নিজস্ব প্রতিবেদক ; কিছুতেই থামছে না নদী দখল ও দূষণ। নদী খেকোরা ক্রমশ বেপরোয়া হয়ে উঠছে। ফলে নদী দখল ও দূষণ রোধে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে সরকার।
ওই লক্ষ্যে আইনে শাস্তি বৃদ্ধিসহ জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের ক্ষমতাও বাড়ানো হচ্ছে। এমনকি খসড়া আইনে নদী সংক্রান্ত অপরাধের বিচারের জন্য নদী রক্ষা কোর্ট গঠনের বিধানও রাখা হয়েছে। সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদন্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রেখে ‘জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন’ আনা হচ্ছে। আর ওই আইন প্রয়োগে সংশ্লিষ্ট সংস্থা ব্যর্থ হলে কমিশনের কাছে তাদের জবাবদিহি করতে হবে এবং কমিশন তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থাসহ প্রয়োজনে ফৌজদারি দন্ডবিধির আওতায় ব্যবস্থা নিতে পারবে। ইতিমধ্যে আইনের খসড়া চূড়ান্ত হয়েছে। এখন মতামত গ্রহণের পালা চলছে। আইনটি অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে চলতি মাসেই উত্থাপনের কথা রয়েছে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিগত ২০১৩ সালে বর্তমান নদী রক্ষা কমিশন আইনটি প্রণীত হয়। বিদ্যমান আইনে নদী দখল ও দূষণের অপরাধের জন্য তেমন কোনো শাস্তি নির্ধারিত ছিল না। ফলে নদী দূষণ ও দখল রোধে সুপারিশ করা ছাড়া নদী রক্ষা কমিশনের কোন কাজ ছিল না। কিন্তু নতুন আইন অনুযায়ী কমিশন নদী দখল ও দূষণ রোধ এবং নদীর উন্নয়নের জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে নির্দেশনা দিতে পারবে। আর সংস্থাগুলোও ওই নির্দেশনা মানতে বাধ্য থাকবে। যদি সংস্থাগুলো তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয় তাহলে কমিশন ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে। খসড়া আইনে নদী সংক্রান্ত অপরাধের বিচারের জন্য ‘নদী রক্ষা কোর্ট’ গঠনেরও বিধান রাখা হয়েছে। খসড়া আইনে দখলদার যতো প্রভাবশালীই হোক না কেন, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে। খসড়া আইনে ১৪টি অধ্যায়ে ধারা রয়েছে ১০৮টি। তাছাড়া শাস্তি সংক্রান্ত ৩টি তফসিল রয়েছে। বর্তমান আইনে ৪টি অধ্যায়ে ২১টি ধারা রয়েছে।
সূত্র জানায়, বর্তমান আইনে কমিশনের ১৩টি কার্যাবলীর কথা বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, নদীর অবস্থা পর্যবেক্ষণ-পরিবীক্ষণ করে কমিশন সুপারিশ করবে। কারণ উন্নয়ন করতে হলে সুপারিশ করতে হবে। ইতিমধ্যে আদালত দুটি আদেশ দিয়েছেন। আদালত নদী রক্ষা কমিশনকে ইতিমধ্যে নদীর অভিভাবক নির্ধারণ করে দিয়েছেন। পাশাপাশি উন্নয়নসহ নদী রক্ষায় কমিশন সব কাজ করতে বাধ্য বলেও আদালত আদেশ দিয়েছেন। হাইকোর্টের আদেশই চূড়ান্ত, আইনে না থাকলেও আইনের মতোই গণ্য করতে হবে। কারণ আদালত দেখে গত কয়েক বছরে নদী রক্ষায় যেসব সুপারিশ কমিশন দিয়েছে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো তা ফেলে রেখেছে। তারা কোন কাজই করেনি। নদী রক্ষা কমিশন আইনে না থাকলেও অন্যান্য আইনে নদীর দখল-দূষণের বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার বিধান আছে। সেটা না নেয়ায় নদী দখল ও দূষণ বন্ধ হচ্ছে না। কমিশনের পক্ষ থেকে মাঠে গিয়ে সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে সঙ্গে নিয়ে কিছু কাজ করাতে পেরেছে। এখন পর্যন্ত নদী রক্ষা কমিশন প্রায় ৫৮ হাজার নদী দখলদার ও দূষণকারীর তালিকা প্রকাশ করেছে। তার মধ্যে ১৯ হাজারের মতো দখলদারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। কমিশন প্রভাব খাটিয়ে এই কাজগুলো করলেও আইনে কিন্তু সেটা নেই। আইনের বলে কমিশন তা করতে পারছে না। কিন্তু খসড়া আইনে নদ-নদীর অবৈধ দখল, দূষণ, নাব্য কমানো, পানি, পরিবেশ-প্রতিবেশ, জীববৈচিত্র্যসহ বহুমাত্রিক ব্যবহার বিঘ্নিত বা সঙ্কটাপন্ন হয় বা হওয়ার আশঙ্কা থাকে তবে কমিশন নদী ও নদী সংলগ্ন এলাকাকে পরিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করতে পারবে।
সূত্র আরো জানায়, নদী রক্ষা কমিশন নির্বাহী ক্ষমতা ব্যবহারের মাধ্যমে কারোর ক্ষমতা নিতে আগ্রহী নয়। বরং কমিশন চাচ্ছে নদীর দখল-দূষণ রোধে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে যেমন- বিআইডব্লিউটিএ, পরিবেশ অধিদফতর, পানি উন্নয়ন বোর্ড, জেলা প্রশাসনসহ অন্যদের যে ক্ষমতা দেয়া আছে তারাই তাদের আইনের ব্যবহার করুক। যদি তারা সেটা না করে তবে কমিশনের কাছে তাদের জবাবদিহি করতে হবে। তাদের যুক্তি গ্রহণযোগ্য না হলে তখন কমিশন ক্ষমতা ব্যবহার করবে। কারণ নদীকে তো রক্ষা করতেই হবে। কমিশন দায়িত্ব অবহেলাকারীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করে দেবে। নদী রক্ষায় কমিশনকে সংস্থাগুলো যে কোনো সহযোগিতা দিতে বাধ্য থাকবে। এসব বিষয়ই আইনের খসড়ায় থাকছে। বর্তমান কমিশন আইনে নদী দখল ও দূষণকারীদের জন্য কোন সুনির্দিষ্ট শাস্তির কথা নেই। তবে দণ্ডবিধিতে নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করার শাস্তির কথা আছে। পরিবেশ আইনেও নদী দখল-দূষণের বিষয়ে শাস্তির বিধান আছে। পানি আইনেও নদী সংক্রান্ত অপরাধের জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে। কিন্তু নদীর ক্ষেত্রে এই আইনগুলোর বাস্তবায়ন সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো করেনি। ফলে নদী দখল ও দূষণের জন্য কাউকে কারাদণ্ড পেতে হয়নি। শুধু কিছু জরিমানা করা হয়েছে। নতুন কমিশন আইনে ওই আইনগুলোর শাস্তির বিষয়গুলো উল্লেখ করা থাকবে। একইসঙ্গে নদী সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অপরাধের শাস্তি নির্দিষ্ট করে দেয়া হবে। আইনের প্রয়োগে সংশ্লিষ্ট সংস্থা ব্যর্থ হলে কমিশনের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। তখন তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা এমনকি ফৌজদারি দণ্ডবিধির আওতায়ও ব্যবস্থা নেয়া যাবে। কমিশন এই ব্যবস্থা নিতে পারবে।
এ;িতে খসড়া নদী রক্ষা কমিশন আইনে বলা হয়েছে, কমিশন নদীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দফতর, অধিদফতর ও সংস্থা এবং বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা নদী রক্ষা কমিটির কার্যাবলী সমন্বয় করবে। কমিশন আবশ্যক বিবেচিত যে কোন পরামর্শ এবং সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য পাঠাবে, যা যৌক্তিক কিংবা আইনগত কোন কারণ ছাড়া সংশ্লিষ্টরা বাস্তবায়ন করতে বাধ্য থাকবে এবং বাস্তবায়নের অগ্রগতি প্রতিবেদনের মাধ্যমে কমিশনকে জানাবে। তাছাড়া কমিশন নদী সংশ্লিষ্ট অন্য কোন আইন প্রয়োগে নদীর অবৈধ দখলমুক্ত করা এবং পুনর্দখল রোধে এবং উচ্ছেদ ও উদ্ধারে জেলা প্রশাসক ও কালেক্টরসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা, পরামর্শ বা সুপারিশ দেবে। যা তাদের আবশ্যই পালন করতে হবে। বিশেষ ক্ষেত্রে গুরুত্ব বিবেচনায় উচ্ছেদ ও নদ-নদীর ভূমি উদ্ধারে প্রতিনিধি নিয়োগ দিয়ে অভিযানে নেতৃত্ব দিতে পারবে কমিশন। নদীর মধ্যে কিংবা তীরভূমিতে বা নদীর বর্ধিত ভূমিতে ও নদীর নির্ধারিত প্লাবন ভূমিতে অবৈধ স্থাপনা বা কাঠামো নির্মাণ ও নানাবিধ অনিয়ম রোধ এবং নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ নিশ্চিতে প্রয়োজনে কমিশন কার্যকর আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে কিংবা সংশ্লিষ্টদের ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেবে। কমিশন দেশের নদী রক্ষায় মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করবে এবং এর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘকালীন পরিকল্পনা নেবে এবং তা বাস্তবায়নের জন্য সরকারের কাছে অর্থায়নের সুপারিশ বা প্রস্তাব করবে বলে খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে। দেশের মধ্যে ও দেশের মধ্য দিয়ে প্রবহমান সব নদী আইনি ব্যক্তি ও জীবন্ত সত্তা হিসেবে বিবেচিত হবে।
অন্যদিকে নতুন আইনে ‘সরকার’ বলতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে বোঝাবে জানিয়ে নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান জানান, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করে কমিশন কাজ করবে। কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করবে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কমিশনের কোন কাজ থাকবে না। নতুন আইনে নদী রক্ষা কোর্ট করার বিধানও রয়েছে। বিদ্যমান কোর্টেও বিচার চলবে, মোবাইল কোর্টও থাকবে। তাতে মামলা নিষ্পত্তিতে গতি আসবে। খসড়া আইনে বলা হয়েছে, চেয়ারম্যান ও কমপক্ষে ২ জন নারী সদস্যসহ সর্বোচ্চ ৭ সদস্যের সমন্বয়ে কমিশন গঠিত হবে। কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য প্রত্যেকে সর্বোচ্চ ৫ বছরের জন্য নিয়োগ পাবেন। কোন ব্যক্তি চেয়ারম্যান বা সদস্য পদে সর্বোচ্চ দুই মেয়াদের জন্য নিয়োগ পাবেন, তবে বয়স ৭০ বছর হলে অবসরে যেতে হবে। কমিশনের চেয়ারম্যান ও ৩ সদস্য পূর্ণকালীন সময়ের জন্য কর্মরত থাকবেন এবং অন্য ৩ সদস্য সাম্মানিক ও খণ্ডকালীন হবেন। বর্তমানে একজন নারী সদস্যসহ কমিশন ৫ সদস্য বিশিষ্ট। চেয়ারম্যান ও সদস্যদের মেয়াদ ৩ বছর।