সাভার প্রতিনিধি : ধুলো-বালুযুক্ত কালো বোরকা, কালো ওড়না ও পায়ে পুরোনো ছেঁড়া স্যান্ডেল পরে ফুটওভার ব্রিজের ওপর মাটিতে একটি পলিথিন বিছিয়ে বসে আছেন মধ্য বয়সী এক নারী। রমজানের এই দিনেও সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সাভারের বিভিন্ন স্থাপনার সামনে, ফুটওভার ব্রিজের উপর পথচারীদের দিকে হাত পেতে বসে থাকেন তিনি।মধ্যবয়সী এই নারীর নাম হওয়া বেগম। তিনি রানা প্লাজার সাত তলায় একটি পোশাক কারখানায় ক্লিনার হিসেবে কাজ করতেন সঙ্গে তার ছোটো মেয়ে তানিয়া আক্তার আট তলায় একই পোশাক কারখানায় অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসে হাওয়া বেগম আহত হয়ে তার কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। এরপর থেকেই শুরু হয় তার জীবনের দুঃখ দুর্দশা। স্বামী অসুস্থ হয়ে বিছানায় ও সন্তানদের খাওয়া-পড়ানোর দায়িত্ব থেকেই আজ এই পথ বেছে নিয়েছেন হাওয়া বেগম। আট বছর আগেও তিনি স্বামী সন্তান নিয়ে ভালোই চলতেন। কারখানা থেকে পাওয়া বেতন, স্বামীর উপার্জন ও এক মেয়ের আয়ে ছেলে-মেয়ে নিয়ে সুখের সংসারই ছিলো তাদের। কিন্তু একটি দুর্ঘটনা হাওয়া বেগমকে আজ পথে নামিয়েছে, বাধ্য করেছে মানুষের কাছে হাত পাততে। শুক্রবার (২৩ এপ্রিল) হাওয়া বেগমের খোঁজে বের হয়ে তাকে বিকেলে পাওয়া যায় সাভার নিউমার্কেটের সামনে ফুটওভার ব্রিজের উপরে। সেখানেই কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি জানান, তিনি সাত তলায় কাজ করতেন ও তার ছোটো মেয়ে তানিয়া আক্তার আট তলায়। সাত ও আট একই কারখানা ছিলো। ঘটনার আগের দিন সাংবাদিকরা এসে কারখানার ভবন তালা মেরে যেতে বলেছে। কারণ ভবনের এক জায়গায় বড় ফাঁকা দেখেছে তারা। এ নিয়ে ঘটনার দিন শ্রমিকরা কাজে যাবে কি যাবে না সেটা নিয়ে ধোঁয়াসায় ছিলো। পরে সোহেল রানা রানা প্লাজার মালিক এসে সবাইকে গালি গালাজ করে ওপরে পাঠিয়ে দেয়। এসময় হাওয়া বেগম ওপরে উঠে একটি ফ্লোর ঝাড়ু দেওয়া শেষে করে আরেকটি ফ্লোর ঝাড়ু দেবে এই মুহূর্তে অনেকেই বলাবলি করছিলো আজ আর কাজ করবে না বাড়ি ফিরে যাবে। সেদিন অনেক শ্রমিকই কাজ না করে আট তলা সিঁড়ির নীচে এসে আন্দোলন করছিলো। এসময় একটি বিকট আওয়াজ হয়। এরপর ধুলো-বালু চোখের ভেতর গিয়ে কিছু দেখতে পারেননি হাওয়া বেগম। চারদিকে অন্ধকার শুধু চিৎকার আর চিৎকার। মানুষের চিৎকার ও কান্না শুনে সেও গলা ছেড়ে কান্না শুরু করেন। পরে কেউ একজন ভবন থেকে তাকে বের করে ও চোখে-মুখে পানি দেন। তিনি তখন দেখেন তার শরীরে শুধু ক্ষত। এসময় তিনি দেখতে পায় রানা প্লাজার ভেতর থেকে মানুষকে বের করে অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তিনিও অ্যাম্বুলেন্সে করে এনাম মেডিক্যালে যান। তারপর হাসপাতালে গিয়ে তার মেয়ের সঙ্গে দেখা হয়। আহত হয়েও সেদিন বেঁচে যান মা-মেয়ে। তিনি জানান, এ ঘটনার পর তিনি দীর্ঘ দিন গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ায় ছিলেন। এখন কোনো কারখানায় চাকরি নিতে পারেন না। বড় দালান দেখলে ভয় পান। আবার কোনো বাড়িতেও কাজ করতে পারে না শারীরিক সমস্যার কারণে। স্বামী অসুস্থ হওয়ার পর থেকে তার চিকিৎসার খরচ ও সংসার চালাতে তিন বছর ধরে তিনি ভিক্ষা-বৃত্তি করেন। তার দুই মেয়ে ও দুই ছেলে। দুই মেয়েকে বিয়ে দিলেও ছেলেরা পড়াশোনা করে। করোনার কারণে এক ছেলে রিকশা চালিয়ে কিছু টাকা রোজগার করে। বর্তমানে তারা সাভারের ১ নম্বর কলমায় একটি বাসায় ভাড়া থাকেন। হাওয়া বেগম বলেন, কিভাবে কাম করবো বাবা। বা হাতে চারটা সেলাই, ডান হাতের এক আঙ্গুল বাঁকা হয়ে আছে। এখন আর কেউ বাসা-বাড়িতে কামে নেয় না। চাকরি-বাকরিও নেই কি করবো এখন তাই চেয়ে-চিন্তে খাই। আমার স্বামীর বাম-পা ও হাত অবশ হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। আমি যা পাই ও পোলায় যা পায় তাই দিয়ে চলি ওষুধ কিনি। কেউ তো আর শখ করে রাস্তায় বসে না। একদম লজ্জা-সরম বাদ দিয়ে বাধ্য হয়ে আজ এই কাজ করতে হচ্ছে। নামাজ কালাম পরি রোজা থাকি আল্লাহ আল্লাহ করি যেনো এই পথ থেকে সরে নিজের পায়ে দাঁড়ানো ব্যবস্থা করে দেন।তিনি বলেন, ভিক্ষা করে প্রতিদিন সকাল থেকে দুপর পর্যন্ত ৭০-৮০ টাকা হয় আর সারাদিনে ১৫০-২০০ টাকা হয়। এক এক সময় একেক রকম হয়। আজ কয়েকজন সাংবাদিক বাসায় গিয়েছিলো তাই সকালে বের হতে পারিনি। দুপুরে বের হওয়ার পর একজনে ১০০ টাকা ও এক কেজি চাইল দিছে। রোজার জন্য হাঁটতে পারিনা কষ্ট হয়। মার্কেটের নীচে এসে বসে আছি। বাসায় গিয়ে নামাজ পরে ইফতার করবো। আপনি কি কোনো সহায়তা পেয়েছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এক মাস পর বাড়ি থেকে এসে আমি বেতন নিয়ে গেছি। আমার কাগজ অনেকেই নিয়েছে কিন্তু আমি কিচ্ছু পাইনি। তবে আমার মেয়ে কিছু অনুদান পেয়েছে। মাইনসে খালি কয় কাগজ দাও ছবি দাও সবই দিলাম কিন্তু কোনো কিছুই পাইনি বাবা। মানুষ খালি আশ্বাস দিয়ে যায়। কারা আনে কারা খায় জানি না। আমি আমার ক্ষতিপূরণ চাই। কান্না জড়িত কণ্ঠে হাওয়া বেগম বলেন, আমার কিছুই চাওয়ার নেই, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মত যদি আল্লাহ কোনো কিছু করে দেয় তাই হবে। এই পথ থেকে আল্লাহ যদি ফিরিয়ে নেই তাই হবে। রানা যদি সেদিন গালাগালি করে মানুষদের না ঢুকাতো তাহলে এতো মানুষ মরতো না। আজ আটটা বছর ধরে কানতে কানতে আর চোখে পানি নাই আমার। আমি এর বিচার চাই। আর সবার ক্ষতিপূরণ চাই। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকালে ঢাকার সাভারে ধসে পড়ে রানা প্লাজার নয় তলা ভবন। দেশের ইতিহাসে ভয়াবহ এ ট্র্যাজেডিতে সরকারি হিসেবে প্রাণ হারান ১ হাজার ১৩৮ জন শ্রমিক। এখনও নিখোঁজ আছেন অনেকে। আহত ও পঙ্গুত্ববরণ করে মানবেতর দিনযাপন করছেন আরও প্রায় দুই হাজার শ্রমিক।