ইংরেজি দৈনিক নিউ এজ সম্পাদক নূরূল কবীর বলেন, আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছিল ৭০ নির্বাচনের ফলাফল পাকিস্তান মানেনি বলে। আজ স্বাধীনতার পর ৫০ বছর মুক্তিযোদ্ধাদের অবমামনা করা হবে; বিচারপতি সাত্তার কমিশনের অধীনে যেমন নির্বাচন হয়েছিল, তেমন নির্বাচন যদি করতে না পারি তাহলে সেটা আমাদের, রাজনৈতিক দলগুলো, নির্বাচন কমিশন, সবার জন্য লজ্জার।তিনি বলেন, আপনারা ব্যক্তিগত জীবনে যা অর্জন করতে চেয়েছিলেন তা পেয়েছেন। এখন নির্বাচন কমিশনার হয়েছেন, এই পদগুলো বোনাস। তাই জীবনে আর হারানোর কিছু নাই। মানুষের শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা পাওয়ার সুযোগ আছে।নির্বাহী বিভাগ নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনের অধীনে কাজ করবে বলে সংবিধানে বলা আছে। তাই আপনারা যদি চান নির্বাহী বিভাগকে শুনাতে বাধ্য করতে পারেন। সেটা করবেন কি-না, সেটা আপানাদের সিদ্ধান্ত। যে বাছাই কমিটির মধ্য দিয়ে কমিশনের নিয়োগ হয়েছে, সেই কমিটির প্রতি মানুষের আস্থা নেই। কাজেই আপনাদের আস্থা অর্জন করতে হবে।
ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেন, নির্বাচন কমিশনের ভাবমূর্তি শূন্যের কোটায় চলে গিয়েছিল। বর্তমান কমিশনের দায়িত্ব হচ্ছে ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনা। যেকোনো একটি নির্বাচন তাদের জন্য এসিড টেস্ট হবে। তারা প্রথমেই কুমিল্লা সিটি নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। এটাকে আমরা ব্যর্থতা হিসেবে দেখছি।
তিনি বলেন, কমিশনের মধ্যে বিভক্তি, এরকম যেন না হয়। যেন একক ইউনিট হিসেবে কাজ করে। আরেকটি বিষয় সবগুলো দলকে নির্বাচনে আনা। এটি কমিশনের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু গত কমিশনের সে চেষ্টাও ছিল না।বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রকে অনুরোধ জানিয়েছেন, এটা লজ্জার বিষয়। কাজেই নির্বাচন কমিশনের এখানেও একটি রুল আছে।এই সম্পাদক আরো বলেন, কোন সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে, এটা ইসির এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না। যে সরকারের অধীনেই নির্বাচন হোক ইসির দায়িত্ব হবে একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন উপহার দেওয়া। তবে যেখানে রাজনৈতিক সমঝোতা নেই, আস্থা নেই, সেখানে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করা খুবই কঠিন কাজ।দ্য অবজারভার পত্রিকার সম্পাদক ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, সংবিধানের আওতায় দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, তাই জানেন তাদের দায়িত্ব কী। তাই দায়িত্ব পালনে কোথায় কোথায় বাধা আসতে পারে তা আপনারা জানেন। ব্যক্তিগত জীবনে সফলতা আসে, যদি সময়মতো সঠিক ও সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য আরপিওতে (গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ) ক্ষমতা দেওয়া আছে, সংবিধানে আছে, সেটা প্রয়োগ করতে হবে।
তিনি বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বেশ কয়েকটি নির্বাচন হবে। এমনকি বাই নির্বাচনও হতে পারে। সেই নির্বাচন হচ্ছে লিটমাস টেস্ট। ভালো করতে পারলে যাদের এখন নির্বাচন প্রক্রিয়ার ওপর অনাস্থা রয়েছে, সেগুলো থাকবে বলে মনে হয় না। সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারলে রাজনৈতিক অচলায়নতন দূর হবে।
ইত্তেফাক সম্পাদক তাসমিমা হোসেন বলেন, প্রত্যেক জেলায় একেকদিন একেকটা নির্বাচন করেন, তাহলে নির্বাচনের পুরো পরিস্থিতি পাল্টে যাবে। বিভাগ ভিত্তিক জাতীয় সংসদ নির্বাচন করা যায় কি-না, দেখবেন কে কত ভোট পায়। এই ডিভিশনে এক সপ্তাহ, ওই ডিভিশনে ওই সপ্তাহ, দেখেন তো কয়টা লোক আসে। কয়টা আওয়ামী লীগ সিট পায়, কয়টা বিএনপি সিট পায়।
তিনি আরো বলেন, ৩০ শতাংশ যদি ভোট দিতে যায়, তাহলে একজন এতো ভোট পায় কী করে? এগুলো অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। গত নির্বাচনে কে কত ভোট পেয়েছে এগুলো রিসার্চ করা যায়। আগামী নির্বাচন ভালোভাবে না হলে খুনাখুনি হবে।
এই সম্পাদক বলেন, এসপি, ডিসিকে বললে এখন আর কোনো কাজ হয় না। আমরা যাচ্ছি কোথায় লিডারশিপের অভাব প্রতিটি বেলায়। আমরা এখন ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকি। প্রথমে গণভবন, তারপর আল্লাহর দিকে।
প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হোসেন বলেন, শতভাগ ভোটদানের নিশ্চিয়তা ইসিকে দিতে হবে। আগের ইসির কী ভুল ছিল, আর তার আগের ইসি কী ভালো কাজ করেছে, তা চিহ্নিত করতে হবে। এছাড়া সারাদেশে একদিনে নির্বাচন না করে ভাগ করে যায় কি-না, ভারতে যেমনটা হয়, একমাস পরে ফলাফল প্রকাশ হয়। বাংলাদেশে এখনো চিন্তা করা যায় না যে একমাস পর ফল প্রকাশ হবে।
তিনি বলেন, দলগুলো হেরে গেলে মেনে নিতে চায় না। যদি গণতন্ত্র চাই, নির্বাচনে হারতে হবে। যারা নিজেদের অবস্থান জানে, তারা আগে থেকেই ভাবতে থাকে কীভাব এই হারটা ঠেকানো যায়।
তিনি আরো বলেন, জেলা প্রশাসক কেন রিটার্নিং কর্মকর্তা হবে। ইসির নিজস্ব লোকবল হতে হবে। লোকবল না থাকলে আগামী দুই বছরে সেই লোকবল আনতে হবে। প্রশাসনের কোনো লোক নির্বাচনের দায়িত্বে থাকবে না। কয়েকভাগে ভাগ করে নির্বাচন করলে ইসির লোকবল দিয়েই নির্বাচন করা সম্ভব।
তিনি আরো বলেন, সরকারের বা কোনো পক্ষের দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না, যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দরকার, তা নিতে হবে।
সংলাপের অন্যদের মধ্যে চার নির্বাচন কমিশনার, ইসি সচিবসহ সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। অন্য সাংবাদিকদের মধ্যে ছিলেন প্রথম আলোর আনিসুল হক, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক অজয় দাস গুপ্ত, মানবকণ্ঠ ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক দুলাল আহমেদ, আমার সংবাদ সম্পাদক হাশেম রেজা, বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সম্পাদক ইনাম আহমেদ চৌধুরী, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক বিভু রঞ্জন সরকার, বাংলাদেশ জার্নালের সম্পাদক শাহজাহান সরদার, ডেইলি অবজারভার অনলাইন ইনচার্জ কাজী আব্দুল হান্নান, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মাহবুব কামাল, ভোরের ডাক সম্পাদক কে এম বেলায়েত হোসেন, যুগান্তর সম্পাদক সাইফুল আলম, প্রতিদিনের সংবাদ সম্পাদক শেখ নজরুল ইসলাম, জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন, নয়া দিগন্ত সম্পাদক আলমগীর মহিউদ্দিন, ডেইলি স্টারের এক্সিকিউটিভ এডিটর সৈয়দ আশফাকুল হক, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আবু সাঈদ খান ও সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন।
এর আগে শিক্ষাবিদ ও বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে সংলাপ করেছে ইসি। তারা বৈঠকে বসে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের সীমিত ব্যবহার, নির্বাচনের সময় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিজেদের অধীন আনা, দলগুলোর আস্থা অর্জনসহ একগুচ্ছ প্রস্তাব দেন।
কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিশনের অধীনেই আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এক্ষেত্রে ২০২৩ সালের শেষ অথবা ২০২৪ সালের শুরুতে অনুষ্ঠিত হবে নির্বাচন। আর এ নির্বাচনের কর্মপদ্ধতি ঠিক করতেই বিভিন্ন মহলের সঙ্গে সংলাপে বসে পরামর্শ নিচ্ছে ইসি। সব শেষে নিবন্ধিত ৩৯টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও সংলাপে বসবে নির্বাচন কমিশন।