এদিকে বিনা কারণে বাইরে বের হওয়া বন্ধ করতে ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা নিশ্চিত করতে কঠোর অবস্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। স্থানীয় প্রশাসনকে সহায়তা করছে সশস্ত্র বাহিনীও। এছাড়া সংক্রমণ ঠেকাতে ঘরে থাকা, জরুরি প্রয়োজনে বের হতে হলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ওপর গুরুত্ব দিয়ে আসছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেকোনো মূল্যে এটি মানতে ও মানাতেই হবে। না মানলে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে।রোববার (৪ জুলাই) ‘লকডাউনের’ চতুর্থ দিনে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত রাজধানীর পুরান ঢাকার সূত্রাপুর, সদরঘাট, গেন্ডারিয়া, দয়াগঞ্জ, লক্ষ্মীবাজার, রায়সাহেব বাজার, ইসলামপুর রোড, বাংলা বাজার, ধোলাইখাল রোড, নারিন্দা, স্বামীবাগ এলাকার পাড়া-মহল্লার অলিগলি এলাকা ঘুরে এমন চিত্র দেখা যায়।সরেজমিনে দেখা যায়, গত ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ‘কঠোর লকডাউনে’ রাজধানীর মূল সড়কগুলো এখনও ফাঁকা। তবে আগের চেয়ে জনসমাগম বেড়েছে। কিন্তু তাদের মধ্যে কাজের সন্ধানে বের হওয়া মানুষের সংখ্যাই বেশি। তবে পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকার গলিতে ঢুকলে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। এ দৃশ্য পুরো পুরান ঢাকাজুড়েই। সরকার ঘোষিত ‘কঠোর লকডাউনের’ নিয়ম ভেঙে পুরান ঢাকার প্রায় সব অলিগলিতে আড্ডার বিষয়টি এখন যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর দৃশ্য আরও বেশি নজরে পড়ে। রাজধানীর অলিগলিতে ভ্রাম্যমাণ চা আর সিগারেটের দোকান নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষ। নিতান্তই পেটের দায়ে ঘর থেকে বের হয়েছেন তারা। যাদের মূল ক্রেতা হলো ‘লকডাউন’ ভেঙে বের হওয়া মানুষরা।
গেন্ডারিয়া হাই স্কুলের বিপরীতের সুপার শপের সামনে বেশ জটলা। ছয়-সাতজন যুবক একসঙ্গে দাঁড়িয়ে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলেন। একই দৃশ্য নজরে আসে ধূপখোলা মাঠের সামনেও। তাদের সবারই আলোচনার বিষয় কবে শেষ হবে ‘লকডাউন’? কবে স্বাধীনভাবে ঘুরতে পারবেন তা নিয়ে। প্রায় সব অলিগলিতে চার-পাঁচজন জড়ো হয়ে আড্ডা দেওয়ার বিষয়টি এখন যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। অথচ দুপুরের পর দোকানপাট, বিনা কারণে ঘর থেকে বের হওয়ার ক্ষেত্রে রয়েছে সরকারি নিষেধাজ্ঞা।
সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের পাশের মার্কেটের সামনে কয়েকজন বসে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। দেখে জিজ্ঞেস করতেই কয়েকজন উঠে চলে যায়। তাদের মধ্যে রাকিব নামে একজন বলেন, ভাই সারা দিন ঘরে থাকতে ভালো লাগে না। যেখানেই যাই পুলিশ তাড়া করে। এখানে একটু কম আসে তাই নিরিবিলি বন্ধুরা মিলে বসে কথা বলছিলাম। ঘরে ভাই একদিন দু’দিন বসে থাকা যায়। এর বেশি হলে অস্থির লাগে।ঋষিকেশ দাস রোডে ভ্রাম্যমাণ চায়ের দোকানে চা খাচ্ছেন রাতুল। তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, চা-সিগারেট খেতে বাইরে এসেছি। খাওয়া হলে বাসায় চলে যাবো। বাসায় মুরব্বিদের সামনে তো আর চা-সিগারেট খাওয়া যায় না। কাগজিটোলার আলামিন বলেন, আর কতো বাসায় বসে থাকতে ভালো লাগে। সারা দিন বাইরে বের হয়নি। বিকেলে বের হয়েছি। করোনা হলে কিছু করার নেই। এভাবে ঘরবন্দি হয়ে বাঁচা যায় না। আর করোনা যদি হতো গত দেড় বছরেই হতো। আমাদের করোনা হবে না।কাঠেরপুল মোড়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছিল পাঁচ কিশোর। তাদের সবাই এবারের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। কিন্তু করোনা সংক্রমণের আশঙ্কায় স্থগিত হয়ে যাওয়া পরীক্ষা নিয়ে চলছিল তাদের আড্ডা।তাদের একজন সায়েম বললো, গত বছরের মার্চ থেকে স্কুল বন্ধ। মাঝখানে কিছুদিন কোচিং খুলেছিল, এখন আবার তাও বন্ধ। কত আর ঘরে বসে থাকা যায়। পরীক্ষা কবে তারও ঠিক নেই। এ সময় পরীক্ষার পড়াও পড়তে ইচ্ছা করছে না।কিন্তু ‘লকডাউন’ ভেঙে কেন ঘর থেকে বের হয়েছেন জানতে চাইলে ওই দলের আরেক সদস্য নূর বলেন, ঘরে ভালো লাগতেছে না তাই বের হয়েছি। মাস্ক পড়েই বের হয়েছি।একই চিত্র দেখা গেছে স্বামীবাগের কে এম দাশ লেনেও। সেখানকার মিতালী হাই স্কুলের পাশে দেখা গেছে বেশ ভিড়। সেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখা যায় চারজনকে। আরও সামনে তিনজনের আরেকটি দলকে আড্ডা দিতে দেখা যায়।
ভ্রাম্যমাণ চা-সিগারেট বিক্রি করছেন সেলিনা। তিনি বলেন, ‘ভাই কী করুম। দুইটা ছোট পোলা তাদের তো খাওয়া-পরা আমাকেই দিতে হবে। স্বামী দুই বছর হলো ফালাইয়া চইলা গেছে। ঘরে বসে থাকলে কেউ খাওন দিবো না। সরকার কত কিছু দেয় কিন্তু আমিতো পেলাম না। আমার কাম আমারই করতো হবো। চা-সিগারেট বিক্রি করি। যা আয় হয় তা দিয়ে ঘর ভাড়া আর সংসার চালাই। চার দিন হলো ‘লকডাউন‘ দিছে। বেচাবিক্রিও কমে গেছে। কীভাবে ঘর ভাড়া দিমু সে চিন্তায় ঘুম হারাম হয়ে গেছে। ’ মাঠ পর্যায়ে কর্মরত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কয়েক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সামাজিক দূরত্ব রক্ষায় তারা সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা চেষ্টা করছেন মানুষকে বোঝাতে। রোববারও তারা সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন। অযথা কাউকে বাইরে ঘুরতে দেখলে বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রাথমিক পর্যায়ে কাউকে শাস্তিও দেওয়া হচ্ছে। তবে এরপরও যদি কেউ অযথা বের হন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।