শাহীন রেজা নূর: স্মৃতি অমলিন

শাহীন রেজা নূর: স্মৃতি অমলিন

মো: আবু তালেব : শাহীন রেজা নূর। আমার পেশাগত জীবনের খাতার পাতায় এই নামটি লেখা রয়েছে নক্ষত্রের অক্ষরে। তিনি অমার পরম শ্রদ্ধেয় সহকর্মী, প্রিয় শিক্ষক। তাঁর সাথে অফিসে কিংবা অফিসের বাইরে যখনই দেখা হতো, তখনই পেতাম প্রাণখোলা হাসিমাখা স্নেহ সম্ভাষণ। তাঁর টেবিলের সামনে বসলে প্রতিদিনই কিছু না কিছু শেখা হয়ে যেতো। দৈনিক ইত্তেফাকের কার্যনির্বাহী সম্পাদক শাহীন রেজা নূর আজ বেঁচে নেই। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি খবর পেলাম শাহীন ভাই আর বেঁচে নেই। যখন এই খবর শুনলাম তখন মনে হলো আকাশটা যেনো ভেঙ্গে পড়লো।
মানুষ মাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। ইহলোক কেউই অমর নন। তবুও শাহীন ভাইয়ের মৃত্যুর সংবাদটি আমার কাছে বক্ষ বিদীর্ণ করা বজ্রপাতের নিনাদের মতো ছিলো। মন কিছুতেই এই খবর বিশ্বাস করতে চাইছিলো না। কঠিন সেই সংবাদেও স্তব্ধতার ঘোর কেটে যাবার পর আমি আমার এই ভাইকে দেখলাম স্মৃতির জমিনে; কী প্রাণবন্ত একটা মানুষ ! তিনি খুব সহজেই মুগ্ধতা ছড়িয়ে দেন তাঁর চারপাশে। শাহীন রেজা নুর সুবক্তা, সুলেখক, ইতিহাসের এক স্মৃতিধর ভাষ্যকার।
সাংবাদিকের দক্ষতা ও নেশাটি তিনি পেয়েছিলে উত্তরাধিকারসূত্রে। শাহীন রেজা নূরের পিতা শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেন। তিনি ছিলেন দৈনিক ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক এবং একই সঙ্গে ছিলেন বার্তা সম্পাদক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফার আন্দোলনকে শিখরে পৌঁছে দিতে তিনি বার্তা সম্পাদক হিসাবে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেন তা ইতিহাসে লেখা রয়েছে স্বর্ণাক্ষরে। সাংবাদিকতার প্রবাদ পুরুষ মানিক মিয়ার কলাম এবং সিরাজুদ্দিন হোসেনের সংবাদ বিন্যাস ও শিরোনাম ইত্তেফাককে প্রচারণার শীর্ষে পৌছে দিয়েছিলো। সিরাজুদ্দিন হোসেন একাত্তরের শেষ দিকে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে শাহাদাত বরণ করেন। তিনি শহীদ বুদ্ধিজীবীদের অন্যতম।
শাহীন রেজা নুরের ধমনীতে প্রবাহিত সিরাজুদ্দিন হোসেনের রক্ত। হয়তো সেই কারণেই শাহীন ভাইয়ের মধ্যে এক অসাধারণ প্রতিভার দীপ্তি ছিলো। তিনি শেক্সপিয়রের লেখা দীর্ঘ ডায়লগ নাটকীয় ভঙ্গিতে মুখস্থ বলে যেতে পারতেন অনায়াসে। বাংলা ও ইংরেজিতে তাঁর দক্ষতা ছিলো ঈর্ষণীয়।
শাহীন ভাই ইত্তেফাকে সাব এডিটর হিসাবে যোগদান করেন অতি অল্প বয়সে, কলেজের ছাত্র অবস্থায়। দৈনিক ইত্তেফাকের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। কিছুদিন তিনি বার্তা সম্পাদকের দাযিত্বও পালন করেন। ফিচার সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন দীর্ঘদিন। ইত্তেফাকের একটি বিশেষ সংখ্যায় হুমায়ূন আজাদের আলোচিত উপন্যাস পাকসার জমিন তিনিই ছেপেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রশ্নে আমাদের শাহীন ভাই ছিলেন আপোসহীন। সেই চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রজন্ম একাত্তর প্রতিষ্ঠায় তিনি পালন করেন অগ্রগামী ভূমিকা। তিনি এই সংগঠনের সভাপতি ছিলেন আমৃত্যু। পরে তাঁকে পদোন্নতি দিয়ে ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক বানানো হয়েছিলো, যদিও পদটি ছিলো আলংকারিক।
আমার পেশাগত জীবনে শাহীন ভাইয়ের প্রভাব ও অবদানের কথা কখনই ভুলে যাবার নয়। রিপোর্টার হিসাবে শাহীন ভাই কতভাবে যে আমাকে সহযোগিতা করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। আমার মনে আছে, পুরোনো ঢাকার সর্দারদের ইতিবৃত্ত বিষয়ে একটি সিরিজ রিপোর্ট করার অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছিলেন আমাকে শাহীন ভাই। শাহীন ভাইয়ের দিক নির্দেশনা অনুযায়ী আলোড়ন সৃষ্টিকারী সেই রিপোর্টের আমি পঁচিশ ছাব্বিশটি পর্ব করতে পেরেছিলাম। সেই রিপোর্টের অনেকগুলো পর্ব ছাপা হয়েছে দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পাতায়। অনেকগুলো আবার ছাপা হয়েছে কড়চা পাতায়। অসাধারণ এই রিপোর্টটি সব মহলে বিশেষ করে পুরোনো ঢাকায় আমার ব্যাপক পরিচিতি এনে দেয়। পরিচিতির সাথে যুক্ত হয় খ্যাতি। সত্যি কথা বলতে কি, আমার সাংবাদিক জীবনে এই রিপোর্ট যুক্ত করে নতুন মাত্রা। আজ আমি রিপোর্টার থেকে একটি জাতীয় দৈনিকের প্রকাশক ও সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছি। এর পেছনে শাহীন ভাইয়ের মতো জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান কিছু মানুষের কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষা নানাভাবে কাজ করেছে এবং করে চলেছে এখনও।
শাহীন রেজা নূর ভাই আজ বেঁচে নেই। দেশ থেকে বহুদূরে কানাডার ভাঙ্কুবারের একটি হাসপাতালে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। বহুদিন ধরে তিনি দূরারোগ্য ক্যানসারের সাথে লড়াই করে শেষ পর্যন্ত হার মানলেন। শাহীন ভাইয়ের পুণ্য স্মৃতির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা। আল্লাহ তাঁকে বেহেশত নসিব করুন।

Leave a reply

Minimum length: 20 characters ::

More News...

দুর্ঘটনার আশঙ্কায় জনমনে উদ্বগে বীরগঞ্জের সড়কগুলো দাপিয়ে বড়োচ্ছে কিশোর চালকরা

সন্দ্বীপে কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনা উদ্বোধন