নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের চালকল মালিকরা সরকারের নির্দেশনার কোনো তোয়াক্কাই করে না। তাদের কারসাজিতে বাজারে নতুন ধান উঠলেও চালের দাম বেড়ে চলেছে। বর্তমানে আমন মৌসুমের নতুন ধান বাজারে উঠেছে। বাড়ছে চালের সরবরাহও। কিন্তু তারপরেও গত কয়েকদিনে খুচরা বাজারে মাঝারি ও সরু চালের দাম কেজিতে ২ থেকে ৫ টাকা বেড়েছে। সরকার নির্ধারিত চালের দাম মিল থেকে খুচরা পর্যন্ত কোনো পর্যায়েই ব্যবসায়ীরা মানছে না। বরং দামের দাম বেড়ে যাওয়ায় চালের দাম বাড়ছে বলে অৎুহাত দেখানো হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার চাল আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয় এবং চাল বাজার সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বাজারে এখন আমন মৌসুমের ধান বেচাকেনা হচ্ছে। সরকারও ২৬ টাকা কেজিতে অন্য বছরের মতো ধান কেনা শুরু করেছে। সরকার নির্ধারিত ওই দর অনুযায়ী প্রতি মণের দাম ১ হাজার ৪০ টাকা। কিন্তু বগুড়া, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁওসহ বিভিন্ন অঞ্চলের বাজারগুলোতে এখন প্রতি মণ আমন ধান ৯০০ থেকে ১ হাজার ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বর্তমানে যে দামে ধান বেচাকেনা হচ্ছে কৃষকরাও তা যৌক্তিক বলে মনে করছে। আর কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মতে, পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি সরু চাল মিনিকেট ৫০ থেকে ৫৩ টাকা, মাঝারি চাল ৪৬ থেকে ৪৭ টাকা ও মোটা ৪০ থেকে ৪২ টাকা যৌক্তিক মূল্য। আর খুচরায় প্রতি কেজি মিনিকেট ৫৩ থেকে ৫৬ টাকা, মাঝারি ৪৯ থেকে ৫০ টাকা ও মোটা ৪২ থেকে ৪৫ টাকায় বিক্রি হতে পারে। কিন্তু মিল মালিকরা নির্ধারিত দরে কিংবা যৌক্তিক দর কিছুই মানছে না। রাজধানীর চালের বাজারে মিল মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে বলে পাইকারি ব্যবসায়ীদের দাবি। তাদের মতে, এখন বাজারে আসা এই চালের ধান অনেক আগেই কেনা। এই চালের দাম বৃদ্ধির যৌক্তিকতা নেই। বরং এখন পর্যাপ্ত নতুন ধান-চাল বাজারে আসা শুরু হওয়ায় দাম কমার কথা। কিন্তু অসাধু চক্র কারসাজি করে চালের দাম বাড়িয়ে চলেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) ও কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্যেও খুচরা বাজারে চালের দর বৃদ্ধির বিষয়টি এসেছে।
সূত্র জানায়, বর্তমানে মিনিকেট চাল আগে কেনা বোরো ধানে উৎপাদন হচ্ছে। ওই চাল সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি হওয়া উচিত। পাশাপাশি বাজারে আমন চালের সরবরাহ বাড়ছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই চালের দাম কমার কথা। কিন্তু বাস্তবে ঘটছে উল্টো। কয়েকদিন ধরেই মিলে চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে মালিকরা। মিলগেটে প্রতি বস্তা চালে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা দাম বেড়েছে। আর ওই চাল বাজারে এলে দাম আরো বাড়বে। মিলগেটে সরকার নির্ধারিত দর মিনিকেট ২ হাজার ৫৭৫ টাকা ও মাঝারি চাল ২ হাজার ১৫০ থেকে ২ হাজার ২৫০ টাকা। কিন্তু ওই দর মিল মালিকরা মানছে না। ফলে পাইকারি ও খুচরা বাজারে নির্ধারিত দামে চাল বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না।
সূত্র আরো জানায়, বর্তমান সময়ে দেশে চালের দাম বাড়ার কথা নয়। যদিও মিলগুলো ধানের দাম বেশি বলে দাবি করছে। সরকার হিসাব করে চালের দাম ঠিক করে দিয়েছে। ফলে এখন চালের দাম বাড়ার যৌক্তিকতা নেই। তবে গত বছরের চেয়ে এবার সরকারের গুদামে চাল মজুদ কম থাকার কারণে বাজার নিয়ন্ত্রণ দুরূহ হয়ে পড়ছে। মিলাররা এর সুযোগ নিচ্ছে। বর্তমানে চালের বাজার কয়েকজন মিল মালিকের ওপর নির্ভর করছে। যখন সরকারের বাজার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা দুর্বল হয়, তখনই তারা দাম বাড়িয়ে দেয়। তবে সরকার চাল আমদানি প্রক্রিয়া শুরু করেছে। একই সাথে ভোক্তারা যাতে কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এবং যেসব মিল মালিক দিনের পর দিন সুযোগ নিয়ে বাজার অস্থির করছে তাদের আইনের আওতায় এনে ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। চালের বাজার কারসাজিকারী অসাধু মিল মালিকদের বার বার তালিকা হলেও অদৃশ্য কারণে তারা পার পেয়ে যায়। এমন হলে বাজার নিয়ন্ত্রণ সত্যিই কঠিন হবে।
এদিকে চালের দাম বাড়া প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলী জানান, বর্তমানে নিয়ন্ত্রণের বাইরে ধানের দাম। মৌসুমে ধানের দাম বাড়ছে। যে কারণে মৌসুমে চালের দামও বাড়ছে। ধানের দামের ওপর সব সময় চালের দাম নির্ভর করে। ধানের দাম কমে এলে চালের দামও কমবে। বর্তমানে সরকার নির্ধারিত দামে কোনো মিলের পক্ষে চাল বিক্রি সম্ভব নয়। বাড়তি দামে ধান কিনে কম দামে চাল বিক্রির সুযোগ নেই।
অন্যদিকে সরকার খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার করার লক্ষ্যে দীর্ঘ ৩ বছর পর ৫০ হাজার টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রতিকেজি চাল আমদানিতে খরচ হবে ৩৫ দশমিক ২৭ টাকা। সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি চাল আমদানির প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। কারণ খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী দেশে রেকর্ড পরিমাণ খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরও গত এক বছরে খাদ্য মজুদ কমে গেছে। বোরো মৌসুমে ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হওয়া এবং চলমান মহামারী ও মহামারীর মধ্যে কয়েক দফা বন্যার কারণে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। গত বছর ১ জুলাই সরকারের হাতে খাদ্য মজুদ ছিল ১৬ দশমিক ৭৪ লাখ টন। এক বছরে তা কমে ১১ দশমিক ৮৮ লাখ টনে দাঁড়িয়েছে। যে কারণে চাল আমদানি করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক কোটেশনের মাধ্যমে ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫০ হাজার টন নন-বাসমতি সিদ্ধ চাল ক্রয় প্রস্তাবে সায় দেয়া হয়েছে। আমদানি করা চালের প্রতি টনের ক্রয়মূল্যে দাঁড়াবে ৪১৬ মার্কিন ডলার। ভারত থেকে ওই চাল আসবে।
এ প্রসঙ্গে খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সারোয়ার মাহমুদ জানান, বাজারে এখন মিনিকেটের বোরো ধানের সরবরাহ তেমন নেই। তবে তা মিল পর্যায়ে রয়েছে। এখন মৌসুমের অন্যান্য ধান ও চাল বাজারে উঠছে। বাজারে পর্যাপ্ত চালের সরবরাহ রয়েছে। এ অবস্থায় চালের দাম বৃদ্ধির যৌক্তিকতা নেই। বাজারে ধানের দাম যৌক্তিক পর্যায়ে আছে। তারপরেও ধান-চালের দাম বাড়ালে সরকার বিকল্প উৎস থেকে সংগ্রহ করে বাজারে সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে। খোলা বাজারে চাল বিক্রি ও খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি চলছে। দাম বেশি বাড়লে সাধারণ মানুষের জন্য এ সুবিধা বাড়ানো হবে।