আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো

নিজস্ব প্রতিবেদক : কবি মাযহারুল ইসলাম ‘একজন থাকে বাংলায়’ কবিতায় লিখেছেন, ‘খান সাহেবের পরিষদদের/একজন থাকে বাংলায়/শিকারের খোঁজে হয়রান তিনি/মাঠে-ঘাটে লাউ-জাংলায়।’ মাতৃভাষা রক্ষায় এভাবে কবিতায় গানে- গল্পে প্রতিবাদ উঠে এসেছে। ঠিক এই কবিতাটিতে যেমন প্রতিবাদ রয়েছে- এ রকম হাজারো কবিতা গানে-গল্পে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীকে ধিক্কার দেয়া হয়েছে।
ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিন তাঁর এক গ্রন্থে বলেন, বায়ান্ন সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তাৎক্ষণিকভাবে ভাষা আন্দোলন সংঘটিত হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলাম আমি। সে জন্য আন্দোলনের ব্যাপারে অনেক দায়িত্ব পালন করতে হয় আমাকে। বায়ান্ন সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের একটি সভা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশের ছাত্ররা তাতে অংশ নেন। সভায় আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শামসুল হকও উপস্থিত ছিলেন। সভায় সব ছাত্র বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য আন্দোলনের পক্ষে মত দেন। শামসুল হক একা এতে দ্বিমত জানান। তিনি বলেছিলেন, ‘সামনে নির্বাচন। এখন আন্দোলন করলে নির্বাচন নাও হতে পারে।’ সভায় উপস্থিত কোন ছাত্রই তাঁর কথা শোনেননি।
১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে এসে বৈষম্যমূলক ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, অন্য কোন ভাষা নয়।’ জিন্নাহর প্রতি আমার আস্থা ধূলিসাত হয়ে যায়। ওই অনুষ্ঠানে জিন্নাহ সাহেবের বক্তব্যের তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম। তাঁকে বলেছিলাম, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দু মেনে নেবে না। অনুষ্ঠানে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের কাছে মতামত চাওয়া হয়Ñ আমার এ বক্তব্যের প্রেক্ষিতে। সবাই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার পক্ষে মত দেন। কিন্তু জিন্নাহ সাহেব আমাদের কথা শুনলেন না। এর পর আমরা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করতে থাকলাম। ১৯৫০ সালের ১১ মার্চের এক সভায় আমরা ঠিক করি মাতৃভাষা রক্ষার লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার। আর এ কাজটা ছাত্ররাই করতে পারেন। তাঁরা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠন করেন। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আমাদের কার্যক্রম শুরু করি। ধীরে ধীরে আমাদের আন্দোলন দৃঢ় হয়। ১৯৫২ সালে ২৭ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন ঢাকার পল্টন ময়দানের জনসভায় আবার উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন। এর পর ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাধারণ ছাত্রদের নিয়ে একটি সভা হয়। ছাত্র ও সাধারণ জনতা সম্মিলিতভাবে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেন। গাজীউল হকের সভাপতিত্বে ওইদিন বেলা ১১টায় সভা শেষে আমাদের মিছিল রাস্তায় নামে। কাঁদানে গ্যাস, লাঠিচার্জ, অগণিত গ্রেফতার উপেক্ষা করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের গেটে পৌঁছতেই গুলি হয়। এখানে আমি বলতে চাচ্ছি, একুশ ছিল নিছকই ছাত্রদের আন্দোলন।
জাকির হোসেন (একুশের কবিতা সঙ্কলন) ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিনের একান্ত সাক্ষাতকার নিয়েছেন। ওই সাক্ষাতকারে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন নিয়ে আব্দুল মতিন স্মৃতিচারণ করেছেন। পাকিস্তান শাসকদের সব চক্রান্ত রুখে বাঙালী সেদিন নিজের অধিকার আদায় করে নিয়েছিল। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে আমাদের অনেক অর্জন আছে। দুঃখজনক হলো, একষট্টি বছরেও সর্বস্তরে আমাদের মাতৃভাষা বাংলা চালু হয়নি। বায়ান্নর ২১ ফেব্রুয়ারিতে বাংলা ভাষার মুক্তি ঘটে সত্য। তবে এখনও এ ভাষার যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে। বাংলা ভাষা নিয়ে যথাযথ গবেষণা হচ্ছে না। ভাষাসৈনিকদের যথাযথ মূল্যায়নও এ দেশে হয়নি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের মতো ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসও বিকৃত হচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে একুশের প্রভাতফেরি সংস্কৃতি।
একুশের মাধ্যমে আমাদের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক অর্জন হয়েছে। তবে প্রত্যাশিত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন হয়নি। আন্দোলনের মূল প্রত্যাশা অনুযায়ী সর্বস্তরে বাংলা চালু হয়নি। কেন হয়নি এ প্রশ্নের উত্তর ভাষাসৈনিকদের জানা নেই। কী ভাবে চালু করা যায়, সেটাও তাঁদের জানা নেই। ভাষাশহীদ ও সৈনিকরা মাতৃভাষার জন্য আন্দোলন করেছেন, জীবন দিয়েছেন। তবে এ ভাষাকে রাষ্ট্রের সর্বস্তরে চালু করার দায়িত্ব তাঁদের নয়। দায়িত্বটা তাঁদের, যাঁরা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন। আমি মনে করি, সর্বস্তরে বাংলা চালু এবং একে নিয়ে গবেষণা না হলে আমাদের মাতৃভাষা এগোতে পারবে না।
একুশের একটি সংস্কৃতি হলো প্রভাতফেরি। ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ সকালে শিক্ষার্থীরা প্রভাতফেরি করেন। এ সংস্কৃতিও হারিয়ে যাচ্ছে। অনেকে বলতে পারেন, এটা ষাট বছর আগের ব্যাপার। সময়ের ব্যবধানে তো অনেক ঐতিহ্য, সংস্কৃতি বা রীতি বিলুপ্ত হয়। তাঁদের বক্তব্য আমি সঠিক বলেই মনে করি। এটাও সত্য, প্রভাতফেরির জন্য দেশের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাঠ আর সে রকম সুযোগ-সুবিধাও নেই।
ভাষা আন্দোলন কোন রাজনৈতিক দলের ছিল না। সেটা ছিল ছাত্রদের আন্দোলন। আজকের প্রজন্মকে প্রকৃত ইতিহাস ঠিকভাবে জানানো প্রয়োজন। প্রকৃত ইতিহাস রচনার মাধ্যমে বিকৃতি ও বিভ্রান্তির অবসান ঘটানো এখনই দরকার।
ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে এবার প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের শহীদ মিনারসহ সমগ্র ভাষা আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। ইউনেস্কো তাদের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস (ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ ডে-আইএমএলডি)-এর অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে এই প্রথমবারের মতো জাতীয় শহীদ মিনার এবং ভাষা আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সন্নিবেশিত করেছে।
এ ছাড়া, জাতিসংঘ ভবনের অভ্যন্তরে জাতীয় শহীদ মিনারের একটি রেপ্লিকা মন্যুমেন্ট স্থাপনের বিষয়েও জাতিসংঘ সম্মত হয়েছে। শীঘ্রই সেটি স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
জাতিসংঘের স্থায়ী প্রতিনিধি ড. মোমেন বলেন, ’৯৯ সালে ইউনেস্কো আমাদের ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার পর ২০০০ সাল থেকে সেটি বিশ্বব্যাপী পালিত হতে থাকলেও ‘ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ ডে’-এর ওয়েবসাইটে আমাদের শহীদ মিনারের ছবি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ফুল, লতাপাতা বা বিভিন্ন মাতৃভাষা শিক্ষায় অংশ নেয়া শিশুদের ছবি ২১ ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে ওয়েবসাইটটিতে ছিল। কিন্তু এবারই প্রথম বাঙালীর গৌরবগাথা, ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের পটভূমি, সালাম, বরকত, রফিক, শফিকদের বুকের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস বিশ্ববাসী জানার সুযোগ পেল।
উল্লেখ্য, ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট এই ওয়েবপেজটি খোলার পর দেখা যাবে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস। ওয়েবপেজটিতে ১৯৫৩ সালে পাক হানাদার বাহিনীর ভেঙ্গে দেয়া শহীদ মিনারটিসহ বিভিন্ন সময়ে নির্মিত শহীদ মিনার এবং সেগুলো নির্মাণের দুর্লভ আলোকচিত্র সংযোজন করা হয়েছে। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন আলোকচিত্র এবং শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণের ছবি। শহীদ মিনার নির্মাণের ইতিহাস, বাংলা ভাষার কবিতা, গান, ভাষা আন্দোলনের দলিলপত্র ও বিভিন্ন প্রকাশনা স্থান পেয়েছে।

Leave a reply

Minimum length: 20 characters ::

More News...

কোটি টাকায় নিষিদ্ধ ব্রাহামার ক্রেতা ‘সাকের ভাই’ কে

সূচকের ওঠানামায় পুঁজিবাজারে লেনদেন চলছে