তিন মাস ধরে পানিতেই বসবাস। উঠানে, ঘরে পানি। রান্নাঘর, ল্যাট্রিন, গোয়ালঘর- সবখানেই পানি। মসজিদ, মন্দির, গোরস্তান, শ্মশান সব পানিতে টইটম্বুর। করোনার কারণে বন্ধ থাকা স্কুল-কলেজেও উঠেছে পানি। এলাকার মানুষের কাজকর্ম নেই, বন্ধ আয়-রোজগার। এখানকার ৯৫ ভাগ মানুষের একমাত্র পেশা কৃষিকাজ। তাদের সেই কৃষিজমিও তিন মাস ধরে পানির নিচে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে তাদের। গতকাল মনিরামপুর উপজেলার মশিয়াহাটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে জমে থাকা কোমরপানিতে দাঁড়িয়ে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন ভবদহ এলাকার শত শত নারী-পুরুষ।
ব্যতিক্রমী এ মানববন্ধনে অংশ নেওয়া কুলটিয়া গ্রামের অনিমা ধর বলেন, ‘বাড়িঘর, চাষের খেত সব জলের নিচে। ল্যাট্রিন, রান্নাঘরে যাওয়া যায় না। শোয়ার ঘরে গরু-ছাগল রাখতে হচ্ছে। নিজেদের খাবার জোটে না। কেনা খাবার দিয়ে গরু-ছাগল পোষা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। কম দামে বেঁচে দিতে হচ্ছে।’ একই গ্রামের দেবী রানী বলেন, ‘আমার বয়স আজ ৫১ বছর। জলাবদ্ধতা সমস্যা সমাধানের জন্য বছরের পর বছর আমরা রাস্তায় দাঁড়াচ্ছি। কোনো সমাধান হচ্ছে না। আমাদের দুর্দশা কাটছে না। আমাদের মা শেখ হাসিনা ক্ষমতায়। তিনি কি দেখছেন না তার সন্তানেরা কী দুর্দশায় দিন কাটাচ্ছে? আমাদের সমস্যার কেন সমাধান হচ্ছে না?’ হাটাগাছা গ্রামের অনিতা বৈরাগী বলেন, ‘কত কষ্টে দিন কাটাচ্ছি তা বলে বোঝাতে পারব না। গত বছর কিছুটা ফসল হয়েছিল। এবার কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। এবার ফসল করতে না পারলে পথে বসতে হবে। বদ্ধ পানি পচে গন্ধ সৃষ্টি হচ্ছে। সেই পানিতে বাধ্য হয়েই নামতে হচ্ছে সবাইকে। এলাকার মানুষ চর্মরোগসহ বিভিন্ন ধরনের পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।’ কুলটিয়া গ্রামের সবিতা বিশ্বাস বলেন, ‘মানববন্ধনের দিকে একটু তাকিয়ে দেখেন। কতটা কষ্টে পড়লে দূরদূরান্ত থেকে বাড়ির গৃহবধূরা এই মাজাপানিতে এসে মানববন্ধনে অংশ নেয়। সবার আশা, আমাদের দিকে যেন আমাদের মায়ের একটু নজর পড়ে।’ ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির উদ্যোগে বেলা ১১টা থেকে ১২টা পর্যন্ত এ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। সংগ্রাম কমিটির প্রধান উপদেষ্টা ইকবাল কবীর জাহিদ বলেন, ভবদহ এলাকার জলাবদ্ধতা সমস্যা চলছে ৬০ বছর ধরে। জলাবদ্ধতা নিরসনের নামে বারবার নদী খনন করার প্রকল্প নিয়ে জনপ্রতিনিধি ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা লুটপাট করে চলেছেন। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। বারবার নদী খনন করে এর সমাধানও হবে না। উজান থেকে পানির প্রবাহ নেই। ভাটি থেকে পলিযুক্ত পানি এসে নদী ভরাট হয়ে যায়। নদী খনন করার কয়েক দিনের মধ্যেই আবার পলি জমে তা পাশের বিলের চেয়ে উঁচু হয়ে যায়। তিনি বলেন, ভবদহ অঞ্চলের জলাবদ্ধতা সমস্যার পরীক্ষিত সমাধান হলো টিআরএম বা জোয়ারাধার। মাত্র একটি বিলে টিআরএম করায় চার-পাঁচ বছর ভবদহ এলাকা ভালো ছিল। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে সেই প্রকল্প বাতিল করা হয়েছে। লুটপাটের জন্য আবারও শত শত কোটি টাকার নদী খনন প্রকল্প গ্রহণ করার চেষ্টা করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। তিনি বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওপর মানুষের এখন আর কোনো আস্থা নেই। টিআরএম অবশ্যই করতে হবে এবং তা করতে হবে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে। সংগ্রাম কমিটির সদস্য সচিব চৈতন্য পাল বলেন, ভবদহ এলাকার কয়েক লাখ মানুষকে বাঁচাতে হলে অবিলম্বে টিআরএম চালু, আমডাঙ্গা খান প্রশস্ত ও সংস্কার, হরি, শ্রী, টেকা ও মুক্তেশ্বরী নদীর সঙ্গে ভৈরব নদীর সংযোগ, ২১ ও ৯ ভেন্টের মাঝ দিয়ে সরাসরি নদী সংযোগ, নদী ও খালের ওপর থাকা সব ধরনের পাটা ও বাঁধ অপসারণ করতে হবে। মানববন্ধনে সংগ্রাম কমিটির প্রধান উপদেষ্টা ও সদস্য সচিব ছাড়াও আহ্বায়ক রণজিৎ বাওয়ালী, মুক্তিযোদ্ধা গাজী আবদুল হামিদ, মফিজুর রহমান নান্নু, প্রদীপ হালদার, কার্তিক বকশী, অনিল বিশ্বাসসহ কয়েকশ নারী-পুরুষ অংশ নেন।