জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ

জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ

সাধন চন্দ্র মণ্ডল : জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে, লড়াই করে চলেছেন কিংবদন্তী ব্যাংকার ও ইকোনোমিস্ট খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ।
অবস্থার তেমন পরিবর্তন নেই। ভেতরের রক্তক্ষরণ বন্ধ না হলে শঙ্কা কাটছে না। এখনো মুখ দিয়ে খাবার দেয়া যাচ্ছে না। তাঁর পরিবার দেশবাসীর কাছে দোয়া কামনা করেছেন।
দেশের প্রথিতযশা ব্যাংকার ও ইকোনোমিস্ট সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ গত ৬ ফেব্রুয়ারী রাতে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে ভর্তি হন। করোনা টেস্টে পজিটিভ রেজাল্ট হলে তাঁর অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে থাকে। তাঁকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান, তাঁর অবস্থা
সংকটাপন্ন ।
হাসপাতালের ডাইরেক্টর এন্ড সিইও আল ইমরান চৌধুরী জানান, তাঁর ফুসফুসের প্রায় ৭০ শতাংশ আক্রান্ত এবং ক্রমেই অবস্থার অবনতি হতে থাকলে তাঁকে ৪ ব্যাগ রক্ত দেয়া হয়। তাঁর অসুস্থতার খবর শোনামাত্র ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে, দেশ ও বিদেশ, পরিচিত- অপরিচিত সকলে স্রষ্টার কাছে দু’হাত তুলে প্রার্থনা করছেন।
দেশের প্রখ্যাত ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদ খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের বর্ণাঢ্য জীবন সর্ম্পকে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জিওগ্রাফিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী এবং পরবর্তীতে আইবিএ থেকে এমবিএ ডিগ্রী অর্জন করে প্রায় ছয় দশক ধরে তিনি ব্যাংকিং খাতে নিরলসভাবে সেবা দিয়ে আসছেন। তাঁর মাদার ব্যাংক অগ্রণী ব্যাংক। এই ব্যাংকে তিনি ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত¦ পালনের পর সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। অত:পর তিনি ১৯৯৮ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নরের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত। তদ্পূর্বে ব্যাংকটি নানা দিক থেকে বিপন্ন ছিল। জানা যায়, তিনি কঠোর হস্তে হাল ধরে তাঁর সুদুর প্রসারী কর্ম-পরিকল্পনায় ব্যাংকটির আমূল পরিবর্তন আনেন।
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ ২০০০ সাল থেকে “কেন্দ্রীয় কচি কাঁচার মেলা”র ডাইরেক্টর, এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সভাপতি ও ট্রাষ্টী বোর্ডের সদস্যের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তিনি ২০০৯ সালে খান বাহাদুর আহসানউল্লাহ স্বর্ণপদক লাভ করেন এবং ২০১৩ সালে খান বাহাদুর নওয়াব আলী চৌধুরী জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন।
দীর্ঘ কর্মময় জীবনে তিনি সর্বদা সততা ও সাহসিকতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। কখনোই অন্যায়ের সাথে আপোষ করেননি বা মাথা নত করেননি। শেয়ার বাজার নিয়ে দেশের অর্থনীতি যখন হুমকির মুখে তখন তিনি কর্তব্যে অবিচল থেকে ধৈর্য্য, সততা ও সাহসিকতার সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করে দেশবাসীর আস্থা অর্জন করেন।
ব্যাংকিং জগতে সততা ও সাহসিকতার আরেক নাম খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। অনেক প্রতিকুল অবস্থায় তাঁকে কাজ করতে হয়েছে। কিন্তু সত্য কথা বলতে তিনি কখনো ভয় পাননি। নীতিতে অটল থেকেছেন আজীবন। তাই তাঁর সকল বক্তব্য অনেকের গাত্রোদাহের কারণ হয়েছে। সমালোচনাও কম শুনতে হয়নি তাঁকে। “সত্য যে কঠিন কঠিনেরে ভালবাসিলাম—সে কখনো করে না বঞ্চনা” কবির এ বাণীকে তিনি নিজের জীবনে বাস্তবায়িত করেছেন। সত্যের যে অভ্রভেদী শক্তি আছে তা তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন। রক্তের অক্ষরে লিখেছেন আপনার নাম, আঘাতে আঘাতে বেদনায় বেদনায়। জীবনের খতিয়ান মিলাতে তাঁর বেশি কষ্ট হবে না । এ জগতে কিছু মানুষ আসে তাঁদের নেয়ার চেয়ে দেয়ার পাল্লা অনেক ভারী। অতি সাধারণ জীবনযাপনে সন্তুষ্ট শুধু নয় পূর্ণ তুষ্ট তাই অর্থের মোহ তাঁকে টলাতে পারিনি কখনোই। অবশেষে সেই চেষ্টা থেকে অপরাধীরা বিরত থেকেছেন । চারিদিকে দূর্নীতির সংবাদে তিনি বিচলিত হয়েছেন সাধ্যমত অভিমত প্রকাশও করেছেন, তার বেশি আর কিই বা করতে পারেন তিনি।
জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোয় দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি ক্রমান্বয়ে নৈতিক অবক্ষয়ের যে চিত্র তুলে ধরেছেন তা ভাববার অবকাশ রাখে। তিনি জানান , ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ তখন ক্ষমতায় , তিনি ডেপুটি গভর্ণর থাকাকালে, ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা এক ব্যবসায়ী গভর্নর লুৎফর রহমান সরকারকে কলার ধরে নিগৃহীত করার ঔদ্ধত্য দেখান। গভর্নর সংগে সংগে তাঁর রুমে আসেন এবং তিনি খবর নিয়ে দেখেন ঐ ব্যবসায়ী চলে গেছেন। এরপর বিষয়টি তৎকালীন অর্থমন্ত্রী শাহ্ এএমএস কিবরিয়াসহ অন্যান্যদের জানালে সেই ব্যক্তি গভর্নরের কাছে এসে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয়। আর একদিন, গভর্নর ড. ফরাসউদ্দিন একটি ব্যাংকের বোর্ড অব ডিরেক্টর এর বিবাদ প্রমানিত হওয়ায় তাৎক্ষণিক কারো সংগে আলাপ করার অপেক্ষায় না থেকে বোর্ড ভেঙে দেন। অর্থ মন্ত্রী বলেন, আপনারা আমাকে জানাতে পারতেন, এখন আপনাদের সিদ্ধান্ত স্থগিত করবেন কি না? কিন্তু গভর্নর মহোদয় স্পষ্ট জানান, সিদ্ধান্ত স্থগিত হবে না, এখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের অস্থিত্বের প্রশ্ন। আর একটি ঘটনা স্মরণ করেন, তিনি এক সভায় অর্থ মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষন করতে মন্তব্য করেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক মাফিযা গ্রিপে আবদ্ধ। অর্থ মন্ত্রী তার বক্তব্যে বিরক্ত হন। পরবর্তীতে তিনি অবহিত হন যে, খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ সোনালী ব্যাংকের এমডি থাকাকালে সিবিএ মাফিয়ার দৌরাত্ম্য, হরহামেশা বোর্ড রুমে ঢুকে দাবীনামা পেশ করা , বদলী ও পদোন্নতি বানিজ্যে অর্থ উপার্জন ইত্যাদি ছিলো মামুলী বিষয়, যা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকও মাথা ঘামাতো না। পরবর্তীতে অর্থমন্ত্রী বিষয়টি আমলে নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এসবই সম্ভব হয়েছে অর্থমন্ত্রীর নৈতিকতা আর প্রতিষ্ঠানসমূহকে সম্ভব রাজনীতিমুক্ত রাখার উদারনৈতিক মানসিকতার জন্য। বর্তমান নৈতিকতার অবক্ষয় হতে হতে তলানীতে ঠেকেছে। আর ব্যাপকভাবে অনৈতিক মানুষের পোলারাইজেশন হচ্ছে ।
সম্প্রতি খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে পূবালী ব্যাংক লিমিটেড এর ইনডিপেন্ডেট পরিচালক হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়। তিনি বোর্ড মিটিং এ অংশগ্রহণও করেন। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক আইনগত প্রশ্ন উত্থাপন করে বলেন, এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর পরিচালক হতে পারবেন কি না ? এরপর আইনজ্ঞের মতামত যেখানে আইনগত বাঁধা নেই মর্মে বিষয়টি সদয় বিবেচনার জন্য পুনঃউপস্থাপন করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক তদীয় আইনজ্ঞের মতামত নিয়ে নাকোচ করে দিয়েছেন বলে জানা যায়।
যে অভিজ্ঞ ব্যক্তি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হলে জনমনে প্রশান্তির বাতাস প্রবাহিত হবে বলে মানুষ বিশ্বাস করে তাঁকে এমন অবস্থায় আপতিত দেখলে কারো ভাল লাগার কথা নয়।
কর্মজীবনের ঊষালগ্নে একজন সুদক্ষ প্রশিক্ষক হিসেবে পেয়েছি খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ স্যারকে। জটিল ও কঠিন বিষয়গুলোকে সহজ বোধগম্য করার অপূর্ব কৌশল তাঁর করায়াত্ত। জ্ঞানের সীমাহীন গভীরতা না থাকলে এটা সম্ভব না। সকল বিষয়ে তাঁর সমান পারঙ্গমতা। ‘লেনদেন’ পড়াতে যেয়ে তিনি শুরু করেছিলেন মানুষের উপলব্ধি নিয়ে। কখন সে উপলব্ধি করতে পারে। আমরা অনেক কিছু বললাম কিন্তু স্যার যখন বললেন আমরা চমকে উঠলাম। মাতৃগর্ভ থেকে মানুষ লেনদেনে রেসপন্স করে। স্যারের বলা এক ঘটনা যা আমৃত্যু মনে থাকবে সবিনয়ে নিবেদন করছি ঃ
স্যার তখন সিনিয়র অফিসার মাদারীপুর পোষ্টিং। এসডিও সাহেব আর স্যার এক ভবনে থাকেন। এসডিও সাহেব খুব ভাল মানুষ। তাঁর অফিসে একজন সিনিয়র ব্যক্তি আছেন দীর্ঘদিন যাঁর পদোন্নতি হয় না। তাঁর চোখের সামনে দিয়ে জুনিয়রদের পদোন্নতি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু তাঁর হচ্ছে না অথচ তিনি লেখা পড়ায় ভালো, কাজেও ভালো। হতাশ হয়ে একদিন খালেদ স্যারকে জানালেন, তাঁর বিশ্বাস খালেদ স্যার বললে এসডিও সাহেব না করতে পারবেন না। অগত্যা একদিন অন্তরঙ্গ পরিবেশে স্যার প্রসঙ্গটি তুললেন। সপক্ষে অনেক যুক্তি দিলেন। তখন এসডিও সাহেব বললেন, “খালেদ সাহেব, আপনার কথা সবই ঠিক আছে তবে আমি প্রতিদিন একটু আগে অফিসে যেয়েই সবাইকে নিয়ে বসি। পূর্বদিনের কাজে কোন ক্রুটি থাকলে সেবিষয়ে আলোচনার পর আজকে গুরুত্বপূর্ণ কি কি কাজ আছে সবই আলোচনায় আসে। ঐসময় জুনিয়র অফিসাররা সুযোগ পেলেই আমাকে তেল দেয়, আমি বুঝতে পারি তবুও খারাপ লাগে না, ভালোই লাগে। তখন ঐ সিনিয়র ব্যক্তিও আমাকে তেল দিতে যায় কিন্তু সে তেল দেয় আমার চোখে, আমার চোখ জ্বালা করে। তাঁর ওপর সন্তোষের পরিবর্তে আমার অসন্তোষই ক্রিয়াশীল থেকেই যায়।
আমাদের সমাজে আজ সৎ মানুষের বড় অভাব। সাগরকুলে যে সকল মৎস্যারোহী মাছ শিকার করে তাঁরা ১৫থেকে ২০ দিনের জন্য লোকালয় থেকে খাওয়ার পানি সংগে নিয়ে যায়, পানি ফুরিয়ে গেলে তাঁদের আর থাকা চলে না , ফিরে আসতে হয়। তাঁদের বক্তব্য পানির ওপরে থাকি কিন্তু সুপেয় পানির বড় অভাব। চারিদিকে লক্ষ লক্ষ মানুষ কিন্তু সৎ মানুষের বড়ই আকাল। সততার বুলি বক্তৃতায় যত সহজ বাস্তবে ততই কঠিন। সততার মাপকাঠিতে একটা লেবেল পর্যন্ত সৎ থাকলেও শেষ অবধি সৎ থাকতে পারিনি এমন অনেক নজির আমাদের মাঝে আছে। আবার ফিন্যান্সিয়ালি সৎ তো ইথিক্যালি অসৎ। আমার সাথে অনেকেই একমত হবেন যে, খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ স্যার সর্বেব সৎ, তিনি সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এক অনন্য উচ্চতায় তুলেছেন নিজেকে। আমাদের সমাজে অসৎ মানুষের শাস্তি দেয়ার জন্য অনেক ব্যবস্থা আছে। যদিও অসৎ ব্যক্তিরা সকল ব্যবস্থা নির্বিঘ্নে পেরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সৎ ব্যক্তির মূল্যায়নের তেমন ব্যবস্থা আছে বলে মনে হয় না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপ্রাণ চেষ্টা করছেন, সৎ ব্যক্তির মূল্যায়ন করা বা যথাযথ পদায়ন করার জন্য। সরকারের পক্ষ থেকে সৎ মানুষদেরকে এমন দৃষ্টান্তমূলক পুরস্কৃত করা প্রয়োজন যা দেখে অনুজরা উৎসাহিত হয় সততার চর্চা করতে। তাদের মনে এ প্রতীতী গ্রত্থিত হোক “সততাই উৎকৃষ্ট পন্থা” —ইহকাল পরকাল সর্বাবস্থায় আত্মবিশ্বাসে অবিচল, অটল ও অনড় থাকুক নিরন্তর।

Leave a reply

Minimum length: 20 characters ::

More News...

বাংলাদেশি কর্মীদের বেতন না দিয়ে শাস্তির মুখে মালয়েশিয়ান কোম্পানি

বিশ্বকাপ খেলতে যুক্তরাষ্ট্রের পথে বাংলাদেশ দল