মোঃ আবু তালেব : আইনে বাধ্যতামূলক থাকলেও ঢাকা ও এর আশপাশে গড়ে ওঠা হাজার হাজার শিল্প-কারখানা বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) ছাড়াই কার্যক্রম চালাচ্ছে। ওসব প্রতিষ্ঠান নিয়ম-নীতির কোনো তোয়াক্কা করছে না। আর ওসব প্রতিষ্ঠান থেকে ঢাকার চার নদীতে প্রতিদিন সরাসরি মিশছে প্রায় ৬০ হাজার কিউবিক মিটার বর্জ্য। ওসব বর্জ্যের মধ্যে রয়েছে টেক্সটাইল, ডাইং, প্রিন্ট ও ওষুধ শিল্প-কলকারখানার বর্জ্য। মূলত ঢাকার ১১টি শিল্প অঞ্চল থেকে ৫০টির মতো উৎসমুখ দিয়ে শিল্প-কারখানার তরল বর্জ্য সরাসরি নদীতে পড়ছে। তার বাইরের ভূগর্ভস্থ বহু গোপন পাইপ লাইনের মাধ্যমেও বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের অপরিশোধিত বর্জ্য খাল ও নদীতে পড়ছে। ঢাকা দুই সিটির ৫৬ শতাংশ বর্জ্যই যত্রতত্র নদী, জলাশয়ে গিয়ে পড়ছে। ফলে পানি দূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করছে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দীর্ঘ বর্ষা মৌসুম শেষে শুষ্ক মৌসুম আসছে। ওই সময় মৌসুমে ঢাকার চার নদীসহ দেশের বিভিন্ন নদ-নদী ও জলাশয়ে পানি প্রবাহের পরিমাণ একেবারেই কমে যায়। পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় ঢাকার চার নদীতেই দূষণ বাড়তে থাকে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, বুড়িগঙ্গসহ অন্য নদীর ধার দিয়ে চলাচলও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়। ইতিমধ্যে ওসব নদীর পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ একেবারেই শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পানি ব্যবহারের জন্য প্রতি লিটারে কম করে হলেও ৫ মিলিলিটার দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ থাকতে হয়। ঢাকার চারপাশের চার নদীর পানির অক্সিজেনের পরিমাণ নেমে এসেছে প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। আর এতো কম অক্সিজেনে পানিতে কখনো কোন জলজপ্রাণী বেঁচে থাকতে পারে না। পানি দূষণের কারণে দীর্ঘদিন ধরে ঢাকার চার নদীতে কোন জলজ প্রাণীর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
সূত্র জানায়, প্রতিদিনই অপরিশোধিত দূষিত বর্জ্যরে পাশাপাশি বিভিন্ন শিল্প-প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য, স্যুয়ারেজের মাধ্যমে পয়ঃবর্জ্য নদীতে পড়ছে। স্যুয়ারেজের মাধ্যমে প্রতিদিন নদীতে মেশে ১৪ লাখ ঘনমিটার তরল বর্জ্য। তাছাড়া নদীর বুকে চলাচলকারী নৌযানের পোড়া মবিল এবং অন্যান্য বর্জ্যও নদীতে পড়ছে। নদীর পাশে বাসাবাড়ি এবং সিটি কর্পোরেশনের কঠিন বর্জ্যও প্রতিদিন নদী পাড়ে ফেলে ঢাকার চার নদীকে বর্জ্য ফেলার ভাগাড়ে পরিণত করা হচ্ছে। ফলে সরকারের নদী রক্ষা কার্যক্রম কোন সফলতার মুখ দেখছে না। নদী দূষণের হাত থেকে রক্ষা করা না হলে ঢাকা শহরে বসবাসকারী জনগণের স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা রয়েছে। শিল্পবর্জ্য অবশ্যই পরিশোধন করে নদীতে ফেলতে হবে। সেজন্য যেসব প্রতিষ্ঠানে ইটিপি নেই তাদের ইটিপি স্থাপনে বাধ্য করা জরুরি। তাছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠানে ইটিপি থাকলেও তারা অধিক খরচের ভয়ে তা পরিচালনা করছে না। আর নগরীর মানুষের পয়ঃবর্জ্য কোন ধরনের পরিশোধন ছাড়াই নদীতে পড়ছে। তার মধ্যে ওয়াসার মাধ্যমে সামান্য কিছু পরিশোধন করা হলেও বাকি বর্জ্য অপরিশোধিত অবস্থায় নদীতে পড়ছে। সেগুলো বন্ধ করা না গেলে দূষণমুক্ত করা যাবে না।
সূত্র আরো জানায়, বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা নদীকে ঢাকার প্রাণ বলা হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজধানী ঢাকাকে বাঁচাতে হলে চার নদী রক্ষা করা জরুরি। এমনকি ঢাকার চার নদী রক্ষা করা না গেলে রাজধানী বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে বলে বিগত ২০০৯ সালে আদালতের রায়েও উল্লেখ করা হয়েছিল। নদী রক্ষায় আদালতের সুস্পষ্ট রায় থাকলেও দূষণ রোধে আজ পর্যন্ত দৃশ্যমাণ কোনো পদক্ষেপ নেই। যদিও অবৈধ নদী দখল রোধে বহুবার অভিযান চালানো হয়েছে। কিন্তু অবৈধ উপায়ে চলা কোন শিল্প-প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কমই। ফলে নদী তীরবর্তী এলাকা থেকে ট্যানারি শিল্প স্থানান্তর করেও ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গারসহ চার নদীর কাক্সিক্ষত কোনো উন্নতি হয়নি। অথচ এদেশের প্রধান সম্পদই হচ্ছে তার নদীসহ পানিসম্পদ। ভূগর্ভস্থ পানি ও ভূ-উপরিস্থ নদী-নালা-খাল-বিল। এর জন্যই বাংলাদেশ প্রাণবৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ, জমি উর্বর এবং জলপথ সম্ভাবনাময়। এর সঙ্গে এদেশের ভূপ্রকৃতি, মানুষের জীবন-জীবিকা ও সংস্কৃতি গভীরভাবে সম্পর্কিত। কিন্তু উন্নয়নের নামে প্রাণ-প্রকৃতি-সম্পদ, জনস্বাস্থ্য-জনজীবন নদী-সমুদ্র, ভূগর্ভস্থ পানি সম্পদ তথা জননিরাপত্তা সবই ভয়াবহভাবে আক্রান্ত। এর কারণে জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের বিপদও বাড়ছে। নদীর পানি প্রবাহের ওপরই বাংলাদেশের জন্ম। নদী বিপন্ন হলে বাংলাদেশের অস্তিত্বও বিপন্ন হবে। চোখের সামনে বাংলাদেশের প্রাণ নদী একের পর এক ধ্বংস হচ্ছে। তা রক্ষার কোন উদ্যোগ নেই। নদী বিদ্বেষী উন্নয়ন কৌশল, দেশের নদী দখলদারদের সঙ্গে পুলিশ প্রশাসনসহ রাজনৈতিক ক্ষমতার যোগসাজশ এবং নদীর পানি নিয়ে বাঁধ ও নদী সংযোগ পরিকল্পনাসহ ভারতের অন্যায় এক তরফা আগ্রাসী তৎপরতার কারণে আজ নদীগুলোর ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। তার সঙ্গে দখল ও দূষণের ফলে নদীগুলোর আরো করুণ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
এদিকে নদী রক্ষা কার্যক্রম মূলত অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ কার্যক্রমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। তার বাইরে নদীর দূষণ রক্ষায় এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দৃশমান নেই। নদী দখল, দূষণ ও নদীর পানি প্রবাহ বন্ধ করে স্থাপনা নির্মাণ মামুলি বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এখন সবাই নদীকে উপার্জনের উৎসে পরিণত করেছে। এর পেছনে দেশের কিছু রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জড়িত। গত বছরের লকডাউন সময় পরিবেশ অধিদফতরের এক পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, গত বছর এপ্রিলে রাজধানীকে ঘিরে রাখা নদ-নদীর পানির মান বেশ উন্নতির দিকে ছিল। দুই মাস বাদেই তার মান অবনতির দিকে যেতে থাকে। বিগত দুই দশকে বেশ সময় ধরে ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গা তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যাকে বর্জ্যের ভাগাড়ে পরিণত করা হয়েছে। বুড়িগঙ্গা এখন পরিণত হয়েছে ঢাকার মহানগীর বর্জ্য ফেলার এক বড় ড্রেনে। ফলে নদীর পানির গুণগতমানের অবনতি হয়ে অতি দূষণে নদীর মাছ ও জলজ প্রাণী হারিয়ে গেছে। শিল্প, বাণিজ্য, কৃষি ও গৃহস্থালি কাজে নদীর পানি ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। আর জীবাণুজনিত দূষণেও জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে দাঁড়িয়েছে।
অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা জানান, জনঘনত্ব বিবেচনায় মাস্টারপ্ল্যানের অভাব, ত্রুটিযুক্ত ডিজাইন ও বিভিন্ন সেবাদানকারী সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে মহানগরীর ড্রেনেজ ও স্যুয়ারেজ ব্যবস্থায় মহাবিপর্যয়কর অবস্থা বিরাজ করছে। জনঘনত্বের সঙ্গে স্যুয়ারেজের সম্পর্ক রয়েছে। স্যুয়ারেজ, ড্রেনেজ লাইনসহ বিদ্যুৎ-গ্যাসের নতুন সংযোগ প্রদান ও মেরামতের জন্য সারাবছরই বিশেষ করে বর্ষাকালে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি চলতে থাকে। ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় পানি জমে যায় এবং ভারি বর্ষণে শহরের অধিকাংশ এলাকা জলাবদ্ধতায় প্রায় অচল হয়ে পড়ে। তখন ড্রেনেজ লাইনের সঙ্গে স্যুয়ারেজের বর্জ্য মিশে দুর্বিসহ পরিস্থিতি তৈরি হয়। তাছাড়া অপ্রতুল পয়ঃবর্জ্য ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণে বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলায় পরিবেশগত ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। বিদ্যমান স্যুয়ারেজ সিস্টেমের অপ্রতুলতা সত্ত্বেও অপরিকল্পিতভাবে নিত্যনতুন বাসাবাড়ির বর্জ্যের সংযোগ দেয়া হচ্ছে। ধারণক্ষমতা বিবেচনা না করে নতুন নতুন সংযোগের ফলে অধিকাংশ সময়ই আগের ড্রেনের সঙ্গে নতুন লাইনের সংযোগ ম্যাচ করে না। পয়ঃবর্জ্য পরিশোধন না করে নদী, খাল, বিল বা জলাধারে ফেলা জনস্বার্থেই কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা জরুরি। প্রয়োজনে পয়ঃবর্জ্যকে সম্পদে রূপান্তরিত করার ব্যবস্থা নিতে হবে। নতুন কোনো আবাসিক এলাকা করার সময় তাদের নিজস্ব পয়ঃবর্জ্য ব্যবস্থাপনা রাখা বাধ্যতামূলক করতে হবে। নতুন আবাসিক প্রকল্পসমূহে পয়ঃবর্জ্য ব্যবস্থাপনার ব্যবস্থা নিশ্চিত করেই অনুমোদন দিতে হবে। দূষণের হাত থেকে নদীগুলোকে বাঁচাতে প্রাকৃতিক ড্রেনেজ ব্যবস্থা হিসেবে ঢাকার খাল, নদী, জলাধারগুলো উদ্ধার করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে ।
এ প্রসঙ্গে নদী রক্ষা কমিশনের সদ্যবিদায়ী চেয়ারম্যান ড. মুজিবুব রহমান হাওলাদার তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন মহানগরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য দায়বদ্ধ। কিন্তু ঢাকা মহানগরীতে প্রতিদিন ৪৪ শতাংশ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আওতায় ডাম্পিং করা হচ্ছে। বাকি বর্জ্যগুলো যত্রতত্র পড়ে থাকছে। সেগুলো বিভিন্ন উপায়ে জলাশয়ে গিয়ে মিশছে।