সুদেব কুমার সাহা : করোনার প্রাদুর্ভাবে দেশের হাজার হাজার কাঁকড়া খামার বন্ধ হয়ে গেছে। গত বছরের মার্চ বন্ধ হয়ে যায় চীনে কাঁকড়া রফতানি। পাশাপাশি দেশের বাজারে কমে যায় দাম। এমন অবস্থায় টানা লোকসানে বন্ধ হয়ে গেছে হাজার হাজার কাঁকড়া খামার। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে চলতি বছর আরো অনেক খামারিই কাঁকড়া চাষ বন্ধ করে দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যদিও বর্তমানে অনেক খামারি ব্যাংক ও এনজিও থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে কোনো রকম খামার বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু দেশের বাজারে দাম না পাওয়ায় তা বিক্রি করতে পারছে না। ফলে দিনের পর দিন বাড়ছে তাদের ঋণের বোঝা। যদিও মৎস্য বিভাগ বলছে, করোনা প্রাদুর্ভাবের পর ক্ষতিগ্রস্ত ১ হাজার ৬৩ জন কাঁকড়াচাষীকে সহায়তা দেবে সরকার। আর খামারিরা বলছেন, ক্ষতিগ্রস্ত খামারির তুলনায় সরকারের এ সহায়তা নিতান্তই অপ্রতুল। মৎস্য বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বাগেরহাটের বিভিন্ন উপজেলায় সরকারি হিসেবে প্রায় ১ হাজার ৮৫৯টি কাঁকড়া খামার রয়েছে। ওসব খামারের সঙ্গে যুক্ত চাষীর সংখ্যা ১ হাজার ৬৭০ জন। তবে বেসরকারি হিসেবে ওই জেলায় কাঁকড়া খামারের সংখ্যা প্রায় ৮ হাজার। বিগত ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২ হাজার ৬২৯ টন কাঁকড়া রফতানি করা হয়। কিন্তু করোনা প্রাদুর্ভাবের পর থেকেই ওই চিত্র বদলে যেতে থাকে। এখন খামারিদের টিকে থাকাই দায় হয়ে পড়েছে। কারণ রফতানি বন্ধ থাকায় খামারে চাষ করা অধিকাংশ কাঁকড়াই মরে যাচ্ছে। সেজন্য খামারিদের চরম লোকসানে পড়তে হচ্ছে।
সূত্র জানায়, কয়েক বছর ধরেই নানা প্রকার রোগবালাইয়ের কারণে চিংড়ি চাষে তেমন লাভ না হওয়ায় অনেক খামারিই কাঁকড়া চাষে ঝুঁকে পড়ে। তাতে লাভও ভালো হতে থাকে। কিন্তু ২০২০ সালের প্রথম দিকে করোনার থাবায় কাঁকড়া রফতানি বন্ধ হয়ে যায়। রফতানি বন্ধ ও দাম কমে যাওয়ায় সব খামারের কাঁকড়া সময়মতো বিক্রি করতে পারেনি। এক পর্যায়ে পুকুরেই কাঁকড়া মরে যায়। তবে করোনার প্রকোপ সামান্য কমতে থাকলে গত অক্টোবর-নভেম্বরের দিকে ধারদেনা করে আবারো অনেক খামারি চাষ শুরু করে। কিন্তু উৎপাদিত কাঁকড়া সরাসরি চীনে না যাওয়ায় অর্ধেক দামে বিক্রি করতে হয়েছে। ফলে কাঁকড়া বিক্রি করে খামারিদের উৎপাদন খরচও উঠছে না। আর বর্তমানে কাঁকড়া চাষ বন্ধ করেও খামারিরা স্বাভাবিক ঋণের দায়ে ঘরে থাকতে পারছে না। আর যারা লোকসান টেনেও কাঁকড়া চাষ চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের অবস্থাও তথৈবচ। এ অবস্থায় চীনে সরাসরি কাঁকড়া রফতানি চালু করতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও বিনা সুদে ঋণ দিয়ে এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখার দাবি জানিয়েছেন চাষীরা।
সূত্র আরো জানায়, রফতানিযোগ্য কাঁকড়া সাধারণত পাঁচটি গ্রেডে বিক্রয় হয়। বর্তমানে প্রত্যেক গ্রেডের দাম ৬শ থেকে ৭শ টাকা কেজিতে কমেছে। করোনা প্রাদুর্ভাবের আগে ২০০ গ্রাম (ফিমেল) ওজনের কাঁকড়ার কেজি ছিল ২ হাজার ২০০ টাকা, ওই কাঁকড়া বর্তমানে ৮০০ টাকা। ১৮০ গ্রাম ওজনের কাঁকড়া ছিল ১ হাজার টাকা, তা বর্তমানে ৬০০ টাকা। ১৫০ গ্রাম ওজনের কাঁকড়া ছিল ৮০০ টাকা, এখন তা ৪০০ টাকা। ১০০ গ্রাম ওজনের কাঁকড়া ছিল ৬০০ টাকা কিন্তু বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকায়। এমন দামে কাঁকড়া বিক্রি করে চাষীদের যেমন খরচ ওঠে না, তেমনি ব্যবসায়ীদেরও লোকসানে পড়তে হয়।
এদিকে এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কাঁকড়া সরবরাহ সমিতির সাধারণ সম্পাদক অজয় দাস জানান, সারা দেশে দুই লক্ষাধিক মানুষ কাঁকড়া চাষ ও ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িত। বাগেরহাটের চাষীদের উৎপাদিত বেশির ভাগ কাঁকড়া বেশি দামে চীনে রফতানি করা হতো। কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে রফতানি বন্ধ হওয়ায় ক্ষতির মুখে পড়েছেন চাষী ও ব্যবসায়ীরা। করোনাকালে বাগেরহাটের চাষীদের শত কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে প্রায় ৬ হাজার কাঁকড়া খামার। চীনে কাঁকড়া রফতানিসহ সরকারিভাবে সহযোগিতা না পেলে ওসব চাষী নিঃস্ব হয়ে যাবে।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. খালেদ কনক জানান, বাগেরহাটে উৎপাদিত কাঁকড়া চীন, জাপান, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, কোরিয়ায় রফতানি হতো। এর মধ্যে চীনেই রফতানি হয় ৮০ শতাংশ। চীনে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে কাঁকড়া রফতানি বন্ধ হয়ে যায়। তাতে চরম বিপাকে পড়েছে চাষীরা। সরকারও রাজস্ব হারাচ্ছে। এমন অবস্থায় চাষীদের ধৈর্যধারণের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। সরকারিভাবে বাগেরহাটের ১ হাজার ৬৩ জন খামারিকে প্রণোদোনা দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। বর্তমানে সরাসরি চীনে কাঁকড়া না গেলেও থাইল্যান্ড হয়ে চীনে কাঁকড়া রফতানি হওয়ায় চাষীরা দাম পাচ্ছে না। তাতে লোকসানের পরিমাণ আরো বাড়ছে।