দণ্ডিত প্রধান বিচারপতি, রায়ের পর বিচারক প্রত্যাহার

দণ্ডিত প্রধান বিচারপতি, রায়ের পর বিচারক প্রত্যাহার

ঢাকা: করোনার ছোবলে ২০২১ সালে প্রায় চার মাস আদালতের নিয়মিত কার্যক্রম বন্ধ ছিল। তবুও বছর শেষে বেশ কিছু আলোচিত রায় ও ঘটনায় দেশের মানুষের দৃষ্টি ছিল ঢাকার নিম্ন আদালতের দিকে।

তবে, এ বছর নতুন কিছু ঘটনা আলোচনার জন্ম দেয়। এর মধ্যে অন্যতম ঘটনা হলো- অর্থ আত্মসাৎ ও অর্থ পাচার মামলায় সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার কারাদণ্ড। এছাড়া একটি ধর্ষণ মামলায় আসামিদের খালাসের রায়ে বিতর্কিত কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েন ঢাকার নারী শিশু ট্রাইব্যুনালের এক বিচারক। সমালোচনার মুখে সেই বিচারককে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।দণ্ডিত প্রধান বিচারপতি: 

বাংলাদেশের রাজনৈতিক উত্থাপন-পতনের খেলায় রাজনীতিবিদদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো যেন চিরাচরিত সংস্কৃতি। সেই সংস্কৃতি থেকে সাবেক রাষ্ট্রপতি বা সাবেক প্রধানমন্ত্রী কেউই বাদ পড়েননি। তবে, দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীনভাবে এবারই প্রথম কোনো প্রধান বিচারপতিকে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়। তিনি বাংলাদেশের ২১তম প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, যিনি এসকে সিনহা নামেই সমধিক পরিচিত।

ফারমার্স ব্যাংকের প্রায় চার কোটি টাকা আত্মসাত ও পাচারের অভিযোগে সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার ১১ বছর কারাদণ্ড হয়। চলতি বছর ৯ নভেম্বর ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এর বিচারক শেখ নাজমুল আলম এই রায় দেন। এই মামলায় ব্যাংকারসহ অপর আট আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও দুইজনকে খালাস দেওয়া হয়।

ক্ষমতার অপব্যবহার করে ভুয়া ঋণের মাধ্যমে ২০১৬ সালে চার কোটি টাকা স্থানান্তর ও আত্মসাতের অভিযোগে ২০১৯ সালের ১০ জুলাই এসকে সিনহার নামে এই মামলা করে দুদক। মামলা তদন্ত করে ২০১৯ সালের ৯ ডিসেম্বর চার্জশিট দাখিল করেন দুদক পরিচালক বেনজীর আহমেদ। ২০২০ সালের ১৩ আগস্ট একই আদালত ১১ আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। মোট ২১ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে নভেম্বর এসকে সিনহার কারাদণ্ড হয়।

প্রধান বিচারপতির দায়িত্বপালনকালেও সমধিক আলোচিত ছিলেন এসকে সিনহা। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবার সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে তিনি হয়েছিলেন প্রধান বিচারপতি। তবে, তার বিদায়টা সুখকর হয়নি। একইভাবে প্রথমবারের মতো মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে কোনো প্রধান বিচারপতি হিসেবে পদত্যাগ করতে হয় তাকে।
প্রধান বিচারপতি হিসেবে ২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি দায়িত্ব নেন এসকে সিনহা। দুই বছর নয় মাস ২৪ দিন দায়িত্ব পালনের পর ২০১৭ সালের ১১ নভেম্বর ছুটিতে বিদেশে থাকা অবস্থায় দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন তিনি।

এসকে সিনহার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক দুর্নীতির অভিযোগ আপিল বিভাগের অন্য বিচারপতিদের কাছে একই বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর উপস্থাপন করা হয়। পরদিন সিনহার সঙ্গে বৈঠকের পর আপিল বিভাগের সতীর্থ বিচারপতিরা তার সঙ্গে একত্রে দায়িত্ব পালনে অস্বীকৃতি জানান।

২০১৭ সালের ২ অক্টোবর তিনি এক মাসের ছুটিতে যান। এরপর ১৩ অক্টোবর থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত বিদেশে থাকার অনুমতি নিয়ে দেশ ছাড়েন তিনি। ছুটি শেষে দেশে ফেরার ঘোষণা দিলেও ১১ নভেম্বর সিঙ্গাপুর দূতাবাসের মাধ্যমে তিনি রাষ্ট্রপতি কাছে পদত্যাগপত্র পাঠান।

রায় দিয়ে বিচারিক ক্ষমতা হারান বিচারক: 

গত ১১ নভেম্বর ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ এর বিচারক মোছা. কামরুন্নাহার ধর্ষণ মামলায় আপন জুয়েলার্সের কর্ণধার দিলদার হোসেনের ছেলে সাফাত হোসেনসহ পাঁচজনের খালাসের রায় দেন। রায়ের পর্যবেক্ষণে কিছু বিতর্কিত মন্তব্য করে সমালোচনার মুখে পড়তে হয় ওই বিচারককে।

রায়ের পর্যবেক্ষণের এক পর্যায়ে তিনি বলেন, এক বিছানায় চারজন মিলে শুয়ে থাকলেন, এখানে ধর্ষণ কীভাবে হলো। তারা ছিলেন উইলিংলি পার্টনার (স্বেচ্ছায় শয্যাসঙ্গী)। সেখানে শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে কিন্তু সেটা ধর্ষণ নয়।

তবে, ৭২ ঘণ্টার বেশি সময় পার হয়ে গেলে ধর্ষণ মামলা না নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে সবচেয়ে বেশি সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। বিচারক বলেন, ‘৭২ ঘণ্টার পর মেডিক্যাল টেস্ট করা হলেই ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায় না। তাই ৭২ ঘণ্টার বেশি হলে মামলা না নেয়ার আদেশ দিচ্ছি। কেননা তাতে মামলা প্রমাণ করা দূরহ হয়ে পড়ে। ’ যদিও লিখিত রায়ে ৭২ ঘণ্টা পর মামলা না নেয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি।

রায় নিয়ে নারী অধিকার কর্মীরা সমালোচনায় সোচ্চার হন। সমালোচনার মুখে ১৪ নভেম্বর তাকে জেলা জজ পদমর্যাদার বিচারক মোছা. কামরুন্নাহারের বিচারিক ক্ষমতা প্রত্যাহারের আদেশ দেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। পরে তাকে ট্রাইব্যুনাল থেকে প্রত্যাহার করে আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগে সংযুক্ত করে আদেশ জারি করা হয়।

২০১৭ সালের ২৮ মার্চ জন্মদিনের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়ে অস্ত্রের মুখে ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই দুই ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে ৬ মে বনানী থানায় পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। মামলার অপর আসামিরা হলেন- সাফাত আহমেদের বন্ধু সাদমান সাকিফ, নাঈম আশরাফ ওরফে এইচ এম হালিম, সাফাতের দেহরক্ষী রহমত আলী ও গাড়িচালক বিল্লাল হোসেন।

২০১৮ সালের ৭ জুন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের (ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার) পরিদর্শক ইসমত আরা এমি পাঁচজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রটি আদালতে দাখিল করেন। ওই বছরের ১৩ জুলাই আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। চলতি বছর ২২ আগস্ট মামলাটিতে সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। চার্জশিটভুক্ত ৪৭ জন সাক্ষীর মধ্যে ২২ জনের সাক্ষ্যগ্রহণের মাধ্যমে বিচার শেষ হয়।

Leave a reply

Minimum length: 20 characters ::

More News...

পবিপ্রবি র‌্যাগিংয়ে আহত পাঁচ শিক্ষার্থী হাসপাতালে ভর্তি

বড়াইগ্রামে নির্যাতিত আ’লীগ কর্মীর বাড়িতে বিএনপি’র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী