ঢাকা: নরসিংদীর বেলাবো থানায় সোহরাব হোসেন ওরফে মুসা হত্যাকাণ্ডের ঘটনার তিন বছর পর মূল আসামি কবির মিয়াকে (৪০) গ্রেফতার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। নিহত সোহরাব নরসিংদীর বেলাবো থানার ইউপি সদস্য রিনা বেগমের ছেলে।
হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর আসামি কবির মিয়া পালিয়ে যান। নিজের নাম-পরিচয় বদলে গাজীপুরে ট্রাক চালক হিসেবে কাজ শুরু করেন। শ্যামল নামে তিন বছর আত্মগোপনে থাকা হত্যাকারী কবির সিআইডির হাতে ধরা পড়েন। গ্রেফতারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি স্বীকার করেন এই ঘাতক।
শনিবার (০৩ অক্টোবর) দুপুরে রাজধানীর মালিবাগে সিআইডির কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তদন্তকারী সংস্থার ঢাকা বিভাগের ডিআইজি মো. মাঈনুল হাসান এসব তথ্য জানিয়েছেন।
২০১৭ সালের পারিবারিক ও সামাজিক বিরোধের জেরে সোহরাবকে বাসা থেকে ডেকে এলাকার কুকুরমারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে পেঁপে বাগানে নিয়ে সোহরাবকে গলা কেটে হত্যা করেন কবির, শফিক, মিলন, তুহিন, শিপন, মুসাসহ কয়েকজন। এই ঘটনার পর নিহতের মা রিনা বেগম বাদী হয়ে নরসিংদীর বেলাবো থানায় ১১ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন।
ডিআইজি মাঈনুল হাসান বলেন, হত্যাকাণ্ডের পর থানা পুলিশ এবং পরবর্তী সময়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) নরসিংদী জেলা টিম তদন্ত শুরু করে। পিবিআই পলাতক আসামি কবিরসহ ৩ জন এবং এজাহারের বাইরে ২ জনসহ ঘটনার সঙ্গে জড়িত মোট ৫ আসামির বিরুদ্ধে আদালতে একটি অভিযোগপত্র জমা দেয়। তবে ওই অভিযোগপত্রে হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী আসামি কবির মিয়ার নাম থাকলেও তিনি পলাতক ছিলেন। এতে মামলার বাদী রিনা বেগম আদালতে নারাজি দিলে এ বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি মামলাটির তদন্তভার সিআইডিকে ন্যাস্ত করেন আদালত।
তদন্তের এক পর্যায়ে শুক্রবার (০২ অক্টোবর) গাজীপুরের শ্রীপুর থানাধীন মাওনা বহেরারচালা এলাকা থেকে ওই হত্যাকাণ্ডের মূল আসামি কবির মিয়াকে গ্রেফতার করে সিআইডির ঢাকা মেট্রোর একটি টিম। আসামির আসল নাম কবির মিয়া হলেও গাজীপুরে তিনি শ্যামল নামে ট্রাক চালকের কাজ শুরু করেন। তিন বছর যাবত তিনি শ্যামল নাম ব্যবহার করে আত্মগোপন করে ছিলেন।
ডিআইজি মাঈনুল আরও বলেন, পারিবারিক ও সামাজিক দ্বন্দ্বের জেরে কবির মিয়া এই হত্যাকাণ্ডটি পরিকল্পিতভাবে ঘটান। তার বিরুদ্ধে দুটি হত্যা মামলা, একটি ডাকাতি মামলা ও মারামারির ঘটনাসহ একাধিক মামলা রয়েছে।
সিআইডির এই কর্মকর্তা বলেন, আসামি কবির মিয়ার সাথে বেলাবো থানার ৪, ৫, ৬ নম্বর ওয়ার্ড নারায়ণপুর ইউপি সদস্য রিনা বেগমের দীর্ঘদিন ধরে পারিবারিক ও সামাজিক বিরোধ চলে আসছিল। কবির মিয়া ওই বিরোধের জেরে রিনা বেগমের ছেলে ফরিদকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে রিনা বেগম তার ছেলে ফরিদকে কক্সবাজারে পাঠিয়ে দেন। ঘটনার দিন রাতে কবির তার সহযোগী শিপন ও বাচ্চু মিয়াকে বলেন, ফরিদকে বাসা থেকে ডেকে আনার জন্য। পরে বাচ্চু মিয়া কবিরকে জানান, ফরিদ কক্সবাজারে চলে গেছে। এরপর কবিরের নির্দেশে ফরিদের ভাই সোহরাবকে ডেকে আনতে বলা হয়। বাচ্চু মিয়া যেতে না চাইলে তাকে ভয় দেখান কবির ও শিপন। বাধ্য হয়ে সোহরাবকে বাসা থেকে ডেকে আনেন বাচ্চু মিয়া।
সোহরাবকে নিয়ে আসা মাত্রই শিপন ও কবির তাকে জাপটে ধরে মুখে গামছা বেঁধে কুকুরমারা স্কুলের পিছনে নিয়ে যান। পেঁপে বাগানের ভেতরে নিয়ে শফিক ও মিলন সোহরাবের দুই পা চেপে ধরেন, তুহিন মাথা ধরে রাখেন এবং শিপন ডানহাত ধরেন। এরপর প্রথমে শিপন এবং পরে কবির ধারালো ছুরি চালিয়ে দেন সোহরাবের গলায়। সোহরাবের মৃত্যু নিশ্চিত হলে কবিরসহ সবাই পালিয়ে যান।
সিআইডি কর্মকর্তা বলেন, গ্রেফতার আসামি কবির মিয়া নরসিংদী এলাকার দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী। তিনি ওই এলাকায় সব ধরনের অপরাধমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। তার সহযোগী হিসেবে শিপন, বাচ্চু মিয়া, শফিক, মিলনসহ বেশ কয়েকজন ছিলেন। আমরা আসামি কবিরকে আদালতে উপস্থাপন করে অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ড আবেদন করব। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা গেলে এ বিষয়ে আরও তথ্য পাওয়া যাবে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সিআইডির কর্মকর্তারা জানান, ২০১৩ সালে বেলাবো উপজেলা উইনিয়ন পরিষদের সদস্য রিনা বেগমের বাড়ির পাশে রাস্তায় একটি মৃত নারী ও জীবিত অবস্থায় কন্যা শিশু পড়ে থাকতে দেখেন স্থানীয়রা। পরে আদালতের মাধ্যমে শিশুটিকে দত্তক নেন রিনা বেগম। ওই ঘটনায় মামলায় এলাকার বখাটে কবির ও শিপনসহ কয়েকজনকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করে। এতেই বখাটে কবির ও শিপন গ্রুপের ধারণা হয় রিনা বেগম এই কাজ করাচ্ছেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে হত্যা পরিকল্পনা করেন তারা। একের পর এক চেষ্টা চালিয়ে দীর্ঘদিন ব্যর্থ হন কবির। পরে ২০১৭ সালের ১২ অক্টোবর রিনার ছেলে সোহরাবকে পরিকল্পিতভাবে গলা কেটে হত্যা করেন তিনি ও তার সহযোগীরা।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও সিআইডির ঢাকা মেট্রোর পরিদর্শক মো. নুরুল ইসলাম সিদ্দিক বলেন, সোহরাব হত্যাকাণ্ডের ঘটনার তদন্তে আমরা কবিরসহ ৬ আসামির সরাসরি জড়িত থাকার তথ্য প্রমাণ পেয়েছি। এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত মূল আসামি কবির মিয়া ও তার সহযোগী শফিক ও বাচ্চু মিয়াকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে শফিক বর্তমানে জামিনে রয়েছেন। বাকি আরও তিন আসামি এখনও পলাতক রয়েছেন। তাদের গ্রেফতারে চেষ্টা চলছে।
নিহত সোহরাবের মা রিনা বেগম বাংলানিউজকে বলেন, ২০১৩ সালের একটি মেয়ে শিশুকে আমি আদালতের মাধ্যমে দত্তক নেই। রাস্তায় ওই শিশুটির মা মৃত অবস্থায় পড়ে ছিল। পুলিশ ওই ঘটনায় কবির ও শিপনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। এর পর থেকে ওরা আমার পরিবারের ক্ষতি করার চেষ্টায় ছিল। এই ক্ষোভেই কবিরসহ ওরা আমার ছেলেকে হত্যা করেছে। আমি হত্যাকারীদের ফাঁসি চাই।