জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্রীয় খেতাব বাতিলের সিদ্ধান্ত

জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্রীয় খেতাব বাতিলের সিদ্ধান্ত

নিজস্ব প্রতিবেদক : সাবেক সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা পদক প্রত্যাহারের পর এবার তার ‘বীর উত্তম’ খেতাব বাতিল হচ্ছে। সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি শরিফুল হক ডালিম, এবিএমএইচ নূর চৌধুরী, রাশেদ চৌধুরী এবং মোসলেহ উদ্দিন ওরফে মোসলেম উদ্দিনের মুক্তিযুদ্ধের খেতাব বাতিলেরও সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) মহাপরিচালক মো. জহুরুল ইসলাম রোহেল জানিয়েছেন। গতকাল বুধবার তিনি বলেন, জামুকার বৈঠকে সদস্যরা বিস্তারিত আলোচনার পর এই পাঁচজনের খেতাবের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এখন আমরা প্রস্তাব আকারে তা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠাব, মন্ত্রণালয় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের সভাপতিত্বে জামুকার ওই সভায় অন্য সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন। একজন কর্মকর্তা জানান, সংবিধান লঙ্ঘন, বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের দেশত্যাগে সহায়তা এবং তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়নের কারণে জিয়াউর রহমানের খেতাব বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়েছে। আর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় দণ্ডিত চার পলাতক খুনির খেতাব স্থগিতের জন্য হাই কোর্ট একটি আদেশ দিয়েছিল গতবছরের শেষ দিকে। খেতাব বাতিল হলে তারা এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য আর কোনো রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা পাবেন না। মুক্তিযুদ্ধে একটি সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করা জিয়াউর রহমান ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে সেনাপ্রধান হন। ৭ নভেম্বরের সামরিক অভ্যুত্থানের পর শাসন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন তখনকার মেজর জেনারেল জিয়া। ১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর তিনি হন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। ১৯৭৭ এর ২১ এপ্রিল বিচারপতি আবু সাদাত সায়েমকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরে যেতে হয়, জিয়া তখন ওই দায়িত্বও নেন। সে সময় জিয়ার সামরিক শাসনকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টায় একটি গণভোটের আয়োজন করা হয়, যাতে ৯৮.৯ শতাংশ ‘হ্যাঁ’ ভোট পড়ার দাবি করা হয়। সামরিক আইন প্রশাসক থাকা অবস্থায় জিয়াউর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) নামে একটি ডানপন্থি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গঠিত হয়। তবে সে দল তখন দেশের রাজনীতিতে নাড়া দিতে পারেনি। ওই বছর ১ মে জিয়াউর রহমানকে চেয়ারম্যান করে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট’ ঘোষণা করা হয়। সেনাবাহিনী প্রধানের পদে থেকে পুরাদস্তুর রাজনীতিবিদ বনে যান জিয়া। ৩ জুন নির্বাচন দিয়ে ওই ‘জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট’ থেকে প্রার্থী হয়ে তিনি ‘নির্বাচিত’ রাষ্ট্রপতি হন। নির্বাচনের তিন মাসের মাথায় ১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর ঢাকার রমনা রেস্তোরাঁয় এক সংবাদ সম্মেলনে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে সেনাবাহিনীর একদল সদস্যের অভ্যুত্থানে নিহত হন সে সময় রাষ্ট্রপতি পদে থাকা জিয়া। ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত সময়ে তার সামরিক শাসনকে বৈধতা দেওয়া হয়েছিল সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে। ২০০৫ সালে হাই কোর্টের এক রায়ে ওই সংশোধনী অবৈধ হয়ে যায়। আর ২০১০ সালে সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী বাতিলের রায়ে হাই কোর্ট বলে, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, আবু সা’দাত মোহাম্মদ সায়েম ও জিয়াউর রহমানের মতো এইচএম এরশাদও ছিলেন ‘অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী’। ২০০৩ সালে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জিয়াউর রহমানকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার দিয়েছিল। খালেদা জিয়ার সরকারের ওই পদক্ষেপকে ‘জিয়াকে উপরে তোলার চেষ্টা’ হিসেবে বর্ণনা করে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা সে সময় জাতির জনককে ‘অবমাননার’ তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। ২০১৬ সালের অগাস্টে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার জিয়ার স্বাধীনতা পদক প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়। পরে জাতীয় জাদুঘর থেকে তার পদকটি সরিয়ে নেওয়া হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার চার বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার ঘটনার নেতৃত্বে ছিলেন কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা, যদিও এর পেছনে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের কথা আওয়ামী লীগ নেতারা বরাবরই বলে আসছেন। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার দশ দিনের মাথায় সেনাপ্রধানের দায়িত্ব পাওয়া জিয়াও ওই হত্যাকাণ্ডে ‘পুরোপুরি’ জড়িত ছিলেন বলে বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতির পিতার খুনিদের রক্ষায় সে সময় একটি অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন তখনকার ‘স্বঘোষিত’ রাষ্ট্রপতি খোন্দকার মোশতাক আহমেদ। পরে জিয়াউর রহমান ক্ষমতা নিয়ে সংবিধান সংশোধন করে খুনিদের রক্ষার পথটি স্থায়ী করার প্রয়াস চালান। হত্যাকারীদের নানা পদ দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পর ইতিহাসে চিহ্নিত কালো ওই অধ্যাদেশ বাতিলের পর জাতির পিতার খুনের বিচারের পথ খোলে। এরপর বিচার প্রক্রিয়া শেষে আদালতের চূড়ান্ত রায় অনুযায়ী ছয় খুনির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। তবে মৃত্যুদণ্ড মাথায় নিয়ে পাঁচজন এখনও রয়েছেন পলাতক। তাদের মধ্যে নূর চৌধুরী ‘বীর বিক্রম, শরিফুল হক ডালিম ‘বীর উত্তম’, রাশেদ চৌধুরী ‘বীর প্রতীক’ এবং মোসলেহ উদ্দিন খান‘বীর প্রতীক’ খেতাবধারী। এক রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে হাই কোর্ট গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর ওই চারজনের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পাওয়া বীরত্বের খেতাব স্থগিতের নির্দেশ দেয়। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ও মন্ত্রীপরিষদ সচিবকে ওই নির্দেশ বাস্তবায়নের পাশাপাশি রুল জারি করে হাই কোর্ট। সেই প্রেক্ষাপটে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) বৈঠকে খেতাব বাতিলের সিদ্ধান্ত হয় বলে কর্মকর্তারা জানান।

Leave a reply

Minimum length: 20 characters ::

More News...

বাকেরগঞ্জে বিদ্যুৎ স্পর্শ হয়ে একই পরিবারের ৩ জনের মৃত্যু

মাদারীপুরে সুশাসন প্রতিষ্ঠার নিমিত্ত অংশীজনের (Stakeholders) অংশগ্রহণে মতবিনিময় সভা