সুন্দরবনের দুবলার চর থেকে: ঢাকের বাদ্য, মুহুর্মুহু উলুধ্বনি, ধূপ আর পূজার নৈবেদ্যতে চলছে এবারের রাসপূজা। করোনার কারণে এবার রাসপূজাকে কেন্দ্র করে বসেনি মেলা।
ঐতিহ্যের রাস উৎসব ঘিরে নেই তেমন লোক সমাগমও। করোনাকালে উৎসবের অন্য অনুষঙ্গ ছাড়া শুধুই প্রথা মেনে চলছে রাসপূজা। রাস ময়দানে বসেনি তেমন কোনো দোকান।
রাস পূজায় বাদ্য, নৃত্য, গীত ও বিবিধ প্রকার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকলেও পসার সাজিয়ে বসেনি কুটির শিল্পের দোকান। মিষ্টান্ন ও কয়েকটি খাবারের দোকান ছাড়া চোখে পড়ছে না কিছু।
সুন্দরবনের পাশে ছোট্ট একটি দ্বীপ দুবলার চর। প্রায় দুইশত বছর ধরে বঙ্গোপসাগরের বুকে কুঙ্গা এবং মরা পশুর নদীর মোহনায় জেগে ওঠা এ চরে চলে আসছে রাসমেলা।
গেলো বছর ২০১৯ সালে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের কারণে রাসপূজা ও পূণ্যস্নান উপলক্ষে কোনো মেলা হয়নি। এবারও করোনা পরিস্থিতিতে রাস পূজায় কোনো মেলা হচ্ছে না। তবে বন বিভাগের নির্ধারিত বিভিন্ন শর্ত মেনে শুধু সনাতন ধর্মাবলম্বীরা রাস পূর্ণিমার পূজা ও পূণ্যস্নানে অংশগ্রহণ করতে পারছেন। ২৯ নভেম্বর সন্ধ্যায় সুন্দরবনের দুবলার চরে রাসপূজা ও ৩০ নভেম্বর সকালে দুবলার চর সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে পূণ্যস্নানের মাধ্যমে এবারের রাস উৎসব শেষ হবে।
শর্তগুলো হচ্ছে, সুন্দরবনে প্রবেশ থেকে শুরু করে সার্বক্ষনিক মাস্ক ব্যবহার করতে হবে ভক্তদের। রাসপূজাগামী সব জলযানে এবং পূজাস্থলে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী (হ্যান্ড স্যানিটাইজার, হ্যান্ডওয়াশ) রাখা হয়েছে। রাস মেলায় প্রবেশের জন্য পাঁচটি রুট নির্ধারণ করে বনবিভাগ। রুটগুলো হচ্ছে, বুড়িগোয়ালিনি, কোবাদক থেকে বাটুলা নদী-বল নদী-পাটকোষ্টা খাল হয়ে হংসরাজ নদী অতঃপর দুবলার চর। কয়রা, কাশিয়াবাদ, খাসিটানা, বজবজা হয়ে আড়ুয়া, শিবসা নদী মরজাত হয়ে দুবলার চর।এবারের রাস পূজায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে বনরক্ষীদের পাশাপাশি র্যা ব-৬ খুলনা, কোস্টগার্ড পশ্চিম জোন মোংলা, বাংলাদেশ নৌবাহিনী, বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া বাগেরহাট জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটও নিয়োজিত রয়েছেন।
আগে দূর-দূরান্ত থেকে রাস মেলা উপলক্ষে পর্যটকরা আসতেন। এমনকী ভারতসহ আশপাশের বেশকিছু দেশ থেকেও পর্যটকরা আসতেন। এবার মেলা না হওয়ায় ও বন বিভাগের নিষেধাজ্ঞার কারণে কোনো পর্যটক আসেননি। সাজসজ্জাও নেই তেমন।
স্থানীয় বাসিন্দা মহিতোষ বিশ্বাস বলেন, প্রতি বছরই আসি রাস মেলায়। আগে অনেক মানুষ হতো। এবছর তেমন মানুষ নেই। তাই তেমন একটা জমে ওঠেনি। শুধু রাসপূজাটাই হচ্ছে মেলা আর হচ্ছে না।খুলনার বটিয়াঘাটা থেকে আসা কবিতা রাণী বলেন, আগে কখনও আসিনি। এবার এসেছি পরিবার নিয়ে পূণ্যস্নান করে সব পাপ ধুয়ে ফেলতে।রাস উৎসব উদযাপন কমিটির সভাপতি এসএম কামাল হোসেন বলেন, রোববার বিকেল ৫টায় পূজার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে রাস উৎসব। সোমবার ভোর ৬টায় পূণ্যস্নানের মধ্য দিয়ে শেষ হবে রাস পূজা। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে পূজার আনুষ্ঠানিকতা পালন করছেন। এখানে যারা স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী নিয়ে আসেননি তাদের দেওয়া হচ্ছে।
বনকর্মকর্তা মোকাম্মেল বলেন, করোনা ভাইরাসের কারণে সরকার এবার রাসমেলা করতে না দেওয়ায় শুধু রাস উৎসব হচ্ছে। যে কারণে শুরু সনাতন ধর্মাবলম্বীরা আসতে পেরেছেন। আগে ৫০ হাজারের বেশি হতো এবার প্রায় ১০ হাজারের মতো লোক এসেছে।
প্রতি বছর কার্তিক মাসে (খ্রিস্টীয় নভেম্বর) হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের রাসমেলা এবং পূণ্যস্নানের জন্য দুবলার চর বিখ্যাত। যদিও বলা হয়, ২০০ বছর ধরে এ রাসমেলা হয়ে চলেছে। তবে জানা যায়, ১৯২৩ সালে হরিচাঁদ ঠাকুরের এক বনবাসী ভক্ত, নাম হরিভজন (১৮২৯-১৯২৩), এই মেলা চালু করেন। প্রতিবছর অসংখ্য পুণ্যার্থী রাসপূর্ণিমাকে উপলক্ষ করে এখানে সমুদ্রস্নান করতে আসেন। দুবলার চরে সূর্যোদয় দেখে ভক্তরা সমুদ্রের পানিতে ফল ভাসিয়ে দেন। কেউবা আবার বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে ভজন-কীর্তন গেয়ে মুখরিত করেন চারপাশ।
আবার কারো কারো মতে, শারদীয় দুর্গোৎসবের পর পূর্ণিমার রাতে বৃন্দাবনবাসী গোপীদের সঙ্গে রাসনৃত্যে মেতেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। এ উপলক্ষেই দুবলায় পালিত হয়ে আসছে রাস উৎসব।