তবে শিক্ষকদের এভাবে কর্মকর্তা হওয়ার পথ রুদ্ধ হচ্ছে এবার। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের আওতাধীন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য তৈরি করা হচ্ছে ‘সমন্বিত নিয়োগ বিধিমালা-২০২০’ নামের বিধিমালা। এতে প্রাথমিক শিক্ষকদের মধ্যে শুধু প্রধান শিক্ষকদের জন্য এ সুযোগ রাখা হয়েছে। সহকারী শিক্ষকদের বিভাগীয় প্রার্থী হিসেবে ‘উপজেলা সহকারী শিক্ষা অফিসার’ পদে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ রাখা হয়নি।
প্রাথমিক শিক্ষকরা বলছেন, এতদিন ‘উপজেলা সহকারী শিক্ষা অফিসার’ পদে পরীক্ষার সুযোগ দেওয়া হলেও প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের (পিটিআই) ইনস্ট্রাক্টর ও সহকারী ইনস্ট্রাক্টর পদে তাদের বিভাগীয় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হতো না। নতুন বিধিমালায় সব ধরনের কর্মকর্তা পদ থেকে সহকারী শিক্ষকদের বঞ্চিত করা হলো।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. আকরাম আল হোসেন সমকালকে বলেন, বিধিমালাটির খসড়া চূড়ান্ত করে তারা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠিয়েছেন। প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটিতে এটি যাবে। সেখানে খুঁটিনাটি বিস্তারিত আলোচনা হবে। তিনি বলেন, শিক্ষকদের বঞ্চিত করার কোনো প্রশ্ন আসে না। বিভাগীয় প্রার্থী হিসেবে পরীক্ষা দিয়ে নয়, পদোন্নতি পেয়েই প্রধান শিক্ষকরা ভবিষ্যতে সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার (এটিও) হবেন। কেউ কোনো ব্লক পোস্টে আটকে থাকুন, সেটি চাই না। এতে কোনো প্রণোদনা থাকে না। শিক্ষকরাও ধাপে ধাপে ওপরের পদে পদোন্নতি পাবেন। এ জন্য পদোন্নতির সোপান তৈরি করা হচ্ছে।
তবে সিনিয়র সচিব এ কথা বললেও সহকারী শিক্ষকরা প্রশ্ন তুলে বলেছেন, একজন সহকারী শিক্ষক প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি পেতে ৫০ থেকে ৫৫ বছর পর্যন্ত বয়স হয়ে যায়। তাহলে সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার ও উপজেলা শিক্ষা অফিসার আর কবে হবো?
এ প্রসঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. ফসিউল্লাহ বলেন, সহকারী শিক্ষক পদকে এন্ট্রি পদ ধরে ওপরের পদে পদোন্নতি দেওয়া হবে। সবাই যোগ্যতা থাকলে সময়মতো পদোন্নতি পাবেন। শিক্ষকদের মধ্য থেকেই ৮০ ভাগ এটিও বানানো হবে। বাকি ২০ ভাগ এটিও আসবেন সরাসরি নিয়োগ পেয়ে। তাই শিক্ষকদের দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই।
সংকটের শুরু যেখানে : খসড়া নিয়োগবিধিতে আছে, সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারের দুই হাজার ৫৮৯টি পদে নিয়োগে ৮০ শতাংশ পদ বিভাগীয় প্রার্থীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। বাকি ২০ শতাংশ পদ উন্মুক্ত প্রার্থীদের মধ্যে থেকে পূরণযোগ্য। বিভাগীয় প্রার্থী বলতে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের বোঝাবে। বিভাগীয় প্রার্থীদের প্রধান শিক্ষক হিসেবে নূ্যনতম তিন বছর চাকরির অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। তবে বিভাগীয় প্রার্থীদের জন্য সংরক্ষিত পদে যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে পদগুলো উন্মুক্ত প্রার্থীদের মধ্য থেকে পূরণ করা হবে। সরাসরি নিয়োগে বয়স অনূর্ধ্ব ৩০ বছর। তবে বিভাগীয় প্রার্থীদের ক্ষেত্রে ৪৫ বছর পর্যন্ত শিথিলযোগ্য।
কর্মকর্তাদের অন্য পদ উপজেলা/থানা রিসোর্স সেন্টারের ‘ইনস্ট্রাক্টর’-এর ৫০৫টি পদে নিয়োগে মোট পদের ৩৫ শতাংশ পদোন্নতির মাধ্যমে এবং ৬৫ শতাংশ পদ সরাসরি নিয়োগের মাধ্যমে পূরণ করার কথা। তবে পদোন্নতিযোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে সরাসরি নিয়োগের মাধ্যমে পূরণ করার কথা রয়েছে। পদোন্নতির জন্য উপজেলা/থানা রিসোর্স সেন্টারের সহকারী ইনস্ট্রাক্টর/পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের শিক্ষক পদে নূ্যনতম সাত বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা দ্বিতীয় শ্রেণির বিএডসহ দ্বিতীয় শ্রেণির স্নাতক ডিগ্রি চাওয়া হয়। সরাসরি নিয়োগে বয়স ৩০ বছর, তবে বিভাগীয় প্রার্থীদের বয়সের কোনো সীমা উল্লেখ নেই।
ইউআরসি সহকারী ইনস্ট্রাক্টরের ৫০৫টি পদে নিয়োগও একই নিয়মে। তবে এখানেও বিভাগীয় প্রার্থী বলতে শুধু প্রধান শিক্ষকদের বোঝানো হয়েছে। দেশের ৬৭টি পিটিআইতে ইনস্ট্রাক্টর সাধারণ ও বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক ইনস্ট্রাক্টর পদেও প্রাথমিক শিক্ষকদের বিভাগীয় পদোন্নতির সুযোগ রাখা হয়নি। তবে কর্মকর্তাদের অন্যান্য পদ, যেমন- ইউইও, টিইও, এডিপিইও, ডিপিইও পদে শতভাগ পদোন্নতির কথা প্রণীত খসড়ায় বলা হয়েছে।
শিক্ষকরা জানান, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন সহকারী শিক্ষক পদোন্নতি পেয়ে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার (ডিপিইও) পর্যন্ত হতে পারতেন। তবে কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগবিধি-১৯৮৯ জারি করা হলে তা শিক্ষকদের পদোন্নতির পথ রুদ্ধ করে দেয়। পরে পিএসসির নিয়োগবিধি ১৯৯৪ জারি হলে সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার পদে সহকারী শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষকরা বিভাগীয় প্রার্থী হিসেবে ৪৫ বছর বয়স পর্যন্ত আবেদন করতে পারতেন। সর্বশেষ নিয়োগ পর্যন্ত এই নিয়মই অনুসরণ করা হয়েছে।
কিন্তু ‘সমন্বিত নিয়োগবিধি-২০২০’ বাস্তবায়ন হলে সহকারী শিক্ষকরা আর কর্মকর্তা পদে আবেদন করতে পারবেন না।
আগামী কিছুদিনের মধ্যে এই নিয়োগবিধি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থাপন করা হতে পারে। শিক্ষকদের অভিযোগ, এই নিয়োগবিধি পাস হয়ে গেলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের উচ্চপদে পদোন্নতি চিরজীবনের জন্য রুদ্ধ হয়ে যাবে। প্রস্তাবিত নিয়োগবিধির রূপরেখা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সহকারী শিক্ষকরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন।
চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলার মণিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. সালাহ্ উদ্দিন বলেন, নিয়োগ বিধি-২০১৯ পরিবর্তন করে সহকারী শিক্ষক পদ এন্ট্রি পদ ধরে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক পর্যন্ত পদোন্নতি দিতে হবে। এটাই আমরা চাই।
সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার নশিওরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক প্রমথেশ দত্ত বলেন, সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার পদে বর্তমান নিয়োগবিধিতে সহকারী শিক্ষকের বিভাগীয় আবেদনের সুযোগ না থাকায় প্রাথমিকের কয়েক লাখ সহকারী শিক্ষক হতাশ হয়ে পড়বেন।
শিক্ষক নেতারা যা বলেন : প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ শামছুদ্দীন মাসুদ বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এখন উচ্চশিক্ষিত ও মেধাবীরা আসছেন। এই মেধাবীদের ধরে রাখতে হলে তাদের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা অনুযায়ী পদোন্নতির সুযোগ দিতে হবে। আমরা চাই সব পদে যোগ্যতা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে শতভাগ পদোন্নতি এবং পদোন্নতিতে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকের সমান সুযোগ।
প্রাথমিক শিক্ষক ঐক্য পরিষদের প্রধান মুখপাত্র মো. বদরুল আলম বলেন, প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকের মধ্যে কোনো বিরোধ চাই না। আমরা চাই, চাকরি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত শিক্ষকরা পদোন্নতির জন্য আবেদন করতে পারবেন। সেখানে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষক উভয়কেই সুযোগ দিতে হবে।