জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) জালিয়াতিতে জড়িয়ে পড়েছে নির্বাচন কমিশনের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এরা দেশব্যাপী গড়ে তুলেছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগে ঘাপটি মেরে থাকা এ চক্রের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে এনআইডি জালিয়াতি করে অন্যের সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
সম্প্রতি বেশ কয়েকটি জালিয়াতির ঘটনা সামনে আসায় সমালোচনার মধ্যে পড়েছে ইসি। এই পরিস্থিতিতে এনআইডি ও ভোটার নিবন্ধনে জালিয়াতি বন্ধে মাঠ পর্যায়ে কড়া বার্তা দিয়েছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি। এমনকি এনআইডি সংক্রান্ত দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট প্রমাণ দিতে পারলে পুরস্কারের ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনআইডি অনুবিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘জালিয়াত চক্রের সঙ্গে যারাই জড়িত তাদের ছাড় দেওয়া হবে না। প্রতিটি ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে মাঠপর্যায়ে অনিয়ম রোধে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। প্রতিটি ঘটনায় দুটি করে তদন্ত কমিটি করা হচ্ছে।’
এনআইডি অনুবিভাগ ও ইসির কর্মকর্তারা জানান, ইসির অস্থায়ী চাকরিজীবীরা বেশি জড়িয়ে পড়ছেন এই অনিয়মে। একটি প্রকল্পের পর বিকল্প আরেকটি কর্মসংস্থান না পাওয়া, অনিশ্চিত জীবন, সংসার খরচ ও পরিবারের সদস্যদের ভরপোষণসহ নানা চিন্তায় অনিয়মে সম্পৃক্ত হচ্ছেন তারা। গত আট বছরে অনৈতিক কাজে জড়িত থাকায় এমন ৩৯ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।
দেশের ১০ কোটি ৯৮ লাখ নাগরিকের তথ্য সংরক্ষিত আছে যেখানে, নানা অনিয়মের কারণে সেই এনআইডি সার্ভারের সুরক্ষা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ছবিসহ ভোটার তালিকা কার্যক্রম ২০০৭ সালে শুরু হলেও স্মার্টকার্ড প্রকল্প (২০১২ সাল) হাতে নেওয়ার আগ পর্যন্ত দুর্নীতির তেমন কোনো খবর ছিল না। এনআইডি সংক্রান্ত প্রকল্পে ১ হাজার ৩৫৩ জন কর্মী বর্তমানে কর্মরত। বলা হচ্ছে, ইসির কেন্দ্রীয় ডেটাবেজ সুরক্ষিত। উপজেলা পর্যায়েও সার্ভারে ৫ স্তরের নিরাপত্তা সিস্টেম চালু রয়েছে। কিন্তু এত পদক্ষেপ এবং বিভিন্ন সময়ে ইসির কড়া বার্তা সত্ত্বেও তাদের অনিয়মের পথ থেকে ফেরানো যাচ্ছে না। এজন্য এনআইডি জালিয়াত চক্রকে থামাতে সারা দেশে শুদ্ধি অভিযান শুরু করা হয়েছে।
সাম্প্রতিক কয়েকটি জালিয়াতি
সম্প্রতি করোনার সনদ জালিয়াতির হোতা রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. সাহেদকে এনআইডি সংশোধন করে দেওয়া ও জেকেজির চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনাকে দ্বিতীয় আইডি পেতে সহায়তা প্রদানের ঘটনা ঘটেছে। কুষ্টিয়ায় প্রকৃত নাগরিকের এনআইডি পরিবর্তন করে জমি বিক্রি করার চেষ্টা চালানো হয়েছে। এছাড়া ঢাকাস্থ সবুজবাগ ও গুলশান থানা নির্বাচন কার্যালয়ে কর্মরত দুজন ডাটা এন্ট্রি অপারেটর ভুয়া এনআইডি কার্ড তৈরিতে জড়িত থাকার অভিযোগে ধরা পড়েছে। ইতিমধ্যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন তারা। এছাড়া কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ডাটা এন্ট্রি অপারেটর মাদক ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। অবৈধভাবে রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তির কাজে চট্টগ্রাম অঞ্চলের তিন জন ডাটা এন্ট্রি অপারেটরের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
জালিয়াতির এসব ঘটনায় উদ্বিগ্ন ইসির সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এনআইডি প্রকল্পের অভ্যন্তরে শক্তিশালী চক্র এসব ঘটনায় জড়িত। কিন্তু বরাবরই চক্রটি ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে। শুধু ডাটা এন্ট্রি অপারেটর নয়, বড় বড় কর্মকর্তারা অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও কখনোই তা সামনে আসে না। এসব কারণে থেমে থেমে চক্রটি জালিয়াতি অব্যাহত রেখেছে।
যেভাবে জালিয়াতি
চক্রটি কয়েকটি প্রক্রিয়ায় জালিয়াতি করে থাকে। এর মধ্যে এনআইডির অনুবিভাগের সংশ্লিষ্টরা সাধারণত ঢাকা বা মাঠ পর্যায়ে গোপন পাসওয়ার্ড জেনে সার্ভারে প্রবেশ করে জালিয়াতির কার্যক্রম সম্পন্ন করেন। ক্ষেত্রবিশেষে নকল কাগজপত্র তৈরি করে যাচাইয়ের নামে বৈধতা দেন। আবার সরকারের প্রভাবশালী বা নির্বাচন কমিশনের প্রভাবশালীদের তদবিরেও তারা জালিয়াতি করেন। সম্প্রতি ডা. সাবরিনাকে দ্বৈত ভোটার করার ক্ষেত্রে প্রভাবশালী এক ব্যক্তির সুপারিশ পাওয়া গিয়েছিল। গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনীতে আটকে গেলে এনআইডির বিভিন্ন ডেস্কে যারা দায়িত্ব পালন করেন তারা সম্মিলিতভাবে ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিদের কাছে আত্মীয় পরিচয়ে ফাইল পাশ করিয়ে নেন। সিইসিসহ চার নির্বাচন কমিশনার বা সচিবালয়ের সচিব, অতিরিক্ত সচিব, এনআইডি অনুবিভাগের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিরা বা যুগ্ম বা উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা এনআইডি সংশোধনের সুপারিশ করলে জটিল কাজ সহজে হয়ে যায়। এছাড়া মাঠ পর্যায়ে তদন্তের নামে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে সঠিক প্রতিবেদন দেওয়া হয়। শক্তিশালী সিন্ডিকেটের সদস্যরা এভাবে নানা পন্থায় জালিয়াতি করে থাকেন। এসব জালিয়াতিতে মোটা অঙ্কের আর্থিক লেনদেন হয়।
চাকরি হারিয়েছেন ৩৯ জন
নানা অনিয়ম, অপকর্ম ও দুর্নীতির অভিযোগে গত আট বছরে চাকরি খুইয়েছে ইসির আইডিয়া প্রকল্পের ৩৯ কর্মকর্তা-কর্মচারী; যাদের সবাই প্রযুক্তিতে দক্ষ। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, চাকরিচ্যুতদের কেউই ইসির নিজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারী নন। এরা হলেন—আইডিয়া প্রকল্পের এক জন সহকারী পরিচালক, তিন জন টেকনিক্যাল এক্সপার্ট, চার জন টেকনিক্যাল সাপোর্টকর্মী, ৩০ জন ডাটা এন্ট্রি অপারেটর এবং এক জন ম্যাসেঞ্জার।
২০১৩ সালের নভেম্বরে অনৈতিক কাজের দায়ে চাকরি হারান টেকনিক্যাল এক্সপার্ট মোহাম্মদ জাকির হোসাইন। ঐ বছরের ডিসেম্বরে টেকনিক্যাল সাপোর্টকর্মী মো. ইয়াসির আরাফাত একই অপরাধে চাকরিচ্যুত হন। এর পরও দুর্নীতি থামেনি বরং ধাপে ধাপে বেড়েছে। ২০১৫ সালে এনআইডি জালিয়াতিতে জড়িত থাকায় তিন জনের চাকরি যায়। এদের এক জন সহকারী পরিচালক মোস্তফা হাসান ইমাম, অন্য দুই জন টেকনিক্যাল এক্সপার্ট যথাক্রমে মো. মাহমুদুল হাসান ও মো. ইকবাল হোসাইন। পরের বছর ২০১৬ সালে দুর্নীতির দায়ে চাকরি যায় ৯ জনই ডাটা এন্ট্রি অপারেটরের। তারা হলেন—মো. সাবেদুল ইসলাম, মো. জাকির হোসেন, মো. বাবুল আহমেদ, মো. মোস্তফা ফারুক, মো. আবু বক্কর সিদ্দিক, মারজিয়া আক্তার লিজা, শেখ সেলিম শান্ত, মো. সোলায়মান ও সুতপা রানী। পরের বছর আরো আট জনের চাকরি যায়। এরা হলেন—মো. ইকবাল হোসেন, মাহমুদুল ইসলাম, রবিউল করিম, সুব্রত কুমার বিশ্বাস, মো. আবদুল জলিল মিয়া, মো. তারেক আজিজ, মো. জামাল উদ্দিন ও মো. ইকবাল আহমেদ। তার পরের বছরে চাকরি যাওয়া তিন জন হলেন—টেকনিক্যাল এক্সপার্ট মোহাম্মদ সাদেক হোসাইন, ডাটা এন্ট্রি অপারেটর মো. ইউসুফ আলী চৌধুরী রাব্বী ও সুমন দেব। গত বছর সর্বোচ্চ ১০ জনের চাকরি যায়। এরা হলেন—টেকনিক্যাল সাপোর্ট মির্জা আসিফ ইবনে আশরাফ, ডাটা এন্ট্রি অপারেটর মো. রিয়াজ উদ্দিন, মো. আল আমিন, মো. হাফিজুর রহমান, তাহমিনা আক্তার তুহিন, মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, পাবেল বড়ুয়া, মোহাম্মদ জাহেদ হাসান, মো. শাহীন ও ম্যাসেঞ্জার মো. আশিকুল ইসলাম পিন্টু। চলতি বছর এখন পর্যন্ত তিন জনের চাকরি গেছে। এরা হলেন—ডাটা এন্ট্রি অপারেটর অবিনাশ চন্দ্র রায়, সিদ্ধান্ত শংকার সুত্রধর ও মো. আনোয়ারুল ইসলাম।
এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে—অন্যের সম্পত্তি বিক্রিতে সহায়তা করার জন্য নকল এনআইডি তৈরি করে দেওয়া, ব্যাংক ঋণ পাইয়ে দিতে ভুয়া এনআইডি তৈরি করা এবং টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের ভোটার করা। রোহিঙ্গাদের ভোটার কাজে সহায়তা করার জন্য চট্টগ্রামের ডাবলমুরিং নির্বাচন কার্যালয়ের অফিস সহায়ক জয়নাল আবেদীনকেও আটক করে পুলিশ।
দুর্নীতির প্রমাণ দিলে পুরস্কার
আইন অনুযায়ী শাস্তির বিধান তুলে ধরে সম্প্রতি মাঠ পর্যায়ে পাঠানো ইসির এক নির্দেশনায় বলা হয়েছে, কোনো কর্মকর্তা/কর্মচারী দোষী প্রমাণিত হলে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০১০-এর ধারা ১৬ (১) অনুযায়ী জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন কার্যক্রমে তথ্য-উপাত্ত বিকৃত-বিনষ্ট করার অপরাধে অনূর্ধ্ব সাত বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। প্রকল্পের কর্মকর্তারা/কর্মচারীদের যে কেউ যে কোনো ধরনের অনৈতিক কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে তাত্ক্ষণিকভাবে উল্লেখিত আইনের ধারা অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এছাড়া যদি কেউ জালিয়াতি/দুর্নীতির সুস্পষ্ট তথ্য ও প্রমাণ প্রকল্প কর্তৃপক্ষকে সরবরাহ করতে পারে তবে তাকে যথাযথভাবে পুরস্কৃত করা হবে।