চট্টগ্রাম বন্দরে নিলামযোগ্য কনটেইনারে নষ্ট হচ্ছে বিপুল পরিমাণ পণ্য

চট্টগ্রাম বন্দরে নিলামযোগ্য কনটেইনারে নষ্ট হচ্ছে বিপুল পরিমাণ পণ্য

নিজস্ব প্রতিবেদক : চট্টগ্রাম বন্দরে বিভিন্ন ধরনের জটিলতায় প্রতিনিয়ত বাড়ছে নিলামযোগ্য কনটেইনারের সংখ্যা। ওসব কনটেইনারে বিগত ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের মে পর্যন্ত ৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকার পণ্য আটকা পড়ে রয়েছে। নিলামে তোলা হলে সরকার ওসব পণ্য থেকে ১ হাজার ২৯৪ কোটি টাকা রাজস্ব পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে বন্দরে কনটেইনার পড়ে থাকায় ভেতরের অনেক পণ্যই নষ্ট হয়ে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। যা বন্দরের পরিবেশ নষ্ট করার পাশাপাশি বন্দরে স্থান সংকট তৈরি করছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনারেট সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বর্তমানে নিলামযোগ্য কনটেইনারের মধ্যে খাদ্যদ্রব্য, প্লাস্টিক পণ্য, গাড়ি, রাসায়নিক পণ্য, খেলনাসামগ্রী, গ্লাস, ইলেকট্রনিক্স পণ্য, ফ্যাব্রিক্স, বিভিন্ন এক্সেসরিজ, রাবার পণ্য, পেপারস, ফার্নিচার এবং যন্ত্রাংশ রয়েছে। বন্দরে নিলামযোগ্য কনটেইনার জট বাড়ার জন্য ৬টি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর মূলত বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের সূতিকাগার। বর্তমানে ওই বন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আগের চেয়ে সন্তোষজনক। বন্দরকেন্দ্রিক জরিপ প্রতিষ্ঠান লয়েডস লিস্ট অনুযায়ী বিশ্বের ১০০ দ্রুততম বন্দরের তালিকায় চট্টগ্রামের অবস্থান ৫৮তম। কিন্তু এত অগ্রগতি সত্ত্বেও বন্দরে নিলামযোগ্য কনটেইনার নিয়ে জটিলতার কারণে তার সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বিগত ১৯৯১ সাল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ৯ হাজার নিলামযোগ্য কনটেইনার বন্দরে পড়ে রয়েছে। সেগুলোর বেশিরভাগই ব্যবহার অনুপযোগী ও ধ্বংসযোগ্য। ফলে সরকার শত শত কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। সূত্র জানায়, বিগত ১৯৯১ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত বন্দরে ছিল মাত্র ১২টি নিলামযোগ্য কনটেইনার। তারপর প্রতি বছরই ওই সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বিগত ২০০৫ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ২০০টি, ২০১০ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত ৯৬৮টি, ২০১৫ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ওই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৯৮৮টি। আর শুধুমাত্র চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত বন্দরে নিলামযোগ্য কনটেইনারের পড়ে আছে ৪৭৪টি। সব মিলিয়ে বন্দরে নিলামের অপেক্ষায় ৫ হাজার ৬৪২টি কনটেইনার পড়ে রয়েছে। মূলত ৬টি কারণে চট্টগ্রাম বন্দরে নিলামযোগ্য কনটেইনার বাড়ছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- আমদানিকারকরা কাস্টমস নির্ধারিত শুল্ক-কর পরিশোধ না করে নিলামের মাধ্যমে পণ্য খালাস করতে চায়, যা সময়সাপেক্ষ। এ কারণে পণ্যভর্তি কনটেইনার দীর্ঘদিন পড়ে থাকে। অনেক সময় আমদানিকৃত পণ্য কাস্টমসের ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করা হয়। আশানুরূপ ফল না পেলে আমদানিকারক বা সিএন্ডএফ এজেন্ট ওই পণ্য সায়েন্স ল্যাব, বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চুয়েটে পরীক্ষার জন্য চ্যালেঞ্জ করে থাকে। ওসব জায়গা থেকে পরীক্ষার ফলে পেতে অনেক সময় লাগে। আবার অসাধু সিএন্ডএফ এজেন্টরা আমদানিকারককে না জানিয়ে নিজেদের আর্থিক লাভের আশায় পণ্য খালাসে নানাবিধ সমস্যা সৃষ্টি করে থাকে। তার বাইরে বন্ড সুবিধার আড়ালে কিছু আমদানিকারক মিথ্যা ঘোষণায় মালামাল নিয়ে আসে। কাস্টমস খবর পেয়ে মালামাল কায়িক পরীক্ষা করে শুল্কসহ জরিমানা আরোপ করলে আমদানিকারক ওই মালামাল নিতে চায় না। আবার এইচএস কোড জটিলতার কারণেও দীর্ঘদিন পণ্য আটকে থাকে। আটক পণ্য নিলামের ক্ষেত্রে আমদানিকারকরা উচ্চ আদালয়ে রিট পিটিশন দাখিল করলে আদালতে নিষেধাজ্ঞার কারণে বন্দরে পণ্য বা কনটেইনার জট দীর্ঘতর হয়ে থাকে। সূত্র আরো জানায়, নিলামযোগ্য কনটেইনার দীর্ঘদিন পড়ে থাকায় বন্দর ইয়ার্ডের যথাযথ ব্যবহার করা যাচ্ছে না। তাতে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বন্দর। বন্দরের মূল জেটি, সিসিটি ও এনসিটিতে মোট ধারণক্ষমতা ৪৩ হাজার ১০৮ টিইউএস (২০ ফুট দৈর্ঘ্যরে কনটেইনার)। তার মধ্যে নিলামের কনটেইনারের সংখ্যা অক্টোবর পর্যন্ত ৯ হাজার টিইউএস, যা মোট ধারণক্ষমতার ২০ শতাংশ। সেগুলো ইয়ার্ডের জায়গা দখল করে রাখায় বন্দরে নতুন কনটেইনার গ্রহণ করা যাচ্ছে না। আর দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকার ফলে কনটেইনারের ভেতরের অনেক পণ্যই নষ্ট হয়ে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। তাছাড়া পড়ে থাকা কনটেইনার কাস্টমস ইনভেন্ট্রি চাইলে বিনা মাশুলে করতে হয়। আবার নিলামে পণ্য বিক্রি করা হলেও কাস্টমস বন্দরকে মাশুল (বিক্রীত অর্থের ২০ শতাংশ) হিসেবে প্রাপ্য দেয় না। ওসব কারণে নিলামে বন্দরের অনীহা দেখা যায়। এদিকে বন্দর থেকে পণ্য খালাস না হওয়ায় ব্যাংকের ওপর চাপ বাড়ছে। কারণ আমদানিকারকরা ব্যাংকে ১০ শতাংশ মূল্য পরিশোধ করেই পণ্যের এলসি করে থাকে। পণ্য ডেলিভারি নিতে না পারলে বা ডেলিভারি না নিলে বাকি ৯০ শতাংশ অর্থ রফতানিকারককে ব্যাংক পরিশোধ করতে বাধ্য হয়। এভাবে ব্যাংকের ওপর চাপ বাড়ে এবং ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া শিপিং এজেন্ট কনটেইনারে পণ্য বোঝাই থাকায় অন্য আমদানি-রফতানি কাজে ব্যবহার করতে পারে না। ওই কারণে বাংলাদেশে প্রতি বিদেশি কোম্পানিগুলোর নেতিবাচক ধারণা তৈরি হচ্ছে। বর্তমানে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে নিলাম কনটেইনার কাগজপত্র হস্তান্তর হয়। সাধারণ পণ্যের ক্ষেত্রে ৩০ দিন এবং পচনশীল পণ্যের ক্ষেত্রে ১০ দিন পার হওয়ার পর কাস্টমসের অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে কনটেইনার হ্যান্ডওভার সিস্টেম করা যেতে পারে। তাছাড়া বর্তমানে নিলাম প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতেও দীর্ঘসময় লাগছে। এ প্রক্রিয়া ১৫ দিনের মধ্যে সম্পন্ন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা গেলে ভালো হতো। এমন পরিস্থিতিতে বন্দর থেকে দ্রুত পণ্যভর্তি কনটেইনারের জট কমাতে পণ্য খালাসে আমদানিকারকদের সময় বেঁধে দিতে বলা হয়েছে। তাছাড়া কাস্টম হাউসের পরীক্ষাগার ও ল্যাবরেটরি আধুনিকায়ন, অসাধু সিএন্ডএফ এজেন্টদের লাইসেন্স বাতিল, আইন অনুসরণ করে বন্ডের পণ্য খালাস এবং কাস্টমসের নিলামের আইনের যথাযথ প্রয়োগের ওপরও জোর দেয়া হচ্ছে। সেজন্য প্রয়োজনে আইনের ধারা, উপ-ধারা সংশোধন করা যেতে পারে। আর নিলাম প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করতে বিভাগওয়ারী বা কাস্টমস হাউসে পদ সৃষ্টি করে প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সহায়তা দেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। নিলাম ডেস্কের কর্মকর্তারা শুধু নিলাম নিয়ে কাজ করবে। তাছাড়া কাস্টমসের অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমের আওতায় নিলাম প্রক্রিয়া অটোমেশন করতে হবে। সেজন্য বন্দরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা যেতে পারে। তার ফলে নিলাম আরো দ্রুত ও স্বচ্ছ হবে। অন্যদিকে এ বিষয়ে চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম জানান, এইচএস কোডগত (পণ্য পরিচিতি নম্বর) জটিলতা পণ্য নিলাম পর্যন্ত যাওয়ার মূল কারণ। অনেক সময় কাস্টমস কর্মকর্তারা পণ্য চিনতে না পেরে বা ইচ্ছাকৃতভাবে আমদানিকারকের ঘোষণা অনুযায়ী এইচএস কোডে শুল্কায়ন না করে ‘আদার্স’ এইচএস কোডে শুল্কায়ন করে। তখন মিথ্যা ঘোষণার জরিমানার পাশাপাশি পণ্যের উচ্চ শুল্ক দিতে হয়। বাজার মূল্যের চেয়ে পণ্যের কস্টিং বেশি পড়লে তখন আমদানিকারক মাল নিতে চায় না। ওই কারণে নিলামযোগ্য কনটেইনারের সংখ্যা বাড়ছে। তাছাড়া আরেকটি কারণ হচ্ছে শিপিং এজেন্টের বাড়তি চার্জ। শিপিং এজেন্টরা কারো কথা শুনতে ও মানতেও চায় না। লকডাউনের কারণে অনেক আমদানিকারক শুধু শিপিং এজেন্টের ডেমারেজ পোষাতে না পেরে মালামাল খালাস নেয়নি।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক জানান, কনটেইনার নিলাম করার দায়িত্ব কাস্টমস কর্তৃপক্ষের। প্রতি মাসে বন্দরে নিলামযোগ্য কনটেইনারের হিসাব কাস্টমসকে দেয়া হয়। তার বাইরে বন্দরের আর কোনো কাজ নেই। এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম কাস্টমসের কমিশনার ফখরুল আলম জানান, নিলামযোগ্য কনটেইনার নিষ্পত্তিতে কাস্টমস কাজ করছে। প্রতি শনিবার নিলাম শাখার কর্মকর্তা ছাড়াও অন্য শাখার কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ইনভেন্ট্রি করানো হচ্ছে। তারপর তা নিলামে তোলা হবে। নিলাম প্রক্রিয়া স্বচ্ছ রাখতে সম্প্রতি কাস্টমস ই-অকশন চালু করেছে। আশা করা যায় তার মাধ্যমে দ্রুততম সময়ে অকশন শেষ করা যাবে। তবে করোনার কারণে বাজারে পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ায় নিলামে অংশগ্রহণকারী হ্রাস পেয়েছে। যারা অংশ নিচ্ছেন তারাও কম দাম হাঁকছে। যা বড় একটি সমস্যা।

Leave a reply

Minimum length: 20 characters ::

More News...

দুর্ঘটনার আশঙ্কায় জনমনে উদ্বগে বীরগঞ্জের সড়কগুলো দাপিয়ে বড়োচ্ছে কিশোর চালকরা

সন্দ্বীপে কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনা উদ্বোধন