সারাদেশে অবাধে ভরাট হয়ে যাচ্ছে জলাভূমি

সারাদেশে অবাধে ভরাট হয়ে যাচ্ছে জলাভূমি

নিজস্ব প্রতিবেদক  : দেশজুড়েই জলাভূমি সংরক্ষণের আশানুরূপ কোনো উদ্যোগ নেই। বরং সরকারি বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে সারাদেশেই প্রশাসনের সামনে অবাধে পুকুরসহ জলাভূমি ভরাট করে ঘরবাড়ি-কলকারখানাসহ নানা অবকাঠামো তৈরি হচ্ছে। কোথাও কোথাও জলাশয় ভরাট করে সরকারি অবকাঠামোও গড়ে উঠেছে। মূলত আইনের ফাঁকফোকর এবং প্রয়োগের অভাবেই প্রকৃতির আধার জলাভূমি রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে কমছে। ফলে কমছে পানির স্তর। তাতে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে পরিবেশ। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি), ঢাকা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) এবং পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সারাদেশে প্রতিবছর ৪২ হাজার একর জলাশয় ও কৃষিভূমি ভরাট হচ্ছে। দিন দিন ভরাটের মাত্রা আরো বাড়ছে। বিগত ১৯৯৯ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে ৫ হাজার ৭৫৭ একর জলাভূমি ভরাট হয়েছে। ফলে প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও নগরের ভারসাম্য ব্যাহত হচ্ছে। পাশাপাশি শহরের বৃষ্টির পানি সুষ্ঠু নির্গমনের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, আদর্শ একটি শহরের ১০-১৫ শতাংশ এলাকা জলাশয় থাকা প্রয়োজন। কিন্তু ঢাকা শহরে জলাভূমির পরিমাণ প্রায় ৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ, যা ২০ বছর আগে ১৪ দশমিক ২৫ শতাংশ ছিল।
সূত্র জানায়, বিগত ২০১০ সালে যখন ঢাকা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) করা হয় তখন মূল ঢাকা শহরে জলাভূমি ছিল ৯ হাজার ৫৫৬ একর। ২০১৯ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৬ হাজার ৭৩ একর। অর্থাৎ ৯ বছরে ভরাট হয়েছে মোট জলাভূমির ৩৬ শতাংশ। ওই সময়ে সাভারে মোট জলাভূমির ১৫ শতাংশ, গাজীপুরে ১৭ শতাংশ, রূপগঞ্জে ৪১ শতাংশ ও কেরানিগঞ্জে ২১ শতাংশ ভরাট হয়েছে। ওই হিসাবে ড্যাপ বা ঢাকাসহ আশপাশের এলাকায় নির্ধারিত এক লাখ ৯৩৭ একর জলাভূমির মধ্যে ২০১৯ সাল নাগাদ ভরাট হয়েছে ২২ হাজার ৫১৬ একর, যা মোট জলাভূমির প্রায় ২২ শতাংশ। ইতিমধ্যে ৬টি এলাকায় মোট ৪১ শতাংশ জলাধার ভরাট হয়ে গেছে। বিগত ২০১০ সালের ড্যাপে রাজউকের আওতাধীন ৩৭ লাখ ৭ হাজার ৫৭৭ একর জায়গার মধ্যে বন্যাপ্রবাহ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত ছিল ৭৪ হাজার ৫৭১ একর। তার ১০ বছর পর রাজউকের এক জরিপে দেখা যায়, ড্যাপ নির্ধারিত বন্যাপ্রবাহ এলাকায় ৭২ হাজার ১৮১টি ছোট-বড় স্থাপনা রয়েছে। যার ৯৯ দশমিক ৯৮ শতাংশই অবৈধ। আর ১৯৮৫ সালে মৎস্য বিভাগের তথ্যানুযায়ী ঢাকায় মোট পুকুর ছিল ২ হাজারের মতো। তবে রাজধানীর সীমানা বাড়লেও বর্তমানে মাত্র ২৪১টি পুকুর রয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন ২০০০-এ বলা হয়েছে, নদী, খাল-বিল, হাওর, দিঘি, ঝর্ণা, বন্যাপ্রবাহ এলাকা, বৃষ্টির পানি ধারণ করে এমন সব এলাকা প্রাকৃতিক জলাধার, জলাশয় বা জলাভূমি হিসেবে পরিগণিত হবে। গত বছরের ২২ অক্টোবর ব্যক্তি মালিকানাধীন পুকুরকেও প্রাকৃতিক জলাধারের সংজ্ঞাভুক্ত করে গেজেট প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টের স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে যে, জলাধার কোনোভাবেই ভরাট করা যাবে না। প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০ অনুযায়ী কোনো পুকুর, জলাশয়, নদী, খাল ইত্যাদি ভরাট করা বেআইনি। এই বিধান লঙ্ঘন করলে আইনের ৮ ও ১২ ধারা অনুযায়ী ৫ বছরের কারাদ বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদ অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে। একই সঙ্গে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (২০১০ সালে সংশোধিত) অনুযায়ী, যে কোনো ধরনের জলাশয় ভরাট করাও নিষিদ্ধ। কিন্তু আইন না মেনে চলছেই জলাভূমি ভরাট। শহর কিংবা গ্রাম সর্বত্রই একই চিত্র। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ হচ্ছে শিথিল এবং অনেক ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগই হচ্ছে না।
এদিকে পরিকল্পিত নগরায়ণের মাধ্যমে ঢাকাকে বাসযোগ্য করার লক্ষ্যে ২০১০ সালে ড্যাপ পাস করা হয়। এই সময়ে ড্যাপে দুই শতাধিক সংশোধনী আনা হলেও এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। মূলত ড্যাপ বাস্তবায়ন না হওয়ায় ঢাকার জলাধার রক্ষিত হচ্ছে না। বরং ড্যাপের কার্যকারিতা কাগজ-কলমেই রয়ে গেছে। শুধু ভবন তৈরির সময় ড্যাপ অনুযায়ী সংশ্নিষ্ট জমির ব্যবহার দেখা ছাড়া এর কোনো কার্যকারিতা দেখা যাচ্ছে না। তবে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) নগর পরিকল্পনাবিদ ও প্রক্রিয়াধীন ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম জানান, সমন্বিত পরিকল্পনার অভাবে আগের ড্যাপে কিছু অসঙ্গতি লক্ষ্য করা যায়। বর্তমানে সংশোধিত ড্যাপ (২০১৫-৩৫) প্রণয়নের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আগের ড্যাপে কৃষিজমি কিংবা জলাশয় সংরক্ষণে কোনো উদ্যোগ ছিল না। এবার টিডিআর পলিসির (ট্রান্সফার অব ডেভেলপমেন্ট রাইটস) প্রস্তাব করা হয়েছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানান, মাস্টারপ্ল্যান এবং আইন ভেঙে জলাশয় ভরাট হচ্ছে। সরকার আইনের যথাযথ প্রয়োগ করছে না। জলাশয় ভরাটের ব্যাপারে যার যেটা মনে চাচ্ছে তাই করছে। এমনি ড্যাপের আওতায় চিহ্নিত জলাশয়গুলো যারা ভরাট করেছে, তাদের শাস্তির মুখোমুখি করা হয়নি।
এ প্রসঙ্গে বিআইপির সাধারণ সম্পাদক নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মোহাম্মদ খান জানান, ড্যাপের পরিকল্পনায় জলাভূমির বিষয় সুস্পষ্ট করা আছে। আইনগুলোও সুস্পষ্ট। কোনটি জলাধার এবং তা কীভাবে রক্ষা করা যাবে- সবকিছু বলা আছে। এ ব্যাপারে কোনো ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু আইন কিংবা পরিকল্পনা থাকলেই হবে না, প্রয়োগ থাকতে হবে। আইন প্রয়োগের দুর্বলতার কারণেই জলাশয় দখল হচ্ছে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, পুলিশ, জেলা প্রশাসন, ওয়াসা কিংবা সিটি করপোরেশনসহ প্রতিটি আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ যদি ঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতো তাহলে জলাশয় রক্ষা করা যেতো। আইনের প্রয়োগ দুর্বল হওয়ার কারণ হচ্ছে- যারা জলাশয় ভরাট কিংবা দখল করছে তারা প্রভাবশালী মহল। কেউ কেউ রাজনৈতিক মদদপুষ্ট। ফলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে হাইকোর্টের রায়ের পরও জলাভূমিতে নির্মিত আবাসন উচ্ছেদ করা যায়নি। বরং নির্বিচারে অবকাঠামো উঠছে।

Leave a reply

Minimum length: 20 characters ::

More News...

দুর্ঘটনার আশঙ্কায় জনমনে উদ্বগে বীরগঞ্জের সড়কগুলো দাপিয়ে বড়োচ্ছে কিশোর চালকরা

সন্দ্বীপে কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনা উদ্বোধন