নিজস্ব প্রতিবেদক : করোনা ভাইরাসের মহামারি অনিয়ন্ত্রিতভাবে দ্বিতীয় বছরের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে প্রকাশিত নতুন একটি প্রতিবেদনে ইউনিসেফ শিশুদের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ও ক্রমবর্ধমান পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকার ইউনিসেফ অফিস জানায়, বিশ্ব শিশু দিবস সামনে রেখে প্রকাশিত ‘অ্যাভারটিং এ লস্ট কোভিড জেনারেশন’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি ইউনিসেফের প্রথম প্রতিবেদন, যেখানে মহামারি অব্যাহত থাকায় শিশুদের ক্ষেত্রে এর ভয়াবহ ও ক্রমবর্ধমান পরিণতি সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। এতে উঠে এসেছে যে, আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে হালকা উপসর্গ দেখা গেলেও সংক্রমণের হার বাড়ছে এবং দীর্ঘমেয়াদে শিশু ও তরুণদের পুরো একটি প্রজন্মের শিক্ষা, পুষ্টি ও সামগ্রিক কল্যাণের ওপর এর প্রভাব জীবন বদলে দিতে পারে। ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক হেনরিয়েটা ফোর বলেছেন, কোভিড-১৯ মহামারির এ পুরো সময়জুড়ে অব্যাহতভাবে একটি ধারণা চলে আসছে যে, এ রোগে শিশুদের তেমন ক্ষতি হয় না। তবে এটি মোটেও সত্য নয়। শিশুরা এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে এবং এ রোগের বিস্তার ঘটাতে পারে, আর এটি মহামারিজনিত সমস্যার ছোট একটি অংশ। গুরুত্বপূর্ণ সেবা পেতে বিঘ্ন এবং দারিদ্র্যের হার বাড়া শিশুদের ক্ষেত্রে এর চেয়েও বড় হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। এ সংকট যত দীর্ঘ হবে, শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি এবং সামগ্রিক কল্যাণের ওপর এর প্রভাব তত গভীর হবে। পুরো একটি প্রজন্মের ভবিষ্যত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ৩ নভেম্বর পর্যন্ত ৮৭টি দেশের বয়সভিত্তিক তথ্য অনুযায়ী, কোভিড-১৯ এ সংক্রমিত প্রতি ৯ জনের মধ্যে একজন ২০ বছরের কম বয়সী শিশু ও কিশোর-কিশোরী, যা এ দেশগুলোতে মোট আক্রান্ত ২ কোটি ৫৭ লাখ মানুষের ১১ শতাংশ। এ সংকট কীভাবে সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে থাকা শিশুদের জীবনকে প্রভাবিত করে এবং এটি মোকাবিলার উপায় কী, তা আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য সংক্রমণ, মৃত্যু ও শনাক্তকরণ পরীক্ষার আরও নির্ভরযোগ্য বয়সভিত্তিক তথ্য প্রয়োজন। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, যেহেতু শিশুরা একে অন্যের মধ্যে ভাইরাস ছড়িয়ে দিতে পারে এবং বয়স্ক মানুষের মধ্যেও, এ ক্ষেত্রে জোরালো প্রমাণ রয়েছে যে, প্রাথমিক সুরক্ষা ব্যবস্থা কার্যকর থাকলে স্কুল বন্ধ রাখলে যে ক্ষতি হয়, তার চেয়ে বরং বেশি সুবিধা পাওয়া যায় স্কুল খোলা রাখলে। কমিউনিটিতে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে স্কুলগুলোই একমাত্র চালিকাশক্তি নয় এবং শিশুরা বেশিভাগ ক্ষেত্রে স্কুলের বাইরে থেকেই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি টোমো হোযুমি বলেন, মহামারির ব্যাপকতায় বিশ্বের ১৯২টি দেশ স্কুল বন্ধ করে দেয়। ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৭৩ শতাংশ দেশ সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে স্কুলগুলো পুনরায় চালু করে। একটি নির্ধারিত তারিখ লক্ষ্য করে নিরাপদে স্কুলগুলো পুনরায় চালু করার জন্য পরিচালনাগত পরিকল্পনার প্রক্রিয়া শুরু করা জরুরি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিশুদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য ও সামাজিক সেবা পেতে কোভিডজনিত বাধা শিশুদের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। ১৪০টি দেশজুড়ে ইউনিসেফ পরিচালিত জরিপের তথ্য ব্যবহার করে এটি বলা হয়েছে। যেসব দেশের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে, সেগুলোর প্রায় এক-তৃতীয়াংশে নিয়মিত টিকাদান, হাসপাতালে বহির্বিভাগে শৈশবকালীন সংক্রামক রোগের চিকিৎসা এবং মাতৃস্বাস্থ্য সেবার মতো স্বাস্থ্যসেবাগুলো অন্তত ১০ শতাংশ কমে গেছে। এর বড় কারণ সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা। ১৩৫টি দেশে নারী ও শিশুদের পুষ্টি সেবার আওতা ৪০ শতাংশ কমে গেছে। ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ২৬ কোটি ৫০ লাখ শিশু স্কুলের খাবার বঞ্চিত ছিল। ৫ বছরের কম বয়সী ২৫ কোটির বেশি শিশু ভিটামিন ‘এ’ সাপ্লিমেন্ট কর্মসূচির জীবনরক্ষামূলক সুবিধা নেওয়া থেকে বাদ পড়তে পারে। ৬৫টি দেশ জানিয়েছে, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় সমাজকর্মীদের বাড়ি পরিদর্শন কমেছে। প্রতিবেদনে আরও যেসব আশঙ্কাজনক তথ্য উঠে এসেছে তার মধ্যে রয়েছে-
১. ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ৩০টি দেশজুড়ে স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ৫৭ কোটি ২০ লাখ শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী স্কুলে যাওয়া শিক্ষার্থীদের ৩৩ শতাংশ।
২. আগামী ১২ মাসে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হওয়ায় এবং ক্রমবর্ধমান অপুষ্টির সমস্যাসহ আনুমানিক ২০ লাখ অতিরিক্ত শিশুর মৃত্যু হতে পারে এবং ২ লাখ অতিরিক্ত মৃত শিশুর জন্ম হতে পারে।
৩. ২০২০ সালে পাঁচ বছরের কম বয়সী অতিরিক্ত ৬০ থেকে ৭০ লাখ শিশু উচ্চতার তুলনায় পাতলা বা ওজন কম বা তীব্র অপুষ্টিজনিত সমস্যায় ভুগবে, যা ১৪ শতাংশ বেশি এবং এ কারণে প্রতি মাসে অতিরিক্ত ১০ হাজারের বেশি শিশুর মৃত্যু হবে, যার বেশিভাগই ঘটবে সাব-সাহারান আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ায়।
৪. বিশ্বব্যাপী, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসন, পুষ্টি, স্যানিটেশন বা খাবার পানি পাওয়ার সুবিধা ছাড়াই বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাসরত শিশুর সংখ্যা ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত প্রায় ১৫ শতাংশ বা অতিরিক্ত ১৫ কোটি বাড়বে।
এ সংকট মোকাবিলায় ইউনিসেফ সরকার ও অংশীদারদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে:
১. ডিজিটাল বিভাজন বন্ধ করাসহ সব শিশুর জন্য শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করার।
২. পুষ্টি ও স্বাস্থ্যসেবাগুলো পাওয়ার নিশ্চয়তা দিতে এবং প্রতিটি শিশুর জন্য টিকা সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য করতে।
৩. শিশু ও তরুণ জনগোষ্ঠীকে মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা ও সুরক্ষা দিতে এবং শৈশবকালে নির্যাতন, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা ও অবহেলার অবসান ঘটানোর।
৪. নিরাপদ খাবার পানি, স্যানিটেশন ও পরিচ্ছন্নতা সেবা পাওয়ার সুযোগ বাড়ানোর এবং পরিবেশগত বিপর্যয় ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করার।
৫. শিশু দারিদ্র্যের উত্থান উল্টে দিতে এবং সবার জন্য অংশগ্রহণমূলক ঘুরে দাঁড়ানোর বিষয়টি নিশ্চিত করার।
৬. সংঘাত, দুর্যোগ ও বাস্তুচ্যুতির মধ্যে বসবাস করা শিশু ও তাদের পরিবারকে সুরক্ষা ও সহায়তা করার প্রচেষ্টা দ্বিগুণ করার।