জাকির হোসেন আজাদী : যাত্রীবাহী ট্রেনগুলোতে বায়ো-টয়লেট স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। কারণ ট্রেনের শৌচাগারগুলোর মানববর্জ্য সরাসরি রেললাইনের ওপর পড়ে; যা আশপাশের পরিবেশ দূষিত করে। ছড়ায় রোগজীবাণু। মানববর্জ্য বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে রেললাইনের পাশেই থাকা পুকুর, ডোবা, খাল, নদী, জলাশয় নষ্ট করে। মূলত পরিবেশ ও যাত্রীদের স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করেই সরকার পুরোনো ট্রেন ও নতুন কোচে বায়ো-টয়লেট স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। ওই লক্ষ্যে একটি পাইলট প্রকল্প হাতে নেয়া হচ্ছে। সেজন্য ৩১ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে। তারপর একে একে সব ট্রেনে ওই ধরনের টয়লেট স্থাপন করা হবে। বর্তমানে রেলওয়ের ৩৬৮টি ট্রেনে বছরে প্রায় পৌনে ১০ কোটি যাত্রী চলাচল করে। এসব ট্রেনে দু’মুখ খোলা টয়লেট রয়েছে; যা যাত্রীদের স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। অথচ সরকার সম্প্রতি যে ৪ শতাধিক অত্যাধুনিক যাত্রীবাহী কোচ এনেছে, সেগুলোর অধিকাংশেরই বায়ো-টয়লেট নেই। ৮০০ টয়লেটের মধ্যে মাত্র ১৫০টি বায়ো-টয়লেট রয়েছে। রেলপথ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, শুধুমাত্র ১০৪টি আন্তঃনগর ট্রেনে ৩ হাজার ৩৩৬টি দু’মুখ খোলা টয়লেট রয়েছে। তাছাড়া বাকি ২৬৪টি ট্রেনে গড়ে ১০টি কোচ ধরা হলে-২ হাজার ৬৪০টি কোচ হয়। একেকটি কোচে দুটি টয়লেট থাকলে সংখ্যা দাঁড়ায় ৫ হাজার ২৮০টি। সেগুলোর বর্জ্য পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে। যুগ যুগ ধরে এমনটা চলে এলেও প্রতিকারে কোনো সরকারই উদ্যোগ নেয়নি। কিন্তু বিগত এক যুগ ধরে রেল আধুনিকীকরণের কাজ করে চলছে। তার অংশ হিসাবেই বায়ো-টয়লেটসহ বড় বড় স্টেশনগুলোতে মাল্টি-হাব নির্মাণ হচ্ছে।
সূত্র জানায়, ট্রেনযাত্রীদের মধ্যে অনেকে ট্রেন চলন্ত অবস্থায় মল-মূত্র ত্যাগ না করে যখনই স্টেশনে ট্রেন দাঁড়ায় তখন টয়লেট ব্যবহার করে। তখন সেসব বর্জ্য নিচে পড়ে স্টেশনের পরিবেশ নষ্ট করে। দুর্গন্ধে দুর্ভোগের শিকার হয় স্টেশনের যাত্রীরা। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ট্রেন স্টেশনে দাঁড়ানো অবস্থায় শৌচাগার ব্যবহার না করতে নোটিশ টাঙিয়ে রাখলেও কেউই তার তোয়াক্কা করে না। আর সাধারণ টয়লেটে প্রচুর পানি খরচ হয়। কিন্তু বায়ো-টয়লেটে পানি খরচ হয় খুবই কম। সাধারণ টয়লেটে বেশি পানি খরচ হওয়ায়-ট্যাংকে থাকা পানি সহজেই ফুরিয়ে যায়। তাতে টয়লেটের চারপাশ মল-মূত্রে ভরে ওঠে। ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে ওঠে টয়লেট। কিন্তু প্রতিটি ট্রেন বায়ো-টয়লেটের আওতায় আনা গেলে প্রাকৃতিক পচন পদ্ধতিতে ৯৫ শতাংশ আবর্জনা মিশ্র সারে পরিণত হবে। এ পদ্ধতি পরিবেশবান্ধব হওয়ায় লাইনের পাশে বসবাসরত জনসাধারণ স্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করতে পারবে। আর যাত্রীরা স্বাস্থ্যকর পরিবেশে করতে পারবে ট্রেন ভ্রমণ।
সূত্র আরো জানায়, বর্তমানে পশ্চিমাঞ্চল রেলেই কেবল মাত্র ব্রডগেজ ট্রেন চলাচল করছে। ওই অঞ্চলে চলা ৫০টি যাত্রীবাহী কোচে অত্যাধুনিক বায়ো-টয়লেট সিস্টেম রয়েছে। ভারতসহ উন্নত রাষ্ট্রের ট্রেনগুলোতে বায়ো-টয়লেট রয়েছে। বর্তমান সরকার ভারত থেকে আনা ১২০টি অত্যাধুনিক ব্রডগেজ যাত্রীবাহী ট্রেনে বায়ো-টয়লেট সংযোগের প্রকল্প গ্রহণ করেছে। তাতে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৩১ কোটি টাকা। পর্যায়ক্রমে বাকি কোচগুলোয় (যেসব কোচে বায়ো-টয়লেট স্থাপন সম্ভব) বায়ো-টয়লেট স্থাপন প্রকল্প গ্রহণ করা হবে। পাশাপাশি পূর্বাঞ্চল রেলপথে চলা যাত্রীবাহী ট্রেনেও বায়ো-টয়লেট স্থাপনে পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। পূর্বাঞ্চল রেলে এসি ১০টি যাত্রীবাহী কোচে মোট ২০টি বায়ো-টয়লেট এবং এসি ৪০টি যাত্রীবাহী কেবিনে ৮০টি বায়ো-টয়লেট ব্যবহৃত হচ্ছে। চলমান কোচগুলোয় বায়ো-টয়লেট স্থাপন করতে নির্দেশনা রয়েছে। যাত্রীদের সুবিধার্থে প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে ট্রেনে অত্যাধুনিক ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
এদিকে এ বিষয়ে রেলওয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) সরদার সাহাদাত আলী জানান, রেলে একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। বর্তমান সরকার ৩০ বছর মেয়াদি মাস্টারপ্ল্যান গ্রহণ করেছে। চলমান প্রকল্পগুলো সমাপ্ত হলে রেলে আমূল পরিবর্তন আসবে। ট্রেনে বায়ো-টয়লেট সময়ের দাবি। তাতে পানি খরচ কমবে। যাত্রীদের বিশ্ব মানের সুযোগ-সুবিধা দিতে হলে বায়ো-টয়লেট লাগবে। স্বাস্থ্যকর পরিবেশে যাত্রীদের ভ্রমণ নিশ্চিত করাই সরকারের লক্ষ্য।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে রেলপথমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন জানান, সরকার রেলে আমূল পরিবর্তন আনছে। অত্যাধুনিক কোচ ক্রয়ে বায়ো-টয়লেট সংযুক্ত কোচ ক্রয় করা হয়েছে। টও্য় দু’শতাধিক কোচে বায়ো-টয়লেট রয়েছে। ইতিমধ্যে বায়ো-টয়লেটবিহীন যেসব অত্যাধুনিক কোচ ক্রয় করা হয়েছে, সেগুলোতে বায়ো-টয়লেট সংযুক্ত করতে প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। পুরাতন স্টেশনগুলোসহ নতুন নির্মিত স্টেশনগুলো অত্যাধুনিক করা হচ্ছে। আমেরিকা থেকে আনা ইঞ্জিনগুলোয় এসি থাকছে। আগামীতে যত ইঞ্জিন-কোচ ক্রয় করা হবে, সবগুলোয় এসি এবং বায়ো-টয়লেট সংযুক্ত থাকবে। আর রেলে চলমান প্রকল্পগুলো সমাপ্ত হলে প্রায় দ্বিগুণ যাত্রী পরিবহণ সম্ভব হবে। যাত্রীসেবা নিশ্চিতসহ আরামদায়ক করতেই রেলে দিন দিন অত্যাধুনিক প্রযুক্তিগুলো সংযুক্ত করা হচ্ছে।