আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো

নিজস্ব প্রতিবেদক ; হুমায়ুন আজাদ ‘বাঙলা ভাষা’ কবিতায় লিখেছেন, ‘শেকলে বাঁধা শ্যামল রূপসী, বাংলা ভাষা, তুমি-আমি-দুর্বিনীত দাসদাসী-/একই শেকলে বাঁধা প’ড়ে আছি শতাব্দীর পর শতাব্দী।’
১৯৪৮ সালের ১৮ নবেম্বর পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। ২৭ নবেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে তিনি এক ছাত্রসভায় ভাষণ দেন। ওই সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের তরফ থেকে প্রদত্ত মানপত্রে বাংলা ভাষার দাবি পুনরায় উত্থাপন করা হয়, কিন্তু তিনি কোন রূপ মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন। ১৭ নবেম্বর আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের এক সভায় আজিজ আহমদ, তমদ্দুন মজলিসের আবুল কাশেম, শেখ মুজিবুর রহমান, কামরুদ্দীন আহমদ, আবদুল মান্নান, তাজউদ্দিন আহমদ প্রমুখ একটি স্মারকলিপি প্রণয়ন করেন এবং সেটি প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের কাছে পাঠানো হয়। প্রধানমন্ত্রী এক্ষেত্রেও কোন সাড়া দেননি।
ভাষা সমস্যার প্রস্তাবিত সমাধানের জন্য পূর্ব বাংলা সরকারের পক্ষ থেকে ভাষা সমস্যার ব্যাপারে একটি বিস্তারিত ব্যাখ্যা জানতে মাওলানা আকরাম খানের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটি গঠন করা হয়। এ বিষয়টি নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করতে বলা হয়। ১৯৫০ সালের ৬ ডিসেম্বরের মধ্যে কমিটি তাদের প্রতিবেদন তৈরি করে। তবে এটি ১৯৫৮ সালের আগে প্রকাশ করা হয়নি। এখানে ভাষা সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে সরকারের পক্ষ থেকে একটি কার্যকর ব্যবস্থার প্রস্তাব করা হয়। যেখানে তারা বাংলাকে আরবী অক্ষরের মাধ্যমে লেখার সুপারিশ করেছিলেন।
ভাষাবিদ গোলাম সারোয়ার চৌধুরীর লেখায় বলা হয়েছে, ভাষা নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে এ জন্য, সব জাতীয় বা মাতৃভাষার উৎপত্তিই আসলে আঞ্চলিক ভাষা থেকে। রাজধানী কেন্দ্রিক আঞ্চলিক ভাষাই রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আর্থিকভাবে পরিপুষ্ট হয়ে প্রভাব ও প্রতিপত্তি অর্জন করে জাতীয়, মাতৃ বা রাষ্ট্রভাষায় পরিগণিত হয়। মোটামুটি সব বিশ্ব ভাষার ইতিহাস ঘাঁটলে এ তত্ত্ব প্রায় নির্ভুল মনে হবে। লাতিন রোমকেন্দ্রিক, ইংরেজী লন্ডনকেন্দ্রিক এবং বাংলা কলকাতাকেন্দ্রিক ভাষা হিসেবে বিস্তার লাভ করেছে।
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষার প্রকরণ, ব্যবহার ও উচ্চারণের এত বিপুল তফাত দেখে বছর দশেক আগে এ প্রশ্ন আমাকে বিচলিত করেছিল যে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা আসলেই বাংলাভাষার জাত কিনা। সাহিত্য বিশারদ আবদুল করিম, ড. এনামুল হক, আবুল ফজল প্রমুখসহ চট্টগ্রামবাসীর লেখা পড়ে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা বস্তুত বাংলা ভাষারই একটি অপভ্রংশ রূপ এবং আরাকানি রাজত্বের প্রভাবে এটি বিপুলভাবে সংকরায়িত হয়ে বাংলা ভাষার সঙ্গে প্রায় নিঃসম্পর্কিত একটি আঞ্চলিক ভাষা হিসেবে গড়ে ওঠে। তাই অন্য যে কোন জেলার লোকের মতো চট্টগ্রামের লোকের মাতৃভাষা বা জাতীয় ভাষা হচ্ছে বাংলা। চট্টগ্রামের কেউ শুধু আঞ্চলিক ভাষা জানলেও তার মাতৃভাষা ধর্তব্য হবে বাংলা বলে।
মাতৃভাষার মাধ্যমে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে যে গভীর বোধসম্পন্নতা ও বোধগম্য তৈরি হয়, সেটি বিদেশী ভাষার মাধ্যমে কখনও হয় না। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা স্মারকপত্র ২০১২-তে ‘অমর একুশের ষাট বছর’ শীর্ষক একটি পূর্ণাঙ্গ রচনা লিখেছেন। সেখানে মাতৃভাষার সর্বগামিতার প্রশ্নে একই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ থেকে উদ্ধৃত অনুচ্ছদটি গভীর বোধ বাড়ানোর জন্য মাতৃভাষার সহায়তার প্রযোজনীয়তার ওপর একটি চমৎকার ব্যাখ্যা। রবীন্দ্রনাথ জগদানন্দ রায়কে লেখা একটি চিঠিতে বলেছেন, ‘ছেলেরা মাতৃভাষা একটু একটু করে বাঁধ বেঁধে বেঁধে পাকা করে শেখে না। তারা যা জেনেছে এবং যা জানে না সমস্তই তাদের উপর অবিশ্রাম বর্ষণ হতে থাকে…হতে হতে কখন যে তাদের শিক্ষা সম্পন্ন হয়ে উঠে তা টেরই পাওয়া যায় না।’
গণ আজাদী আহ্বায়ক কামরুদ্দীন আহমদ বলেন, ‘বাংলাদেশ প্রকৃতপক্ষে বিভক্ত হওয়ার পূর্বেই মুসলিম লীগের বামপন্থী দলটি উক্ত প্রতিষ্ঠানের সভ্যপদ ত্যাগ করে ‘পূর্ব পাকিস্তান গণ আজাদী লীগ’ সৃষ্টি করেছিল। তাদের ধর্মনিরপেক্ষ কর্মসূচী ছিল এবং তাতে আর্থিক সমস্যাকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছিল।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে প্রথম সংগঠন তমদ্দুন মজলিস প্রসঙ্গে তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায় রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, ভাষা আন্দোলনে শুরু দিকে তমদ্দুনের ভূমিকা ছিল অগ্রণী। তারাই এ ব্যাপারে প্রথম উদ্যোগ নেন।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ বলেন, কাসেম সাহেব এই তমদ্দুন মজলিস নামের একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান করেছিলেন। তারা বাংলাকে কোর্ট বা আদালতের ভাষা করা দরকার এই মর্মে আন্দোলন করেছিলেন।
ভাষাসৈনিক ও রাজনীতিবিদ অলি আহাদ বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পদার্থ বিজ্ঞান এবং রসায়ন বিজ্ঞানের অধ্যাপকদ্বয় আবুল কাসেম ও নূরুল হক ভুইয়া ধূমায়িত অসন্তোষকে সাংগঠনিক রূপদানের প্রচেষ্টায় ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিস গঠন করেন। এই সংগঠনই ভাষা আন্দোলনের গোড়াপত্তন করে। তমদ্দুন মজলিস নিয়ে ভাষাসৈনিক ও রাজনীতিবিদ মোহাম্মদ তোয়াহা, তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ভাষাসৈনিক, মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক এমএলএ এ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান, ১৯৫২ সালের সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক কাজী গোলাম মাহবুব, ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিন, বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. নীলিমা ইব্রাহিম, বদরুদ্দীন উমর, বশীর আল হেলাল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ভাষাসৈনিক এমআর মাহবুব, ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও একুশের ইতিহাসে প্রথম’ গ্রন্থে উক্ত তথ্য তুলে ধরেন।
ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। সেদিন ঠিক বেলা ৩টার সময় পুলিশ ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী ছাত্রজনতার ওপর গুলি ছোড়ে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সামনের রাস্তায় পাকিস্তান শাসক গোষ্ঠীর পুলিশবাহিনী নিরহ ছাত্রজনতার মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালায়। সেই দিন চিত্রগ্রাহক আমানুল হকের ক্যামেরায় ধরা পড়ল শহীদ রফিকউদ্দিনের গুলি-খাওয়া মাথার মগজ রাস্তায় ছড়িয়ে থাকার ছবি। একুশের প্রথম শহীদ। একই দিনে মারা যান আরও চার জন বরকত, জব্বার, সালাম আর বালক অহিউল। এর পরদিন মারা যান শফিউর। রক্তের বিনিময়ে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে বিজয় লাভ করে বীর বাঙালী।

Leave a reply

Minimum length: 20 characters ::

More News...

দুর্ঘটনার আশঙ্কায় জনমনে উদ্বগে বীরগঞ্জের সড়কগুলো দাপিয়ে বড়োচ্ছে কিশোর চালকরা

সন্দ্বীপে কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনা উদ্বোধন