সরকারের অতি গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পের কাজ যেনতেনভাবে চললেও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কোনো তদারকি নেই বলে জানিয়েছেন সচেতন মহল।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) রামু শাখার সভাপতি নাট্যজন মাস্টার মো. আলম বলেন, নদী থেকে বালু তুলে তা রাখা হচ্ছে নদীর বুকেই। আবার সেই বালু নিয়ে যাওয়ার জন্য নদীর তলদেশ ভরাট করে বানানো হয়েছে ট্রাক চলাচলের রাস্তা। এখন বর্ষা চলে আসছে। যদি এরমধ্যে বৃষ্টি বেড়ে যায় তবে সিংহভাগ বালু ফের নদী চলে যাবে।
তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের দাবি, নদীটির প্রায় সাড়ে ২৮ কিলোমিটার এর মধ্যে ২৫ কিলোমিটারের কাজ শেষ হয়েছে। বর্ষার আগেই বাকি কাজ শেষ হবে এবং এসব বালু সরানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে।
তবে চলমান এ প্রকল্পের রামুর বিভিন্ন অংশে কাজ পরিদর্শন শেষে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)- এর নেতারা।‘নদী ড্রেজিং মানে, নদী থেকে বালু বা মাটিগুলো তুলে নিরাপদ দূরত্বে রাখা হবে, আমরা এটাই বুঝি। কিন্তু বাঁকখালীর এই খনন কাজ দেখে আমরা বিস্মিত হয়েছি’, বলেন মাস্টার মো. আলম।
তিনি আরও বলেন, দেখলাম, নদী থেকে বালু তুলে নদীতেই রাখা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, সেই বালু নিয়ে যাওয়ার জন্য আবার উল্টো নদীর তলদেশ ভরাট করে রাস্তাও করা হয়েছে। কিন্তু যেভাবে ধীর গতিতে বালু নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আমরা আশঙ্কা করছি, বর্ষার আগে এসব বালুর সিংহভাগ নদীতেই চলে যাবে। তাই আমরা এ বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন।
কক্সবাজার বেতারের সংগীত প্রযোজক, সাংস্কৃতিক সংগঠক মো. বশিরুল ইসলাম বলেন, বাঁকখালী নদী ড্রেজিং এটি রামু-কক্সবাজারের মানুষের জন্য দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণের মতো। কিন্তু ড্রেজিং এর কাজটি যথাযথভাবে না হলে সরকারের এ উদ্যোগের সুফল পাবে না মানুষ।
অধ্যাপক নীলোৎপল বড়ুয়া জানান, বাঁকখালী নদী ভরাটের কারণে বন্যাসহ নানা ভোগান্তি আমাদের পোহাতে হয়। দীর্ঘদিন পর হলেও নদীটি ড্রেজিং করা হচ্ছে এটি আমাদের জন্য সৌভাগ্যের। কিন্তু যেভাবে কাজ চলছে তা কতটুকু কার্যকর কাজ হবে তা আমাদের বোধগম্য নয়। এমনকি বর্ষার আগে তা সম্পন্ন করা যাবে কিনা তা নিয়েও আমরা সন্দিহান।
রামুর বাঁকখালী উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির নির্বাহী পরিচালক মাস্টার কিশোর বড়ুয়া জানান, এই নদীর সাথে রামু-কক্সবাজারের লাখ লাখ মানুষের জীবন জীবিকা জড়িত। কিন্তু যেভাবে খনন কাজ চলছে, স্থানীয়রা এর কতটুকু সুফল পাবে তা নিয়ে আমরা চিন্তিত।
প্রকল্পে যা আছে
কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, বাঁকখালী নদী ড্রেজিং ও খনন করে নদীর নাব্যতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নৌ-চলাচলের পথ সুগম করা, দুর্যোগের সময় সাগরের নৌকা/ট্রলার এর নিরাপদ অবস্থানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পোতাশ্রয় হিসাবে বাঁকখালী নদী ব্যবহার করা এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং নদী ভাঙনের হাত থেকে ঘরবাড়ি, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রক্ষার জন্য ২০১৬ সালে প্রায় ১৯৫ কোটি ৫৪৩ লাখ ৯৫ হাজার টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্প হাতে নেয় কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ড। এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড নামের একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান।
প্রকল্পে নদী ড্রেজিং ছাড়াও রয়েছে ৪.৬৫০ কিলোমিটার নদীর তীর সংরক্ষণ, তিন কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ/পুণরাকৃতিকরণ, ২টি রেগুলেটর নির্মাণ ও ১২ কিলোমিটার খাল পুনঃখননের কাজ। ২০১৬ সালের জুনে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের মেয়াদ চলতি বছরের জুনে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
নদীর বুকে বালু রাখার বিষয়ে জানতে চাইলে ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড-এর কাজ তদারকির দায়িত্বে থাকা মো. সরওয়ার নামের ব্যক্তি মুঠোফোনে এ প্রতিবেদককে জানান, নদীর দুইপাশে জায়গা সংকটের কারণে বালু নদীর বুকে রাখা হয়েছে। আগামী একমাসের মধ্যে সব বালু তুলে নেওয়া হবে এবং পিকআপ চলাচলের জন্য ভরাট করা মাটিও তুলে ফেলা হবে।
প্রকল্পের ডিজাইন অনুযায়ী কাজ হচ্ছে না বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, হাইটুপি অংশে ৪০ মিটার ড্রেজিংয়ের কথা থাকলেও দুইপাশে জায়গা না থাকায় তা করা যাচ্ছে না।
এদিকে সরকারের এত বড় একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের তদারকির ক্ষেত্রে উপজেলা প্রশাসনের উদাসীনতা আছে বলে মন্তব্য করেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের নেতারা।
যদিও রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) প্রণয় চাকমা বলেন, এ প্রকল্পটি জেলা থেকে তদারকি করা হয়। এখানে উপজেলা প্রশাসনের কোনো এখতিয়ার নেই। কেউ অভিযোগ করলে তা আমরা দেখতে পারি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড যা বলছে
এ বিষয়ে কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রবীর কুমার গোস্বামী বলেন, এ প্রকল্পে সাড়ে ২৮ কিলোমিটার ড্রেজিং-এর কাজ ছিল, সেখান থেকে ইতোমধ্যে প্রায় ২৫ কিলোমিটার ড্রেজিং সম্পন্ন হয়েছে। নদীর দুইপাশে পাহাড় থাকাতে কয়েক কিলোমিটার কাজ করা যাবে না।
তিনি বলেন, কক্সবাজারের কস্তুরাঘাট অংশে ৮০ মিটার এবং রামু হাইটুপি অংশে ৪০ মিটার নদীর তলদেশে ড্রেজিংয়ের কথা রয়েছে কিন্তু অনেক জায়গায় সেভাবে করা যাচ্ছে না।
নদীর বালু নদীতে রাখা হচ্ছে- এ বিষয়ে তিনি বলেন, রামুর হাইটুপি অংশে নদীর দুইপাশে সব জমিই ব্যক্তিমালিকানাধীন। তাই সেখানে বালু রাখা যাচ্ছে না। ফলে নদীতে বালু রাখা হচ্ছে। বর্ষার আগেই এসব বালু সরিয়ে ফেলা হবে।