ভেজাল-পোড়া তেল-মবিলের খাবার, রোগাক্রান্ত হচ্ছে মানুষ

ভেজাল-পোড়া তেল-মবিলের খাবার, রোগাক্রান্ত হচ্ছে মানুষ
সমাচার ডেস্ক ; ভেজাল খাদ্যপণ্যে সয়লাব বাজার। বাহারি শরবত, রকমারি খাবারে ‘ফুড গ্রেড’-এর নামে ব্যবহার করা হচ্ছে কারখানায় ব্যবহৃত রং।এসব রাসায়নিক উপাদান প্রয়োগে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি।পোড়া তেলে ভাজা হচ্ছে বেগুনি, পিঁয়াজু, চপ। ফলে কিডনি, লিভার, ক্যান্সার, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। রমজানে বেশি মুনাফার আশায় বেড়েছে অসাধু ব্যবসায়ীদের ভেজাল দৌরাত্ম্য।বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য (খাদ্যভোগ ও ভোক্তা অধিকার) মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘খাবারে ভেজাল মেশানো আমাদের দেশে ব্যবসায়ীদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এ অভ্যাস পরিবর্তনে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে, আমরা সেটাই করছি। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। ’
তিনি বলেন, আজ বেইলি রোডে অভিযান পরিচালনা করে ফিরলাম। আমরা গেলে তাড়াতাড়ি খাবার ঢেকে ফেলে। চলে আসার সঙ্গে সঙ্গেই আবার বিক্রি শুরু করে।

তিনি আরও বলেন, ‘জীবাণুমুক্ত খাবার পরিবেশনের জন্য খাবারের দোকানের কর্মীদের হাতের গ্লাভস, মাথার ক্যাপ দিয়েছি আমরা। কিন্তু সেগুলো ব্যবহার করেন না তারা। অনেকে বলে গরম লাগে, কেউ বলে খারাপ লাগে। ভোক্তাদেরও ব্যবসায়ীদের বলতে হবে খাবার ঢেকে রাখার কথা। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বিক্রি হওয়া খাবার কেনা থেকে বিরত থাকতে হবে। সবাই সচেতন না হলে শুধু কর্তৃপক্ষের চেষ্টায় নিরাপদ খাবার নিশ্চিত করা কঠিন। ’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, প্রতি বছর বিশ্বের প্রায় ৬০ কোটি মানুষ ভেজাল ও দূষিত খাদ্য গ্রহণের কারণে অসুস্থ হয়। এর মধ্যে মারা যায় ৪ লাখ ৪২ হাজার মানুষ। এ ছাড়া দূষিত খাদ্য গ্রহণজনিত কারণে পাঁচ বছরের কম বয়সের আক্রান্ত হওয়া ৪৩ শতাংশ শিশুর মধ্যে মৃত্যুবরণ করে ১ লাখ ২৫ হাজার।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু ভেজাল খাদ্য গ্রহণের কারণে প্রতি বছর দেশে ৩ লাখ লোক ক্যান্সারে, ২ লাখ লোক কিডনি রোগে, দেড় লাখ লোক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। এ ছাড়া গর্ভবতী মা ১৫ লাখ বিকলাঙ্গ শিশুর জন্মদান করেন। ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে দেশে হেপাটাইটিস, কিডনি, লিভার ও ফুসফুস সংক্রমিত রোগীর সংখ্যাও দিন দিন বেড়ে চলেছে।

২০১৫ সালে দিনাজপুরে কীটনাশক মিশ্রিত লিচুর বিষক্রিয়ায় আট শিশু এবং ২০১২ সালে ১৪ শিশুর প্রাণহানি ঘটে।

বিভিন্ন গবেষণায় দেশের অনিরাপদ খাদ্যের বিষয়টি বারবার উঠে এসেছে। পোলট্রি ফার্মের ডিমে ট্যানারি বর্জ্যের বিষাক্ত ক্রোমিয়াম পাওয়া গেছে। আটায় মেশানো হচ্ছে চক পাউডার বা ক্যালসিয়াম কার্বনেট। আনারসে হরমোন প্রয়োগ করে দ্রুত বৃদ্ধির প্রক্রিয়া চলে আসছে বহুকাল ধরে। মিষ্টি জাতীয় খাবারে ব্যবহার করা হয় বিষাক্ত রঙ, সোডা, স্যাকারিন ও মোম।

সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি (সিকেডি) হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত অধ্যাপক মো. কামরুল ইসলাম বলেন, ‘বাইরে থেকে কেনা খাবারে বিভিন্ন অস্বাস্থ্যকর উপাদান মেশানো হয়। শরীরের জন্য ক্ষতিকর রং, প্রিজারভেটিভ, ফরমালিন ব্যবহার করা হয়। মুখরোচক করার জন্য অতিরিক্ত তেল ব্যবহার করা হয়। এসব উপাদান মানুষকে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলে। লিভারের সমস্যার পাশাপাশি কিডনির ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় এসব খাবার। অনেক উপাদান দীর্ঘমেয়াদী ক্ষত তৈরি করে এবং দুরারোগ্য রোগ জন্ম দেয়। তাই এসব খাবার থেকে দূরে থাকতে হবে। বাড়িতে স্বাস্থ্যকর উপায়ে বানানো খাবার খাওয়ার অভ্যাস গড়তে হবে। ’

রমজান মাস এলেই ভেজাল ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য বাড়ে। ইফতারে সবচেয়ে বেশি অস্বাস্থ্যকর খাবার পরিবেশন করা হয়। মুড়ি সাদা করতে ব্যবহৃত হচ্ছে বিষাক্ত রাসায়নিক সোডিয়াম হাইড্রোসালফাইড। জিলাপি দীর্ঘক্ষণ মচমচে রাখতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে পোড়া মবিল। বেগুনি, পিঁয়াজু, চপ ইত্যাদি তেলেভাজা ইফতার সামগ্রী আকর্ষণীয় করতে ব্যবহার করা হয় কেমিক্যাল রং। ইফতারির সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও অপরিহার্য অনুষঙ্গ খেজুরেও এখন বিশ্বাস উঠে যাচ্ছে রোজাদারদের। কারণ মেয়াদোত্তীর্ণ, পচা দুর্গন্ধযুক্ত খেজুরে বাজার সয়লাব হয়ে আছে। কার্বাইড বা ফরমালিন মেশানো ফলমূলও এখন বড় আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে। কাপড়ের বিষাক্ত রং, ইট ও কাঠের গুঁড়া মেশানো হয় খাবারের মসলায়। তেল, আটা, চিনি, কেক, বিস্কুট কিছুই আজ ভেজালমুক্ত নয়। বাজারের ৮৫ শতাংশ মাছে ফরমালিন মিশিয়ে পচন রোধ করা হয়। শাকসবজিতে বিষাক্ত স্প্রে, সব ধরনের ফলমূল দ্রুত পাকিয়ে রঙিন বানাতে সর্বত্র কার্বাইড, ইথোফেন, আর পচন রোধে ফরমালিন প্রয়োগ করা হচ্ছে। নকল ও ভেজাল ওষুধে ছেয়ে গেছে বাজার। এসব প্রতিরোধ করা জরুরি। ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে খাদ্যে ভেজাল দেওয়া এবং ভেজাল খাদ্য বিক্রির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডের বিধান রয়েছে। এ ছাড়া ১৪ বছরের কারাদণ্ডেরও বিধান রয়েছে এ আইনে। জাতীয় জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ২০১৮ সালে সারা দেশে ৪৩টি ভোগ্যপণ্যের (খাদ্যদ্রব্য) মোট ৫ হাজার ৩৯৬টি নমুনা পরীক্ষা করে। ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার পর এই ৪৩টি পণ্যেই ভেজাল পাওয়া গেছে। বর্তমানে বাজারে খাদ্যসামগ্রীর মানের অবস্থা একই।

সামগ্রিক বিষয়ে ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, ‘ভেজাল খাবার খাওয়ার ফলে শরীরে বাসা বাঁধে রোগব্যাধি। ক্ষতিকর রং, বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান, পোড়া তেল খাওয়ার ফলে পেটে সমস্যা হয়। ধীরে ধীরে আলসার হয়, একটা সময় লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব খাবার খেলে হৃদরোগ, কিডনি সমস্যা এমনকি ক্যান্সার পর্যন্ত হয়। গর্ভবতী নারীদের জন্য এসব ভেজাল খাবারের ক্ষতি কয়েকগুণ বেশি। গর্ভের শিশু মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় ভেজাল খাবারে। মাথার চুল, নখ থেকে শুরু করে মানুষের শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে ভেজাল মেশানো খাবার। তাই ব্যবসায়ীদের বলব, সততার সঙ্গে ব্যবসা করুন। খাবারে ভেজাল মিশিয়ে মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেবেন না। ’

Leave a reply

Minimum length: 20 characters ::

More News...

পুঁজিবাজারে সূচকের বড় পতন

পুরান ঢাকার কেমিক্যাল কারখানাগুলো দ্রুত সরানোর সুপারিশ