বরিশাল প্রতিনিধি : ২৫ এপ্রিল। ১৯৭১ সালের এইদিনে বরিশাল সদর উপজেলার চরবাড়িয়ায় গণ-হত্যাযজ্ঞ চালায় পাক-হানাদার বাহিনী।আর এদিনেই পাক বাহিনী সড়কপথ, জলপথ ও আকাশপথে একযোগে বরিশালে আক্রমণ চালায়।যদিও এর এক সপ্তাহ আগে আকাশপথ দিয়ে বরিশাল শহরে পাক বাহিনী ব্যাপক বোমা ও গুলি বর্ষণ করলেও তারা শহরে নামেনি।পাক বাহিনীর ধারণা ছিল বরিশালে বীর মুক্তিযোদ্ধারা ব্যাপক সংখ্যাক ঘাঁটি গেড়ে বসেছেন। ২৪ এপ্রিল সড়ক পথে ফরিদপুর শহর পতনের পর পাক বাহিনীর বিশাল একটি ট্রুপ বরিশালের দিকে রওয়ানা দেয়। ভুরঘাটায় এ ট্রুপ ব্যাপক বাধার সম্মুখীন হয়। কটকস্থলে মুক্তিবাহিনীর একাংশ বাধা দিলে এখানে ৫ মুক্তিবাহিনী ও বেশকিছু পাক আর্মি হতাহত হয়। এরপরেও পাক আর্মি সড়ক পথে বরিশালে পৌঁছায়।জলপথে পাক আর্মির গানবোট জুনাহারে নদীতে পৌঁছানোর পাশাপাশি দুটি হেলিকপ্টার থেকে পাক আর্মির প্যারাট্রুপার নামিয়ে দেয়। তালতলি ও জুনাহারে ব্যাপক সংখ্যক পাক আর্মি সশস্ত্র অবস্থায় কভারিং করে। অন্যদিকে পাক আর্মির গানবোট কীর্তনখোলা নদী তীরবর্তী স্থানে ফায়ার করতে থাকে।নদী পথে পাক আর্মি প্রতিহত করার জন্য চরবাড়িয়ায় মহাবাজ উচ্চ বিদ্যালয়ে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প গড়ে তোলা হয়। ঝুনাহার নদীর সংযোগে ইরানী ও মাজভী নামে দুটি স্টিমার নোঙর করে বীর মুক্তিযোদ্ধারা আড়াল করে পজিশন সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করে।গানবোট গুলো যখন ঝুনাহার ও তালতলি অতিক্রম করেছিল তখন শায়েস্তাবাদ ও চরবাড়িয়া থেকে মুক্তিযোদ্ধারা গুলি ছুড়লে পাক গান বোট থেকে শেল বর্ষিত হতে থাকে। ‘ইরানী ও মাজভী’ এর ফলে ডুবে যায়।সেইদিন পাকিস্তান আর্মিদের গুলিতে বাবা আবদুর রহমান খান ও দাদা আলী আজিম খানকে হারিয়েছেন সে সময়ের দশম শ্রেণির ছাত্র চরবাড়িয়ার বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান।নি বলেন, তখন সকাল ১০টা থেকে ১১টা হবে। সকাল থেকে দু’টি হেলিকপ্টার থেকে ছত্রী সেনা নামতে ছিল, অন্যদিকে পাকিস্তানি গানবোটগুলোও বরিশালের দিকে আসতে ছিল। তবে জুনাহারে আসলে তারা বাধা পায়, কেননা অন্য দু’টি জাহাজ দিয়ে আড়াআড়ি বাধা দেওয়া হচ্ছিল। এমন সময় আগে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রুপ সেখানে অবস্থান করছিল। তারা ফায়ার করলে গান বোট দিয়ে গুলি ছুড়তে থাকে পাকিস্তানি আর্মিরা। একপর্যায়ে তারা তালতলীতে নেমে ঘরে ঘরে আগুন দিয়ে গুলি করতে থাকে। বিকেলের দিকে তাণ্ডব একটু কমে এলেও বেশ কিছু সৈন্য গানবোটে রয়ে যায়। পরের দিন তারা চরমোনাই ইউনিয়নের কায়েকটি ঘরে আগুন দেয় ও গুলি বর্ষণ করে বরিশালের দিকে চলে যায়। বরিশাল ঘাটে তাদের বেশ কিছু স্বাধীনতা বিরোধী লোকজন স্বাগত জানায়।তিনি আরও বলেন, ২৫ এপ্রিল পুরো চরবাড়িয়া এলাকায় চলে পাক-বাহিনীর পৈশাচিক বর্বরতা। তারা যাত্রাপথে যাদের পেয়েছে তাদেরই হত্যা করেছে। মসজিদের ইমাম, নারী-পুরুষ, বৃদ্ধা, মায়ের কোলের শিশুসহ সব ধর্ম, বয়স-পেশার মানুষকে হত্যা করে তারা। এর মধ্যে তালতলীর পশ্চিম পাশে আব্দুর রহমান খানের নতুন খনন করা পুকুরে আশ্রয় নেওয়া বেশ কয়েকজনকে হত্যা করা হয়। চরবাড়িয়ার আবদুস ছাত্তার আত্মরক্ষার জন্য নিজ ঘরের পাশেই খনন করেন একটি পরিখা। সেখানে এক ভিখারীসহ ঘরের সবাইকে নিয়ে আশ্রয় নেন তিনি। সেখানে বাস্ট ফায়ার করে দু বছরের শিশু, নারী, বৃদ্ধাসহ সবাইকে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। তাদের আর কেউ বেঁচে না থাকায় সেখানেই পুরো পরিবারকে গণকবর দিয়ে দেওয়া হয়, যা আজ বীর চিরন্তন। এভাবে অনেককেই হত্যা করা হয় ওইদিন। আবার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান নেওয়ার খবর পেয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয় সাপানিয়ার প্রাচীর ঘেরা বাড়িটি।আবদুল মান্নান বলেন, বীর চিরন্তন ছাড়া তালতলী বাজার সংলগ্ন নিহতের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া আমি আমার বাবা শহীদ আবদুর রহমান স্মরণে একটি পাঠাগার নির্মাণ করেছি। তবে এখানে যে ৪৮ জন শহীদ হয়েছেন তাদের পরিবারে খোঁজ খুব কম লোকই নিয়েছে। পাকিস্তান আর্মিদের নির্বিচারে গুলি বর্ষণে বহু পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান জানান, বরিশালের প্রথম নৃশংস হত্যাযজ্ঞ শুরু হয় এ চরবাড়িয়া থেকে। এখানেই মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্প, পরিখা এবং গণহত্যার নানান স্মৃতি রয়েছে। যেগুলো সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি ১৯৭১ এর অনেক জনপদ কীর্তন খোলার ভাঙনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।এদিক চরবাড়িয়ার রণাঙ্গনের ঝুনাহার পয়েন্টে (যেখানে দুটি জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছিলো পাক-হানাদার বাহিনী। এখানেই প্রথম সম্মুখ যুদ্ধ হয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে) স্মৃতিফলক নির্মাণের ব্যাপারে দীর্ঘদিন ধরেই দাবি জানিয়ে আসছেন স্থানীয়রা।সেক্টর কমান্ডার ফোরামের বিভাগীয় সম্পাদক পুতুল ঘোষ জানান, এটি ছিল বরিশাল অঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রথম গণহত্যা। এরপরে পাকিস্তান আর্মি বরিশাল শহরের ওয়াপদায় তাদের সামরিক স্থাপনা গড়ে তোলে এবং বরিশালের বিভিন্ন অঞ্চলে গণহত্যা চালিয়ে যায়।স্থানীয়রা জানান, এ গণহত্যায় দুই বছরের শিশু থেকে ৯০ বছরের বৃদ্ধদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে। গুলিতে আহত হয়েছেন অনেকে, পরবর্তীতে এদের মধ্যে অনেকেই কর্মক্ষমতা হারিয়েছে ও বিভিন্ন রোগে ভুগে মৃত্যুবরণ করেছে।