রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ার্ডে মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীর মরদেহ রেখে ছেলেকে পুলিশে দেওয়ার ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়েছে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ শিশু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. বেলাল উদ্দিনকে প্রধান করে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে সাতদিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
স্ত্রীকে বাঁচাতে হাসপাতালে যাওয়া একজন মুক্তিযোদ্ধাকে সপরিবারে নির্যাতনের বিষয়ে রামেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কি পদক্ষেপ নিয়েছে জানতে চাইলে মেডিকেলের উপ-পরিচালক ডা. সাইফল ফেরদৌস বলেন, ঘটনার বিষয়ে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলী। অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন রণাঙ্গনে। বয়স ৭৫ এর কাছাকাছি। ৩৫ বছর পুলিশে চাকরি করেছেন। বুধবার অসুস্থ স্ত্রী পারুল বেগমকে প্রায় গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় নিয়ে যান রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। হাসপাতালের জরুরি বিভাগ থেকে টিকিট নিয়ে প্রথমে পাঠানো হয় ৪৫ নম্বর ওয়ার্ডে। ভর্তি স্লিপে লেখা হয়েছে ষ্ট্রোক। পরে পারুল বেগমকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ৪৬ নম্বর ওয়ার্ডে। সেখানে গিয়ে পারুল বেগমের ছেলে রাকিবুল ডাক্তার নার্সদের কাছে গিয়ে তার মাকে একটু দেখার জন্য হাতজোড় করে অনুরোধ করেন। কিন্তু কর্তব্যরত ইন্টার্ন চিকিৎসক তাতে কর্ণপাত করেননি। এসময় ছেলে রাকিবুল আরেক শিক্ষানবিস চিকিৎসকের কাছে যান। তিনিও রোগীর কাছে আসেননি। এসময় রাকিবুল উত্তেজিত হয়ে চিৎকার শুরু করেন।
মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলী বলছিলেন, ‘ছেলের চিৎকার দেখে দু’জন অল্প বয়েসি ডাক্তার ছুটে এসে ছেলে রাকিবুলকে টানতে টানতে নিয়ে মারধর শুরু করে। এসময় দু’জন পুরুষ স্বাস্থ্যকর্মীও তাদের সঙ্গে যোগ দেন। তিনি ছেলে ও তার বৌমাকে রক্ষা করতে যান। এসময় হঠাৎ করেই ১৫-২০ জন ইন্টার্ন চিকিৎসক এসে জড়ো হন ৪৬ নম্বর ওয়ার্ডে। তারা একযোগে এলোপাথাড়ি মারপিট শুরু করে রাকিবুলকে। ছেলেকে রক্ষায় তিনি এগিয়ে গেলে ওই চিকিৎসকরা তার ওপরও হামলা শুরু করে।’
ইসাহাক আলী বলছিলেন, ‘আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। নিজের পরিচয় দেওয়ার পরও কয়েকজন অল্প বয়সি ডাক্তার মিলে আমার বুকে মুখে পিঠে এলোপাথাড়ি কিল ঘুষি আর লাথি মারতে শুরু করে। আমি মেঝেতে পড়ে গেলেও আমাকে টেনেহিঁচড়ে মারতে মারতে একটা ঘরে নিয়ে আটকায়। তখনও আমার ছেলে ও ছেলের বউকে তারা মারধর করছিল। কিছুক্ষণ পর আমাকে যে ঘরে আটকে রেখেছিল সেখানে আমার ছেলেকেও নিয়ে যায়। এরপর আরও কয়েকজন নেতা গোছের ডাক্তার এসে ঘর খুলে আমার ছেলের সামনে আমাকে আবারও লাথি মারতে শুরু করে। মুখে ঘুষি মারতে থাকে। আমি তাদের পা ধরে মাফ চাইলে তারা শুনেনি। এসময় আমার ছেলে প্রতিবাদ করলে আবারও তাকে এলোপাথাড়ি মারধর করে।’
ইসাহাক আলী বৃহস্পতিবার নগরীর বোসপাড়ার বাসায় এসব বলতে বলতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠছিলেন। ইসাহাক আলী আরও বলেন, ‘আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। হাসপাতালে আমার স্ত্রীর কোন চিকিৎসায় হয়নি। শেষে মারা গেছেন। কোন ডাক্তারই তাকে দেখেননি। আমার ছেলে ডাক্তার ডাকতে গেলে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আমি এখন বুকে খুব ব্যাথা অনুভব করছি। আমার সারা শরীরে ব্যাথা। আমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছি। স্ত্রীকে বাঁচাতে না পারলেও একজন মুক্তিযোদ্ধাকে এমন অমানবিক নির্যাতনের কথা কল্পনায়ও ভাবিনি।’
মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলীর ছেলে রাকিবুল বলেন, ‘ওদের দেখে ডাক্তার বলে মনে হয়নি। লাঠিসোঠা রড নিয়ে এসে আমাদের ঘেরাও করে ওয়ার্ডের ভিতরে। আমার স্ত্রী আমাদের রক্ষা করতে এগিয়ে গেলে তারা তার গায়েও হাত তোলে। এমন ভয়ঙ্কর মুর্তি ডাক্তারদের হতে পারে আমি কল্পনা করতে পারি না। আমি মাকে হারিয়ে মানসিকভাবে খুবই বিপর্যস্ত। আমার বাবাও ঘটনার পর থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তিনি শারীরিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন। আমরা এখন কার কাছে অভিযোগ দিবো।’
জানা গেছে, ঘটনার পর ইন্টার্ন চিকিৎসকরা মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলীর স্ত্রীর লাশ ৫ ঘণ্টা আটকে রাখে হাসপাতালে। পরে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে লাশ ফেরত দেন। ওই সময় মায়ের লাশ দেখতে না দিয়ে হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মুক্তার হোসেনের দেওয়া মামলায় রাকিবুলকে গ্রেফতার করে রাজশাহীর একটি আদালতে তোলে পুলিশ। পরিস্থিতি বিবেচনায় আদালত রাকিবুলকে জামিনে ছেড়ে দেন। পরে তিনি গ্রামে নিয়ে গিয়ে তার মায়ের দাফন কাফন সম্পন্ন করেন।
এদিকে হাসপাতালে একজন মুক্তিযোদ্ধা ও তার পরিবারের ওপর এমন ভয়ঙ্কর নির্যাতনকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান। তিনি বলেন, রামেকে এক শ্রেণীর শিক্ষানবিস চিকিৎসকের দৌরাত্ম খুবই ভয়ঙ্কর। তারা রোগীর স্বজনদের সঙ্গে এমন আচরণই করে আসছেন কয়েক বছর ধরে। একজন মুক্তিযোদ্ধাকে লাথি কিল ঘুষি মেরে আহত করার ঘটনার সুষ্টু তদন্ত হওয়া জরুরি।