নিজস্ব প্রতিবেদক ; নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থসংশ্লিষ্ট গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগ তুলে এর তদন্ত করতে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেছেন ৪২ জন নাগরিক। গত ১৪ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির কাছে এই চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে গতকাল শনিবার এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়। ৪২ জন নাগরিকের পক্ষে ওই চিঠি পাঠিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক, যিনি নিজে একসময় ইসির আইনজীবী ছিলেন। চিঠিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে রয়েছেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বিভিন্ন তত্ত্বাবধায়ক সরকারে উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করে আসা অবসরপ্রাপ্ত সচিব আকবর আলি খান, অবসরপ্রাপ্ত মহা হিসাব-নিরীক্ষক এম হাফিজউদ্দিন খান, মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল, শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী। চিঠিতে সাংবিধানিক এই সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে বাংলাদেশের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের অধীনে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল গঠনের আবেদন জানানো হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে শাহদীন মালিক বলেন, আমরা সবাই মনে করেছি দায়িত্ব গ্রহণ করার পর নির্বাচন কমিশন যেসব কার্যকলাপ করেছে, সেগুলো গুরুতর অসদাচরণ। সাংবিধানিক পদে যারা আছেন তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করার ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়ালের কাউন্সিলের। দুদক বা পুলিশ এটা করতে পারবে না। রাষ্ট্রপতি এ নির্দেশ দিতে পারেন। এই প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রপতিকে অভিযোগ জানিয়েছি। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে তদন্ত হওয়া উচিত। আমরা আশা করছি, গুরুতর অসদাচরণ দায়ে তারা দোষী হবেন। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের সুপারিশ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি তাদের পদ থেকে অপসারণ করবেন। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন যেভাবে আর্থিক অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছে, আগে কখনও দেখা য়ায়নি। আগের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। নির্বাচন কমিশনের নাম অবমাননা ও কলঙ্কিত করেছে। রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেছি, একইসাথে সরকার প্রধানের কাছে যাব। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছেও আবেদন করব। যতদিন সিদ্ধান্ত না হয়, ততদিন সিইসি ও কমিশনারা স্বেচ্ছায় দায়িত্ব ছেড়ে দিতে পারেন, কেউ কেউ স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করতে পারেন। আমরা তা আশা করব। শাহদীন মালিক বলেন, সংবিধানের ৪৮(৫) অনুচ্ছেদে বলা আছে, রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে মন্ত্রিপরিষদের আলোচনার জন্য উপস্থাপন করতে পারেন। চিঠিতে আর যারা সই করেছেন তারা হলেন- মানবাধিকারকর্মী হামিদা হোসেন, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম, মানবাধিকারকর্মী খুশি কবির, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির উপাচার্য পারভীন হাসান, সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আহমেদ কামাল, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না, শাহদীন মালিক, আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, অর্থনীতিবিদ আহসান মনসুর, সাবেক সচিব আবদুল লতিফ মন্ডল, স্থপতি মোবাশ্বের হাসান, অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম এণ্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, অধ্যাপক সি আর আবরার, আইনজীবী সারা হোসেন, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদ, লুবনা মরিয়ম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আকমল হোসেন, সোয়াস ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের অধ্যাপক স্বপন আদনান, ব্রতীর প্রধান নির্বাহী শারমিন মুরশিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফিরদৌস আজিম, সাবেক ব্যাংকার সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ, সাংবাদিক আবু সাঈদ খান, গোলাম মোর্তুজা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, অধ্যাপক শাহনাজ হুদা, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, ক্লিনিকাল নিউরোসাইন্স সেন্টার, বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনের পরিচালক অধ্যাপক নায়লা জামান খান, নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন, মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন। নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে আনা আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি এবং অর্থসংশ্লিষ্ট গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগগুলো হলো-
১. ‘বিশেষ বক্তা’ হিসেবে বক্তৃতা দেওয়ার নামে ২ কোটি টাকার মতো আর্থিক অসদাচরণ ও অনিয়ম।
২. নির্বাচন কমিশনের কর্মচারী নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ৪ কোটি ৮ লাখ টাকার অসদাচরণ ও অনিয়ম।
৩. নিয়মবহির্ভূতভাবে তিনজন কমিশনারের তিনটি গাড়ি ব্যবহারজনিত আর্থিক অসদাচরণ ও অনিয়ম।
অন্যান্য গুরুতর অসদাচারণ ও অনিয়মের মধ্যে রয়েছে-
১. ইভিএম কেনা ও ব্যবহারে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম।
২. একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম।
৩. ঢাকা (উত্তর ও দক্ষিণ) সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোতে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম।
৪. খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম।
৫ গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম,
৬. সিলেট, বরিশাল ও রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম।
সংবাদ সম্মেলনে শাহদীন মালিক বলেন, দেশে নির্বাচন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। নির্বাচন নির্বাচন খেলা হয়। রাষ্ট্রপতি দেশের অভিভাবক হিসেবে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য যেটা ভালো হয় করবেন। সেজন্য আমরা চিঠি দিয়েছি। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনারদের অপসারণ করবেন বলে যে আশা প্রকাশ করা হয়েছে, তা বাস্তবসম্মত কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, অতীতেও কিছু খারাপ নির্বাচন হয়েছে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন সম্ভবত সবচেয়ে খারাপ নির্বাচন। এখন যেগুলো হচ্ছে, সেগুলোও এরকম। এ ধরনের নির্বাচন কাম্য নয়। আমরা মনে করি গভীর সঙ্কট রয়েছে। গভীর সঙ্কটে পড়লে জাঁতি মহামান্য রাষ্ট্রপতির দিকে তাকিয়ে থাকে। তার একটি নৈতিক ক্ষমতা রয়েছে। আমরা নিঃসন্দেহে আশাবাদী। আমরা আশাবাদী রাষ্ট্রপতি এ অভিযোগের ইতিবাচক সাড়া দেবেন। আর্থিক অনিয়মের বিষয়ে তিন বছর পরে কেন এই অভিযোগ- জানতে চাইলে শাহদীন মালিক বলেন, আমাদের অভিযোগ অত্যন্ত গুরুতর অভিযোগ। এগুলো পর্যায়ক্রমে ঘটেছে। ২-৩টা অভিযোগ দিয়ে আমরা এটা করতে চাইনি। অপেক্ষা করেছিলাম, দেখেছি, পর্যবেক্ষণ করেছি। তাদের বিষয়ে অভিযোগ পত্রিকা থেকে সংগ্রহ করেছি। গুরুতর অসদারচরণ, দুর্নীতি যথেষ্ট হয়েছে। এখানে থাকার নৈতিক অবস্থান আর (তাদের) নেই। অভিযোগের পাল্লা অনেক ভারী হয়েছে। এই পর্যায়ে এসে… বেশ কয়েকমাস ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচন কমিশন মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তের প্রতি বিশ্বসঘাতকতা করেছে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তাদের এখন সরে দাঁড়ানোই ভালো হবে। রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করলেও তা নিয়ে কিছু হবে কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন সাবেক সচিব আবদুল লতিফ মণ্ডল, যিনি একসময় রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের সচিব ছিলেন। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি এটা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠাবেন বলে আশা করা যায়। কিন্তু পাঠাবেন কিনা সন্দেহ আছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আলাদা করে পাঠানো যেতে পারে। অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, জানি হয়ত আলটিমেটলি কিছু হবে না। কিন্তু তাগিদ দিলাম। সংবিধানে আছে। বিষয়টি ‘ফলোআপ’ করতে সাংবাদিকদের অনুরোধ জানান তিনি।