ১৭ শতাংশ ভারত থেকে এবং বাকিটা অন্য কয়েকটি দেশ থেকে এসেছে।এদিকে রাশিয়া গত ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে ইউক্রেনে হামলা চালানোর পর দেশ দুটি থেকে বাংলাদেশে গম আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ভারত থেকে আমদানি বাড়িয়ে দেন। গত ১ মার্চ থেকে ১২ মে পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশে ৬ লাখ ৮৭ হাজার টন গম আমদানি হয়। এ সময়ে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে কোনো গম আসেনি। ভারত থেকে এসেছে ৬৩ শতাংশ। বাকিটা এসেছে কানাডা, আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়াসহ অন্যান্য দেশ থেকে।সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, ঢাকার বাজারে গতকাল প্রতি কেজি আটার দাম ছিল ৩৮-৪৫ টাকা, যা এক বছর আগের তুলনায় ৩৪ শতাংশ বেশি। আর খোলা ময়দার কেজি ছিল ৫৬ থেকে ৬০ টাকা। এক বছরে খোলা ময়দার দাম বেড়েছে ৬৩ শতাংশ। ফলে দেশের বিস্কুট, রুটিসহ খাদ্যপণ্য ও হোটেল-রেস্তোরাঁয় রুটি-পরোটার দাম অনেকটাই বেড়ে গেছে।উল্লেখ্য, ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফরেন ট্রেড (ডিজিএফটি) গত শুক্রবার গম রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে এক প্রজ্ঞাপনে জারি করেছে। প্রজ্ঞাপনে নিজেদের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তারা রপ্তানিতে এ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এটি অবিলম্বে কার্যকর হবে। তবে দুটি ক্ষেত্রে রপ্তানি করা যাবে—১. ইতোমধ্যে খুলে ফেলা যেসব ঋণপত্র (এলসি) বাতিলযোগ্য নয়, তার বিপরীতে এবং ২. খাদ্য ঘাটতিতে থাকা দেশের সরকারের অনুরোধের বিপরীতে ভারত সরকার অনুমতি দিলে। এরপরই বাজারে গমের দাম বেড়েছে। চট্টগ্রামের বড় বাজার খাতুনগঞ্জে রোববার ভারতীয় গমের দাম কেজিপ্রতি ১ টাকা ৩৪ পয়সার মতো বেড়েছে। বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৪০ টাকা ১৯ পয়সা দরে।